ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

শিক্ষা হোক উড়ন্ত মহাসড়কে যাত্রাপথের সহায়ক শক্তি

প্রকাশিত: ০৩:৫০, ৩১ জুলাই ২০১৭

শিক্ষা হোক উড়ন্ত মহাসড়কে যাত্রাপথের সহায়ক শক্তি

দেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের হার বেড়েছে। সরকার চেষ্টা করছেন মানসম্মত উচ্চশিক্ষা প্রদানের জন্য। এ জন্য বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। তবে যারা উচ্চ শিক্ষার্থী তারা এমন সব বিষয় পড়তে আগ্রহী যার বাজারে চাহিদা কম। অন্যদিকে দেশে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা গ্রহণে আগ্রহী নয়। সম্প্রতি দেখা যায় যে, একটি পাবলিক লিমিডেট ব্যাংকে ২৬৭টি পদের বিপরীতে ২৫ লাখ আবেদন করেছে, যার মধ্যে বিবিত্র-এমবিএ পাস হচ্ছে ২৩ লাখ। আসলে জনসংখ্যার যে উর্ধগতি সেক্ষেত্রে কর্ম উপযোগী শিক্ষার জন্য সরকার নানামুখী ব্যবস্থা নিলেও একটি অতিরিক্ত জনসংখ্যাপ্রবণ দেশে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা সহজাত বিষয় নয়। উপরন্তু এ দেশের কিছু ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তা-শিল্পপতি আমাদের তরুণ-তরুণীদের কাজে না লাগিয়ে দেশের বাইরে থেকে লোকবল নিয়োগ করে থাকে। এটি প্রয়োজনে করে থাকে, আবার জাতে ওঠার জন্যও করে। এ দেশ থেকে প্রতিবছর অফিসিয়াল চ্যানেলে ৭০০ কোটি টাকার মতো বিদেশী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পেছনে চলে যাচ্ছে বলে পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্ট অনুসারে দেখা যায়। ২০১৫-১৬ লেবার সেনসাস অনুসারে অপ্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোয় কাজ করে ৮৭%-এর বেশি। অন্যদিকে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোয় কাজ করে ১৩%-এর একটু বেশি। দেশের যে উন্নয়ন বর্তমান সরকার করছে তা তৃণমূল পর্যায়ে পৌঁছে দেয়ার প্রয়াস নিয়েছেন। অথচ এ প্রয়াসটি মূলত অপ্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর মাধ্যমে হচ্ছে। সরকার যেহেতু জনদরদী সেজন্য যে কোন উপায়ে উন্নয়ন সুনিশ্চিত করতে চাচ্ছে। এজন্য অপ্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর উন্নয়নের বেশ বড় ভূমিকা পালন করছেন। অথচ বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমানের আমলে আর্থিক খাতে অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছিল। এগুলো অবশ্য পাবলিক লিমিটেড ব্যাংকের মাধ্যমে সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু তার বিদায়ের পর এ ব্যাপারে আর তেমন অগ্রগতি সাধিত হয়নি, বরং বাংলাদেশ ব্যাংক ও পাবলিক লিমিটেড ব্যাংকগুলো যেন দায়িত্ব এড়াতে পেরে বেঁচেছে। অথচ ব্যাংকের মূল লক্ষ্য হচ্ছে যাদের অর্থ আছে তাদের থেকে অর্থ আমানত নিয়ে যাদের অর্থ নেই তাদের মাধ্যমে ব্যবসা-বাণিজ্য করা। কর্মসংস্থান যাতে হয়। দুঃখজনক হলেও সত্য এখন বহু ব্যাংক গা-ছাড়াভাবে ব্যবসা