ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ড. সৈয়দ হুমায়ুন আখতার

বাংলাদেশের পাহাড়ধস ॥ আপদ ও দুর্যোগের নতুন মাত্রা

প্রকাশিত: ০৪:০৭, ১ আগস্ট ২০১৭

বাংলাদেশের পাহাড়ধস ॥ আপদ ও দুর্যোগের নতুন মাত্রা

সম্প্রতি বাংলাদেশের পাহাড়ী এলাকায় বিশেষ করে চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামে স্মরণকালের ভয়াবহ পাহাড়ধসে ১৬২ জনের মৃত্যু ও সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ায় রাঙ্গামাটিসহ অন্যান্য পার্বত্য জেলায় মানবিক বিপর্যয়ের রূপ নেয়। গত এক দশকে চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও বৃহত্তর সিলেটের পাহাড়ী অঞ্চলে ভূমিধসে ৫০০ জনের অধিক জীবনহানি ও সম্পদের ক্ষতি হয়েছে। কিন্তু গত ১৩ জুন ২০১৭ তারিখের পাহাড়ধস দুর্যোগের সৃষ্টি করে। এ অঞ্চলে পাহাড়ধস ৫০, ১০০ বছর আগেও হয়েছে। তখন এটা বিপর্যয় বা দুর্যোগ সৃষ্টি করেনি বিধায় আমাদের অজানা ছিল। গত ১১ জুন ২০১৭ তারিখ সন্ধ্যায় টিভির পর্দায় যখন দেখছিলাম ঢাকা ও চট্টগ্রাম নগরীর অধিকাংশ অঞ্চল প্রবল বর্ষণে প্লাবিত হয়ে জনজীবনে চরম দুর্ভোগ বয়ে এনেছে এবং একই সঙ্গে আবহাওয়ার পূর্বাভাসে বলা হলো বঙ্গোপসাগরে লঘুচাপের কারণে চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে প্রবল বর্ষণ হবে, তখনই আশঙ্কা হচ্ছিল এই বৃষ্টিপাতে পাহাড়ী অঞ্চলে ভূমিধস হতে পারে। কেননা, আমাদের দেশে বর্ষা মৌসুমেই পাহাড়ধস হয়ে থাকে। শেষ পর্যন্ত আশঙ্কা নির্মম সত্যে পরিণত হলো। ১২ জুন মধ্যরাতে ও ১৩ জুন রাঙ্গামাটি, কাপ্তাই, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান, রাঙ্গুনিয়া, চন্দনাইশ, ফটিকছড়ি ও টেকনাফের বিভিন্ন এলাকায় পাহাড়ধসে মানুষের মৃত্যু ও যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হওয়ার সংবাদ গণমাধ্যমে প্রচার হতে থাকে। এর কয়েকদিন পর মৌলভীবাজারের শমসেরনগরে পাহাড়ধসে ট্রেন যোগাযোগ ব্যাহত হয়। রাঙ্গামাটিতে ২৪২ কিমি দৈর্ঘ্যরে ৭টি সড়কের ১৪৫ স্থানে পাহাড়ধস হয়েছে। ৩৭টি স্থানে সড়ক ধসে গেছে। পাহাড়ধসের পরিপূর্ণ চিত্র পেতে আরও অনেক সময়ের প্রয়োজন। সবার কাছে একই প্রশ্নÑ পাহাড়ে কেন ভূমিধস হয়? যেখানেই পাহাড় বা পাশাপাশি দুটি ভূমির উচ্চতার পার্থক্য রয়েছে সেখানেই ভূমিধসের সম্ভাবনা থাকে। সেটা আগ্নেয়শিলার পাহাড়, রূপান্তরিত শিলার পাহাড় বা পাললিক শিলার পাহাড় যা-ই হোক না কেন, সব ক্ষেত্রেই কম-বেশি পাহাড়ধস হবে। উষ্ণ বায়ুম-লীয় অঞ্চলে অবস্থান এবং ভারি বৃষ্টিপাতের কারণে পাললিক শিলার পাহাড়ে ভূমিধসের প্রবণতা বেশি। পাহাড়ধস প্রকৃতির একটি