ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

সোহানা স্বাতী

রক্তচাপ ॥ গল্প

প্রকাশিত: ০৬:১৩, ৪ আগস্ট ২০১৭

রক্তচাপ ॥ গল্প

রাত ৮টায় ফোনটা এলো, ‘কাজটা হয়ে গেছে আপা, এবার আপনি নিশ্চিন্তে বাড়ি চলে যেতে পারবেন। আমরা আপনার ফাইলটা পাঠিয়ে দেব, জটিলতা সব মিটেছে। এ যাত্রায় মনে হয় বেঁচে গেলেন।’ এ যাত্রা বললে ভুল হবে। শেষ যাত্রাই বলা যায়। ৫৯ বছরের দীর্ঘ পথ চলার হিসেব নিকেশ একটা ফাইলে লাল ফিতায় বন্দী। চাকরি শেষে দেনা পাওনার নিখুঁত হিসেব বুঝে নিতেই রাজধানীতে আসা। পি আর এল, প্রভিডেন্ট ফান্ড, অর্জিত ছুটির পাওনাদি সবই তাকে বুঝে নিতে হয়েছে, পেনশন না নিয়ে এককালীন টাকা নিতে গিয়ে আরও খানিকটা জটিলতা বেড়েছে, বসে থাকতে হয়েছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। ওরাও এক সময় বিরক্তকণ্ঠে বলেছে ‘ আপনি আসেন কেন? স্বামী বা ছেলেকে পাঠাবেন, এসবে অনেক রকম লেনদেন আছে, পারসেন্টেস আছে, আপনি বুঝবেন না এসব। যার বোঝার কথা সে তো হঠাৎ চলে গেল বিনা নোটিসে, সে বেঁচে থাকলে হয়ত এসব কোন ঝুঁকি পোহাতে হতো না। চাকরির মেয়াদ শেষ হতে না হতেই ডায়াবেটিসের মেয়াদ শুরু হলো জীবনে, এর মাঝে কয়েকমাস ধরে লাগাতার অফিস পাড়ায় ছোটাছুটি, সব মিলিয়ে বেশ নাজুক অবস্থায় ছিলেন জিনাত রহমান। ফোনটা পেয়ে মনে হলো অনেক দিন পর যেন একটা স্বস্তির খবর পেলেন। যাক, এবার অন্তত নিজের জায়গায় ফিরে যেতে পারবেন। ৩ মাস হলো আছেন বাড়ি ছেড়ে, নিজের ঘর, বিছানা ছেড়ে। এখানে বোনের ছেলে তমালের বাসায় উঠেছেন, একটা ঘর তার দখলে সবসময় সংকোচে জড়সড় থাকতে হয়। সাত বছরের নাতিটার সঙ্গে যদি কখনো মজা করে বলেন, ‘এমন দুষ্টমি করলে আমি কিন্তু চলে যাব। দাদু ভাই... ছেলেটার ঝটপট জবাব, ‘তুমি গেলে তো ভালোই হবে, ভালোই হবে, আমার রুমটা ফ্রি হয়ে যাবে।’ মনটা ভারি হয়ে আসে জিনাতের। এখনকার সময়টাই বুঝি এমন, আগে বাসায় অতিথি এলে ছেলেমেয়েরা কত খুশি হতো। আত্মীয়স্বজনের সান্নিধ্য পেতে উদগ্রীব থাকত, অবশ্য সময়টা বদলে গেছে। এখনকার সবকিছুই আলাদা, প্রতিদিন ব্রয়লার মুরগির একঘেয়ে স্বাদ নিয়ে বেড়ে ওঠা প্রজন্ম। ভাগ্নেটাও বদলে গেছে অনেক, চুপচাপ হয়ে গেছে, আগের সেই চঞ্চলতা কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। বড় বোনের ছেলে, কোলে পিঠে করে কত আদরে মানুষ করেছেন, কত উচ্ছলতা ছিল এক সময়। ‘খালা, নিজের বাসা মনে করে থেকো, যা খেতে ইচ্ছে করে রান্না করে খেও, দেখছো তো সবার ব্যস্ততা।’ আসলেই ব্যস্ত সবাই, বউটা বের হয়ে যায়, সবার আগে। বেসরকারী চাকরি, কাজের অনেক চাপ। অফিস থেকে ফিরে, এসি রুমে দরজা বন্ধ করে নিজের মতো সময় কাটায়। কথা তেমন বলে না। এখানে আসার আগে জিনাত অনেক ঘুরে ঘুরে, পছন্দ করে দুটো শাড়ি এনেছিল বৌমার জন্য, হাতে তুলে দিয়েছিল অনেক আগ্রহ করে, ভাঁজ খুলে দেখার সময়ও হয়নি তার। জিন্স পরতেই হয়ত বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে এখনকার মেয়েরা। কাজের মেয়ের হাতেই সংসারের খুঁটিনাটি, টিভির রিমোট। রাতের সংবাদটা মনোযোগ দিয়ে দেখা অনেক দিনের অভ্যাস জিনাতের, কিন্তু সে তার নির্ধারিত জি বাংলার সিরিয়াল ছেড়ে নিউজ চ্যানেল দিতে নারাজ। অবশেষে খবরের কাগজটাই রিভিশন দিতে হয় তাকে। রান্না তো দুরের কথা, এক কাপ চাও নিজে বানাতে গেলে তার খবরদারী। এবার যাবার পালা। যাবার আগে দেখা করে যেতে চান এতদিন ভোরে যাদের সঙ্গে পাশাপাশি হেঁটেছেন, পরিচয় হয়েছে, কথা বলেছেন। কথা আর তেমন কী? কেউ মন খুলে কথা বলে না এ শহরে। মনের জানালা খুলতে চায় না ঠিকমতো। যদিও বা খোলে, তাতে ভারি পর্দা ঝুলানো থাকে, অন্দর দেখা যায় না। বাইরে থেকে অবশ্য সবাই খুব সুখী, ছেলেমেয়ের প্রতিষ্ঠায় গর্বিত, মেয়ে জামাইয়ের প্রশংসায় পঞ্চমুখ, নাতিনাতনির মেধার গুণে ধন্য, শুধু একজনের বিষয়ে তারা নীরব থাকে, সে হলো ছেলের বৌ। বয়সের ভারে নুয়ে পড়া মালেকা বেগম কদিন আগে বিদায় নিয়ে গেলেন সবার কাছ থাকে, ছেলের কাছে যাচ্ছেন নিউইয়র্ক, প্রবাসে নাকি বুড়ো বুড়িদের কদর তখনই যখন সে নাতি নাতনিদের দেখভাল করতে পারে, রান্নাবান্না করতে পারে। কেউ একজন অবশ্য চাপা স্বরে বলেছিল, তাঁর সারা জীবনের সঞ্চয় গড়া শৌখিন ডুপ্লেক্স বাড়িটা নাকি বিক্রি হয়ে গেছে। ছেলেরা শুধু মায়ের জন্য বিশাল বাড়িটা আটকে রাখতে নারাজ। গোল ছাউনিটার নিচে সিমেন্টের বেঞ্চে বসে কত কথাই মনে পড়েছে জিনাতের। দৃষ্টি জলের দিকে, ঝিলের পার ঘেঁষে ঝাউ গাছ আর কৃষ্ণ চুড়ার সারি নুড়ে পড়েছে জলের টানে, ঝিলের শান্ত জলে ভাসছে ঝরে পড়া ফুলের পাপড়ি, স্নিগ্ধতা দেখলে স্বামীর কথা মনে পড়ে জিনাতের, কত বছরের সুখ দুঃখের সঙ্গী, কতটা একা আরও কিছুদিন, ব্যাগ সেভাবেই গুছিয়ে এসেছিলেন, কিন্তু ভাগ্নে বউয়ের নির্লিপ্ততা, আর কাজের বুয়ার উগ্রতায় তাকে এখানকার পাট গুটাতে হচ্ছে। হঠাৎ বৃষ্টির ঝির ঝির ছাঁটে চিন্তায় ছেদ পড়ল। বৃষ্টির বেগ বাড়াতে অনেকেই তড়িঘড়ি ছুটে এসে আশ্রয় নিল ছাউনির নিচে। ডায়াবেটিস, প্রেসার, মাপার দোকানিও দৌড়ে এলো তার যন্ত্রপাতি নিয়ে। ‘দাও হে, প্রেসারটা মেপে’ সহাস্যে ভরাট কণ্ঠে বললেন, প্রায় ৮০ তে পা রাখা অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল আশরাফ, হাতে বাহারী ছড়ি। তার পিছনে তার একজন সহকারী, দেহরক্ষী বলা যায় যাতে একাকী হাঁটা চলায় শরীর খারাপ লাগলে বাসা পর্যন্ত নিরাপদে নিয়ে যেতে পারে। দোকানি যতœ সহকারে প্রেশার মেপে জানাল, ‘স্যার উপরেরটা সামান্য বেশি।’ আরে এসব কিছু না, ওপারে যাওয়ার সেতু তৈরি হচ্ছে বুঝলে, আমি কোন অসুবিধা ফিল করি না’। মুখের হাসিটা ধরে রেখে জিনাতের দিকে তাকিয়ে দরাজ গলায় বললেন, ‘আসলে রক্তচাপ তো ঐ যন্ত্রে মাপা যায় না। এই যে সবাই এতো গাল ভরা সুখের গল্প দিয়ে চলেছে অবিরত, সব আত্ম সান্ত¡না বুঝলেন? নিজেকে বোঝানো। যার ছেলে মেয়ে উন্নতির যত শিখরে পৌঁছেছে, তাদের তত দুর্দশা সময়ের টানাটানি। মুমূর্ষু বাবা মায়ের জন্য পর্যন্ত সময় নেই। মরেও শান্তি নেই বুঝলেন, রেখে দেবে ডিপ ফ্রিজের ড্রয়ারে, লাশ সিটকা লেগে যাবে তবেই তাদের আসবার সময় হবে। বেঁচে থাকলেও সমস্যা, ভাগের মা, এ ওকে ঠেলবে ও তাকে ঠেলবে। কোন বিষয়ে সন্তানদের মতের মিল নেই, শুধু একটি বিষয়েই তারা সবাই একমত হয়, তা হলো সবকিছু বেচাবিক্রি করে বুড়ো বাপ অথবা মাকে তাদের কাছে এনে পালাক্রমে ২/৩ মাস করে রাখা, তখন একমাত্র ব্যাগেই তাদের সংসার। অধুনিক ফ্ল্যাটে মান্ধাতা আমলের আসবাব। শুধু লোকলজ্জার ভয়ে বৃদ্ধাশ্রমের কথা মুখে ভোলে না। আমি এসবে পাত্তা দেই না। পরিষ্কার বলে দিয়েছি, তোমাদের লাইফে আমি এন্টারফেয়ার করতে চাই না, তোমরাও আমার লাইফ স্টাইলে বাধা দেবে না। উইল করা আছে, আমি চোখ বন্ধ করলেই যার যার ভাগ পেয়ে যাবে তোমরা। সবাইকে দিয়েছি, ড্রাইভার, দারোয়ান, আমার রাঁধুনি, কাজের ছেলে সবাইকে। তারা অবশ্য ফোন করে দুই ঈদে মায়ের মৃত্যুবার্ষীতে আর বাবাদিবসে। নাতিরা দু একটা ই-মেইল করে ব্যাস। আপনার কতটুকু দেবার আছে, তার ওপর নির্ভর করবে তাদের চাপ। রক্তের সম্পর্কের চাপ বয়ে বেড়াতে হয় আমৃত্যু, আসল রক্ষ চাপ তো ওখানেই। মেশিনে ধরা পড়ে না, হা হা হা। বাই দ্যা ওয়ে, আপনাকে মনে হয় নতুন দেখছি, আর শাড়ি পরা রমণী তো আজকাল দেখাই যায় না। হা হা হা। মৃদু হেসে জিনাত জানালেন নিজের সদ্য অবসরে আসবার কথা, পেনশনের হিসাবজনিত জটিলতার জট খুলতে ঢাকায় আসার কথা। আরও জানালেন আগামীকাল নিজ শহরে ফিরে যাচ্ছেন তিনি। Ñতাহলে তো বেশ বিত্তবান এখন আপনি! -না না, কি যে বলেন। তেমন কোন বড় অঙ্কের টাকা না সেকেন্ড ক্লাস চাকুরে। -তা ফিউচার প্লান কী/ অবসরকালীন পরিকল্পনা? -তেমন কিছু না। পারিবারিক সঞ্চয়পত্র। -এটা তো ছকে বাধা চিন্তাধারা। এর বাইরে কিছু করতে চান না? -একটা ইচ্ছে আছে, ছোট্ট একটা হোম, যেখানে কিছু বাবা মা হারা ছেলে পেলে থাকবে। সঙ্গে থাকবে কিছু নিঃসন্তান দম্পতি, এই ধরুন একটা পরিবারের মতো। একে অপরের অবলম্বন। যদিও কাজটা খুব