করে। মুনাফা-অতিরিক্ত মুনাফা আহরণ করাই বুঝিবা কাজ। সরকারের সাধু ইচ্ছেকে তারা অকার্যকর করে ফেলছে। বেসরকারী উদ্যোক্তাদের একটা বড় অংশ এ দেশে ব্যবসা গুটিয়ে বিশ্বের অন্য দেশে ব্যবসা করতে ইচ্ছুক। তাদের এ মনোবৃত্তি কোনমতেই দেশপ্রেমের সঙ্গে সংযুক্ত নয়। বরং এদের দেশে বিনিয়োগ ব্যবস্থা সহজ করার জন্য সরকার যে উদ্যোগ নিয়েছে তাকে সাফল্যম-িত করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে হবে। সরকার দেশের উন্নয়নের জন্য আইসিটি তথা ডিজিটালাইজেশনের ব্যবস্থা নিয়েছে। এর ফলে ধীরে ধীরে মানুষ সুফল পাচ্ছে। অনেক কাজ এখন সহজ হয়ে আছে, ক্ষেত্র বিশেষে অবশ্য দুর্নীতিও কমছে। তারপরও ডিজিটালইজেশন একটি চলমান প্রক্রিয়া। যারা সেবা দিচ্ছেন আর যারা সেবা নিচ্ছেন- এ দু’পক্ষের মধ্যে এক ধরনের ভারসাম্য থাকা দরকার। নচেত জালিয়াতি এবং আর্থিক ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে। শিক্ষা, বিশেষত উচ্চশিক্ষাকে দেশের কর্মবাজার উপযোগী তৈরির প্রয়াসের কমতি নেই। দেখা যায় যে, ইউজিসি বর্তমান চেয়ারম্যান আব্দুল মান্নানের নেতৃত্বে স্ট্র্যাটেজিক পরিকল্পনা প্রণয়ন করছে। এটি একটি শুভ উদ্যোগ। এ পরিকল্পনা প্রণয়নের পাশাপাশি বাস্তবায়ন করতে হবে। এদিকে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে আইকিউসির মাধ্যমে হেকাপ প্রকল্প দেশে গুণগত মানসম্পন্ন শিক্ষার একটি পাঁচ বছরের যে মডেলটি তৈরি করেছে সেটি প্রকল্প শেষ হওয়ার পরও যাতে বিদ্যমান থাকে সেজন্য দিকনির্দেশনা দরকার। সম্প্রতি সরকার শিক্ষাক্ষেত্রে মান উন্নয়নের জন্য শ্রীলঙ্কার সঙ্গে চুক্তি করেছে। আবার ভারত সফরকালেও শান্তিনিকেতনের সঙ্গে চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছে। এটি অবশ্যই ইতিবাচক দিক। আশা করব বাংলাদেশে যাতে বিমস্টেকের আওতায় কারিগরি শিক্ষামূলক একটি বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে ওঠে। এমনকি দেশে যদি ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুরের একটি শাখা, কিংবা এআইটির একটি শাখা এবং অস্ট্রেলিয়ার মনোশ ইউনিভার্সিটির শাখা খোলার উদ্যোগ নেয়া যায় তাহলে ভাল হয়। যারা দেশকে পরিত্যাজ্য করে চলে যেতে চান তারা যাক; কিন্তু পুঁজি পাচার যাতে না করতে পারে সেদিকে খেয়াল রাখা দরকার। বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। সমস্যাও প্রচুর। জনসংখ্যার আধিক্য হ্রাস করার কোন উপায় নেই। এটির ক্ষেত্রে কড়াকড়ি করতে গেলে ধর্মান্ধ গোষ্ঠী অপপ্রচার চালাবে। অন্যদিকে বাংলাদেশ যে ধীরে ধীরে এগোচ্ছে তার মূল ধারক-বাহক হচ্ছেন শেখ হাসিনা। প্রতিটি ক্ষেত্রেই তাকে দিকনির্দেশনা নয়, বরং সমাধানের উপায় বাতলে দিতে হয়। এ ব্যাপার থেকে প্রতীয়মান হয় যে, যার যার দায়িত্ব তারা অনেক ক্ষেত্রে পালন করেন না বলেই এ অবস্থা হচ্ছে। শিক্ষাক্ষেত্রে মান উন্নয়নের সামগ্রিক পরিবেশ উন্নত করতে হলে শিক্ষাবিদদের মধ্যে শিক্ষকসুলভ মনোভাব জাগ্রত করতে