চলমান ভূ-তাত্ত্বিক প্রক্রিয়া। ভূ-তাত্ত্বিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পাহাড়-পর্বতের সৃষ্টি হয়। আবার প্রাকৃতিক কারণের সঙ্গে মানবসৃষ্ট কিছু বহিস্থ উপাদান যুক্ত হয়ে পাহাড়ধস সংঘটিত হয়ে থাকে। সারাবিশ্বে পাহাড় বা ভূমিধসের কারণে সাত হাজারের অধিক মানুষের মৃত্যু হয়। যুক্তরাষ্ট্রে এই মৃত্যুর সংখ্যা প্রতিবছর ২৫ থেকে ৫০ জন। অনুন্নত দেশে ভূমিধসে মৃত্যুর সংখ্যা কয়েকগুণ বেশি। এর সঙ্গে হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ বিনষ্ট হয়ে থাকে। বিশ্বব্যাপী পাহাড়ধসে জীবনহানি ও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতির সঠিক পরিসংখ্যান নেই। পাহাড়ধস নির্ভর করে পাহাড়ের ঢালের স্থির বা বিশ্রাম কোণের (ধহমষব ড়ভ ৎবঢ়ড়ংব) ওপর। অর্থাৎ পাহাড়ের ঢাল কতটা খাড়া কোণে মাধ্যাকর্ষণ শক্তির বিপরীতে টেকে বা দাঁড়িয়ে থাকতে সক্ষম। এই বিশ্রাম কোণ নির্ভর করে শিলাসমূহের ভৌত গুণাগুণ (ঢ়যুংরপধষ ঢ়ৎড়ঢ়বৎঃরবং), শিলা কতটা শক্ত বা নরম, এর বাঁধন ক্ষমতা কতটুকু, শিলার আন্তঃস্তরের ভূ-তাত্ত্বিক বিন্যাস এবং শিলাস্তরের ঢালের সঙ্গে পাহাড়ের ঢালের সম্পর্কের ওপর। পাহাড়ের ঢাল ও আন্তঃস্তরের ভূ-তাত্ত্বিক বিন্যাস এবং শিলাস্তরের ঢালের সঙ্গে পাহাড়ের ঢালের সম্পর্কের ওপর। পাহাড়ের ঢাল ও আন্তঃস্তরের ঢাল একই দিকে হলে তাকে নতি-ঢাল (ফরঢ় ংষড়ঢ়ব) আর আন্তঃস্তরের ঢাল পাহাড়ের ঢালের বিপরীতে হলে পশ্চাৎ-ঢাল (নধপশ ংষড়ঢ়ব) বলে। সাধারণত নতি-ঢাল পাহাড়ধসের জন্য অনুকূল অবস্থা। শিলার মধ্যে প্রচুর ফাটল বা চির থাকে, যা ভূমিকম্পের সময় ফাটলগুলো আলগা হয়ে যায়। দীর্ঘ সময় ধরে তাপমাত্রার হ্রাস-বৃদ্ধি, বৃষ্টিপাত, রাসায়নিক ক্রিয়ার ফলে পাহাড়ের ঢালের উপরি ভাগের শিলাসমূহের মধ্যে ধীরে ধীরে পরিবর্তন সাধিত হয়ে সংশক্তিপ্রবণতা (পড়যবংরাবহবংং) নষ্ট হয়ে শিলা নরম ও বিচূর্ণ (বিধঃযবৎবফ) হয়। অধিক বৃষ্টিপাতে বৃষ্টির পানি পাহাড়ের মধ্যে অনুপ্রবেশ করে শিলার স্তরসমূহ পানিতে সম্পৃক্ত হয়ে শিলার ওজন বৃদ্ধি করে। একই সঙ্গে শিলার অভ্যন্তরে ক্ষুদ্র শূন্য স্থানে প্রচ- চাপ (ঢ়ড়ৎব-ঢ়ৎবংংঁৎব) সৃষ্টি হয়। ফলে মাধ্যাকর্ষণ শক্তির বিপরীতে পাহাড়ের ঢালের মাটি পাহাড়ের বুকে দাঁড়িয়ে থাকতে না পেরে নিচের দিকে নেমে আসে। এই ধস খুব ধীরে ধীরে (পৎববঢ়) হতে পারে আবার হঠাৎ করেও হতে পারে। অনেক সময় ভরবেগের (সড়সবহঃঁস) কারণে কাদা-বালির মিশ্রণ সমতল ভূমির ওপর ৫ থেকে ৭ কিমি পর্যন্ত প্রবাহিত হতে পারে। ২০০৬ সালে ফিলিপিন্সে সংঘটিত ভূমিধসে ৫ কিমি দূরের একটি গ্রাম ধ্বংস হয়ে যায়। বাংলাদেশের