কঠিন, তবে কথা বলেছি কিছু মানুষের সঙ্গে। সাড়াও পেয়েছি। একটা এনজিও সাহায্য করতে রাজি আছে তবে প্রাথমিকভাবে হোমটা নিজেদের দাঁড় করাতে হবে। জানি না কতদূর এগুতে পারব, তবে শুরু করতে চাই আমার সবটুকু সঞ্চয় দিয়ে। নাহ আজ আর দেখা হলো না কারও সঙ্গে, চেনা মুখের মানুষগুলোর কাছ থেকে বিদায় নেওয়া হলো না যাবার আগে, বৃষ্টির কারণে আজ অনেকেই হাঁটতে আসেনি। বৃষ্টিটা এখন খানিকটা কমে এসেছে, চওড়া পাড়ের শাড়ির আঁচলটা সামনে ঘুরিয়ে নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন জিনাত, আঁচলে মাথাটা ঢেকে নিলেন যেতে হবে তাকে। -আজ তাহলে আসি। -আসুন। আপনার জন্য শুভকামনা রইল, ভাল থাকবেন। -হয়তবা ভালই থাকব কারণ আমার কোন রক্তচাপ নেই। হাসি মুখে বিদায় নিলেন জিনাত। বৃষ্টিটা পুরোপুরি থামেনি এখনও ঝির ঝির ছাঁট, বিধছে মুখে চোখে, সুচের মতো। সবকিছু গুছিয়ে নিতে হবে। আজ রাতেই কাল ভোরের সিল্ক সিটি এক্সপ্রেসে রওনা দেবেন তিনি, সামনে হয়ত আরেকটা নতুন জীবনের প্রস্তুতি, সফলতা বা ব্যর্থতা যাই হোক না কেন শুরুটা করতে চান তিনি। কেউ না কেউ হয়ত এগিয়ে নিয়ে যাবে এক সময়। কাজটা শুরু করলে তার হাতে আর তেমন কিছু সঞ্চয় থাকবে না, হয়ত বসত বাড়িটাও দিয়ে দিতে হবে হোমের নামে কাগজে কলমে তা হোক তার তো একা নির্ভর জীবন, পিছুটান নেই কোন। রাতে খাওয়ার পর ট্রেনের এসি কম্পার্টমেন্টের টিকিটটা খালার হাতে দিয়ে চেয়ারটা টেনে মুখোমুখি বসল তমাল। -আর কটা দিন থেকে গেলেই পারতে। -থাকলাম তো অনেক দিন। -তোমাকে একটা কথা বলতে চাই খালা। তুমি যে কিভাবে নেবে। -বল না কী বলবি? -জানো তো আমি একটা ফ্ল্যাটের বুকিং দিয়েছি, এখানে মাত্র দুটো বেডরুম খুব অসুবিধা হয় কেউ এলে। ওটা বড় ফ্ল্যাট, ৩ বেড, ছেলেটার একটা আলাদা রুম থাকবে, খেলার জায়গা থাকবে, আলাদা রিডিং রুম, গেস্ট রুম আলাদা। ইচ্ছে করলে তুমিও এসে থাকতে পার। ছেলেটা কাজের লোকের কাছে মানুষ হচ্ছে। -বেশ তো সুযোগ মতো আসবে। -খালা আমার কিছু টাকা দরকার। এই ধরো পঞ্চাশ লাখ। এই পেমেন্টটা দিলেই ফ্ল্যাটে উঠে যেতে পারব। তুমি কি আমায় সাহায্য করতে পার? কি বলবেন বুঝে উঠতে পারলেন না জিনাত। এমন পরিস্থিতির জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলেন না তিনি। ঠোট দুটো নাড়ানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছেন তিনি, মুখ দিয়ে কোন কথা বের হচ্ছে না, বিন্দু বিন্দু ঘাম জমছে মুখে, ভিজে যাচ্ছে পুরো শরীর, চোখের দৃষ্টি ঘোলা লাগছে, তমালের মুখটা ক্রমেই ঝাপসা আর অচেনা মনে হচ্ছে, মাথাটা প্রচ- ভার ভার লাগছে ঘাড়ে একটা তীব্র চাপ অনুভাব করছেন, মনে হয় রক্তচাপ।
×