হবে। কারও কারও মধ্যে নোরামি মনোভাব আছে, তা বন্ধ করতে হবে। ভাল শিক্ষকের বিরুদ্ধে অপপ্রচার বন্ধ করা বাঞ্ছনীয়। শিক্ষার উন্নয়নের জন্য শিক্ষককে যথাসময়ে ক্লাসে যেতে হবে। কোচিং বাণিজ্য বন্ধ করতে হলে অবশ্য শিক্ষক ছাড়াও অভিভাবকদের সহায়তা প্রয়োজন। আবার যে সমস্ত শিক্ষক প্রশ্ন ফাঁস করে তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া দরকার। গবেষণাকর্ম যাতে অন্যের নামে চালিয়ে না দেয় সেজন্য লক্ষ্য রাখতে হবে। বাজারমুখী শিক্ষা দেশ ও জাতির উন্নয়নের জন্য গুরুত্বস্বরূপ। আজ দেশে চাকরিপ্রার্থীর যে হার হচ্ছে অনেক দেশে তার জনসংখ্যাও কম। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রি-প্রাইমারী থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত মোট শিক্ষার্থী (ধর্মীয় ও ইংরেজী মিডিয়াসহ) প্রায় চার কোটি। আর কানাডার জনসংখ্যা হচ্ছে পৌনে চার কোটি। ভুূটানের কথা আর কি বলব। তাদের মোট জনসংখ্যা হচ্ছে ৮ লাখ। তারপরও গত সাড়ে আট বছরে দেশ যথেষ্ট উন্নতি করেছে। শিক্ষার মান বৃদ্ধির প্রয়াস নেয়া হয়েছে। তবে সব বেসরকারী উদ্যোক্তাই যে যথাযথ দায়িত্ব পালন করছেন তা নয়। এমনও দেখা যায়, যারা ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে ব্যবসা করেন তারাই আবার সুশীল সমাজের মুখপাত্র হিসেবে সাধুবাক্য বলেন। শিক্ষার্থীর পাঠ-পঠনে তৈরি করার ক্ষেত্রে শিক্ষকের দায়িত্ব অপরিসীম। তখন আমি পিপলস ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের ব্যবসা বিভাগের প্রধান। শিক্ষক নিয়োগের জন্য বেশ বাছাই করা হলো। দেশের একটি নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী যিনি ৩.৯৬ সিজিপিএ পেয়েছেন, তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, স্ট্র্যাটেজিক ম্যানেজমেন্টে কোন বই পড়েছেন? ছাত্রীর সাফ জবাব শিট পড়েছি। শিক্ষামন্ত্রী কোচিং সেন্টার দূর করতে চান। অথচ প্রথিতযশা বিশ্ববিদ্যালয়ের যে সমস্ত শিক্ষক নীতিবহির্ভূতভাবে পাঠ্যবই না দিয়ে শিট দেন তার দেখার দায়িত্ব কিন্তু অনুষদের ডিনের। অথচ ডিনরা দল ভারি করার জন্য অধিকাংশই এ কাজ করেন না। ফলে সেটি হয়, সরকার শিক্ষার মান উন্নয়ন করতে চাচ্ছে। আর একদল শিক্ষক যেনতেনভাবে পড়াচ্ছেন। শিক্ষার্থীদের অবস্থাও হচ্ছে তদ্রƒপ। অতীশ দীপঙ্করে যখন বিভাগীয় প্রধান ছিলামÑ ট্রিপস এবং ট্রিপসের মধ্যে পার্থক্য জিজ্ঞেস করেছিলামÑ নামকরা বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ৩.৯৪ সিজিপিএ পাওয়া ছাত্র। ইন্টারন্যাশনাল বিজনেসে পাস করেও পার্থক্য বলতে পারেনি। ইদানীং নিম্ন শ্রেণীর বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় কেবল নয়, অনেক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েও শিট আমদানি চলে আসছে। ত্রিশ বছর আগের তত্ত্বের সঙ্গে পরিবর্তন-পরিবর্ধন হতে পারে, প্রয়োজনে বিজনেস প্রসেস রি-ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের দরকার হতে পারে। কিন্তু এ সমস্ত ক্ষেত্রে আধুনিক শিক্ষা পদ্ধতির প্রচলন, আউট কাম বেইজড টিচিং-লার্নিংয়ের ব্যবস্থা করা দরকার। শিক্ষকদের নিয়মিত স্টুডেন্ট কাউন্সিলিং করা দরকার। শিক্ষকতায় তো কম দিন হলো না। ছাত্র-ছাত্রীদের ভালবাসা পেয়েছি। আবার দেখেছি ভাল শিক্ষকের বিরুদ্ধে একদল দল বেঁধে মিথ্যা অভিযোগ করতেÑ কঠিন পড়ায়। এ ধরনের ন্যক্কারজনক ঘটনা প্রমাণ করে যে, নিজের নাক কেটে পরের যাত্রা ভঙ্গ। অথচ বর্তমানে যারা সংঘবদ্ধভাবে গ্রুপিং করছে তারা প্রকারান্তরে বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধাচরণ করছে। বাংলাদেশ যখন উড়ন্ত মহাকাশে যাত্রা করবে সে সময় শিক্ষকরা যেন দেশ-জাতির প্রতি, শিক্ষকতার প্রতি কমিটমেন্ট বজায় রাখেন। মুখে বড় কথা না বলে দেশকে ভালবাসতে শিক্ষা দিতে হবে। শিক্ষকের উচিত পিতৃ-মাতৃসুলভ আচরণ দ্বারা ছাত্রছাত্রীদের দুঃখ-কষ্ট বোঝা। অথচ এখন সমাজ ব্যবস্থায় ইচ্ছেমতো প্রপাগা-া করে পার পেয়ে যাচ্ছে। দেখাচ্ছে যা খুশি তাই করা যায়। আসলে এভাবে হলে তো ছাত্রছাত্রীরা কিভাবে নৈতিকতা শিখবে, সত্য-মিথ্যা জানবে? জ্ঞান মানুষকে প্রসারিত করে, সম্মুখপানে চলার নিশানা ঠিক করে দেয়। অথচ এ অবারিত জ্ঞানের সম্ভাবনাকে নাকচ করে দেয়। বিশ্ববিদ্যালয় শব্দটির সঠিক প্রয়োগ আজকাল কিছু শিক্ষক ভুলে যাচ্ছেন। এরা প্রশ্নপত্র ফাঁস করেন। এদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া উচিত। শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে কিংবা ইউজিসি থেকে বিজ্ঞপ্তি জারি করা দরকার, যাতে শিক্ষকরা ক্লাসে লেসন প্ল্যান দেন, সে অনুযায়ী পাঠ্যপুস্তক পড়ান। নিয়মমতো ক্লাস অডিটিং হয়। পারিবারিক মূল্যবোধ থেকে আসে নৈতিকতা। এ নৈতিকতা প্রাথমিক স্কুলগুলোতেও শিক্ষার ব্যবস্থা করা দরকার। যে সমস্ত শিক্ষক চক্রান্ত করে থাকেন, তাদের বিরুদ্ধে কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থা নেয়া জরুরী। আবার যারা নিজেরাই অন্যায় কাজে লিপ্ত, তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নিতে হবে। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত রিপোর্টে দেখা যায়, চারজন শিক্ষকের বিরুদ্ধে অভিযোগ চাপা দিয়ে রংপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে পদোন্নতি দেয়া হয়েছে। শেখ হাসিনার নির্দেশে শিক্ষামন্ত্রী এবং ইউজিসি চেয়ারম্যান নিরলস পরিশ্রম করলেও তা সাফল্য পেতে পারে বিভিন্ন স্তরে অবস্থানরত শিক্ষকদের দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ দ্বারা। বাংলাদেশের বিভিন্ন উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যে সমস্ত জার্নাল আছে সেগুলোর মান বিবেচনায় এনে র‌্যাঙ্কিংয়ের ব্যবস্থা ইউজিসি যাতে করতে পারে সেজন্য আলাদা লোকবল পদায়ন করতে হবে। উন্নয়নের মহাসড়কে সুশিক্ষা প্রদানই হোক মূল লক্ষ্য। লেখক : শিক্ষাবিদ ও ম্যাক্রো এবং ফিন্যান্সিয়াল ইকোনমিস্ট [email protected]
×