পূর্বাংশে সিলেট থেকে টেকনাফ পর্যন্ত উত্তর-দক্ষিণে প্রলম্বিত টারশিয়ারি যুগের পাহাড় শ্রেণী (যরষষ ৎধহমব) পাললিক শিলা দিয়ে গঠিত। এই পাহাড়শ্রেণীগুলো পূর্ব ভারতের মণিপুর, ত্রিপুরা, মিজোরাম রাজ্য এবং মিয়ানমার পর্যন্ত পূর্ব-পশ্চিমে বিস্তৃত। চট্টগ্রাম, রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবানসহ সিলেট থেকে টেকনাফ পর্যন্ত সমান্তরালভাবে গঠিত হওয়া পাহাড়শ্রেণী ইন্ডিয়ান ও বার্মিজ প্লেটের সংঘর্ষের কারণে সৃষ্ট এবং সক্রিয় প্লেটের ওপর অবস্থিত। এই পাহাড়ের শিলার স্তরগুলো উর্ধভাঁজ (ধহঃরপষরহব) এবং নিম্নভাঁজের (ংুহপষরহব) কাঠামো দ্বারা গঠিত। এই স্তরগুলোর মধ্যে শেলপ্রধান, বালুপ্রধান ও শেল-বালুর আন্তঃস্তরের বিন্যাসের কারণে কিছু অঞ্চল অধিক ভূমিধসপ্রবণ, কিছু মধ্যম ভূমিধসপ্রবণ এবং নিম্ন ভূমিধসপ্রবণ হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। এই শিলাসমূহের মধ্যে তিন ধরনের ছোট-বড় অসংখ্য ফাটল (লড়রহঃ): উত্তর-দক্ষিণ বরাবর, পূর্ব-পশ্চিম বরাবর এবং আড়াআড়িভাবে বিস্তৃত। সম্প্রতি ভূমিকম্পে এই ফাটলগুলো আলগা হয়ে গেছে। প্রতিটি উর্ধভাঁজ এক একটি পাহাড়শ্রেণী সৃষ্টি করে। একটি পাহাড়শ্রেণীর মধ্যে পাশাপাশি অসংখ্য পর্বত ও উপত্যকা থাকে। পর্বতগুলো প্রতিরোধী শিলা ও উপত্যকাগুলো অপেক্ষাকৃত অপ্রতিরোধী শিলা দিয়ে গঠিত। উত্তর-দক্ষিণে প্রলম্বিত এই পাহাড়গুলোর দুটি প্রধান ঢাল : পশ্চিম ও পূর্বদিকে। স্তরীভূত শিলার ভূতাত্ত্বিক বিন্যাসের কারণে পর্বতসমূহের পূর্ব ও পশ্চিমের উভয় ঢালের মধ্যে নতি-ঢাল বিদ্যমান। এই নতি-ঢালের মধ্যে যেসব অবকাঠামো তৈরি করা হয়েছে তা ভূমিধসের ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। বাংলাদেশের পাহাড়ী অঞ্চলের বেশিরভাগ রাস্তা উত্তর-দক্ষিণমুখী করে নতি-ঢালের ওপর নির্মাণ করা এবং এর ওপর ভারি যানবাহন চলাচল করায় ভূমিধসের ঝুঁকি বাড়িয়ে দিয়েছে। মানুষের রাস্তার কাছে থাকার প্রবণতার কারণে পার্বত্য অঞ্চলে রাস্তার পার্শ্ববর্তী পাহাড় কেটে অনেক জনবসতি গড়ে উঠেছে। ফলে ঢাল অস্থিতিশীল হয়ে ভূমিধসের ঝুঁকি ও ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা বেড়ে গেছে। বাংলাদেশের পাহাড়ে যখন গভীর বন ছিল তখন বৃষ্টির অধিকাংশ পানি পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নিচে ছড়ায় চলে যেত। কিন্তু গত কয়েক যুগ ধরে পার্বত্য চট্টগ্রামে ব্যাপকহারে বন উজাড় করার কারণে প্রবল বর্ষণের সময় পাহাড়ের মধ্যে অধিকাংশ পানি সরাসরি ও দ্রুত অনুপ্রবেশ করছে। শিলাসমূহের বিচূর্ণের হার বেড়ে ভূমিধসের সম্ভাবনা অধিকতর হচ্ছে। বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চলের পাহাড়শ্রেণীর মাঝ বরাবর এলাকার উচ্চতা বেশি এবং প্রধানত শেল (ংযধষব) শিলা দিয়ে গঠিত। পাহাড়শ্রেণীর পূর্ব ও পশ্চিম প্রান্তের উচ্চতা কমে সমতল ভূমির সঙ্গে মিশে গেছে। এই এলাকার পাহাড়গুলো আকারে ছোট এবং প্রধানত বেলে শিলা দিয়ে গঠিত। এই দুটি প্রধান শিলার অবস্থানের মধ্যবর্তী পাহাড়গুলো তিন ধরনের শিলা যথা: শেল, সিল্ট ও বেলে স্তরের পরিবৃত্তি (ধষঃবৎহধঃরড়হ) বা আন্তঃস্তরের সমন্বয়ে গঠিত। আন্তঃস্তরের গঠিত পাহাড়ের নতি-ঢাল সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ এবং এখানে ভূমিধস বেশি হয়ে থাকে। বেলে শিলার মধ্যে বৃষ্টির পানি অনুপ্রবেশ করে শেলস্তরে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে আন্তঃস্তরের তল বেয়ে নিম্নমুখী প্রবাহ হতে থাকে। ফলে আন্তঃস্তর তলটি পিচ্ছিল হয়ে ভূমিধস সংঘটিত হয়। একই এলাকায় ভূমিধস সময়ের ব্যবধানে বারবার ফিরে আসে। একবার ভূমিধস হয়ে গেলে ওই এলাকার শিলা বিচূর্ণ অবস্থায় না পৌঁছানো পর্যন্ত পরবর্তী ভূমিধসের সম্ভাবনা কম থাকে। পাহাড়ধস একটি প্রাকৃতিক ঘটনা হলেও মানুষের অপরিণামদর্শী কর্মকা- পাহাড়ধসকে ত্বরান্বিত করেছে। আমাদের পাহাড়গুলোর ভূ-তাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যকে বিবেচনায় নিয়ে সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে পাহাড় ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে পারলে ভূমিধসের ঝুঁকি কমানো সম্ভব। বর্তমানে পাহাড়ের যেসব এলাকা ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে সেগুলোকে ভূ-তাত্ত্বিক জরিপের মাধ্যমে চিহ্নিত করে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদী ব্যবস্থা অবলম্বনে ভূমিধস নিরসন করতে হবে। ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলে প্রতিরক্ষা প্রাচীর (ৎবঃবহঃরড়হ ধিষষ), তারের জালের বেষ্টনী (রিৎব সবংয), পাহাড়ের ঢালে ও রাস্তার পাশে পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা, পাহাড়ের মাটি ক্ষয়রোধ (বৎড়ংরড়হ) বা ধরে রাখার উপযোগী বনায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। পাহাড়ধস বিপর্যয়ের স্থায়ী সমাধন করতে হলে গবেষণার মাধ্যমে দেশীয় প্রযুক্তি উদ্ভাবন করতে হবে। পার্বত্য চট্টগ্রামের উন্নয়নকে অব্যাহত রেখে সেখানে যে কোন অবকাঠামো তৈরির জন্য ভূ-তাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যগুলো বিবেচনায় রাখা অপরিহার্য। লেখক : অধ্যাপক, ভূ-তত্ত্ব বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
×