ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ভারতের অর্থনীতি ও শ্রমিকদের নিরাপত্তা

প্রকাশিত: ০৫:০৭, ৩০ জুলাই ২০১৭

ভারতের অর্থনীতি ও শ্রমিকদের নিরাপত্তা

এক শ’ বিশ কোটি মানুষের বিশাল আয়তনের দেশ ভারত। দেশটির কর্মক্ষেত্র যথেষ্ট বিস্তৃত। কৃষি, পর্যটন, চিকিৎসা এবং শিল্পসহ নানা ক্ষেত্রে রয়েছে কর্মসংস্থানের ব্যাপক সুযোগ। কিন্তু এরপরেও এই মুহূর্তে সাড়ে ৪৭ কোটি শ্রমশক্তির মধ্যে ৪০ কোটিরই নেই ন্যূনতম কাজের নিরাপত্তা। শ্রম আইনেও তাদের জন্য নেই কোন আনুষ্ঠানিক রক্ষাকবচ। অথচ ৪০ কোটি শ্রমশক্তি মানে, যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জনসংখ্যার চেয়ে বেশি। ভারতে প্রতিবছর বাড়ছে জিডিপি। এর পেছনে রয়েছে শ্রমিকদের অবদান। জাতীয় অর্থনীতিতে ব্যাপক অবদান রাখা সত্ত্বেও শ্রমিকদের কমছে কাজের নিরাপত্তা ও মজুরি। দেশের মাত্র সাড়ে ১৬ শতাংশ শ্রমিক নিয়মিত মজুরি পায়। বাকিরা অনিয়মিত। এক কথায় বলা যেতে পারে, অনিয়মিত মজুরি পাওয়া শ্রমিকদের জীবন চরম অনিশ্চয়তার অন্ধকারে। এসব তথ্য পাওয়া গেছে, খোদ ভারত সরকারের কেন্দ্রীয় শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় থেকে প্রকাশিত ‘চতুর্থ বার্ষিক কর্মসংস্থান ও বেকারি সমীক্ষার’ প্রতিবেদন থেকে। কেন্দ্রীয় লেবার ব্যুরো এ সমীক্ষা পরিচালনা করেছে। শ্রমশক্তি সম্পর্কিত অপর একটি তথ্যেও বলা হয়েছে, ভারতের প্রতি চারটি পরিবারের মধ্যে তিনটি পরিবারেরই কেউ নিয়মিত মজুরি পায় না। অর্থাৎ শ্রমবাজারের শতকরা ৭৮ ভাগ পরিবার চলে অনিয়মিত রোজগারে। সমীক্ষার পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, ভারতে বছরের দুই থেকে ৬ মাস কাজের সন্ধানে ঘুরে বেড়ানো শ্রমিকের সংখ্যা ১ কোটি ২২ লাখ। এদের মধ্যে শতকরা ৭৭ ভাগ গ্রামের বাসিন্দা। যার মধ্যে আবার তিন ভাগের দুই ভাগের বেশি শ্রমিক অভিবাসী হয়ে আসে শহরে। তারা হয় গ্রামে ফিরে যায় না নয়তোবা যেতে পারে না। ফলে শহরে প্রতিবছর বাড়ে বস্তিবাসীর সংখ্যা। এ সংক্রান্ত অপর একটি হিসেবে বলা হয়েছে, ভারতে কৃষি কাজের বাইরে সাড়ে তিন থেকে চার কোটি মানুষ ঠিকা শ্রমিক হিসেবে কাজ করে। যার প্রায় অর্ধেকই মৌসুমি ঠিকা শ্রমিক। এরা কাজের খোঁজে নিয়মিত শহরে আসে। কাজ না পেলে বা কাজ না থাকলে এরা আবার গ্রামে ফিরে যায়। শ্রমিকদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে, স্বাধীনতার পর থেকে ভারতে একের পর এক সরকার এসেছে। প্রতিটি সরকারই আরও ব্যাপক কর্মসংস্থানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। বাস্তবে সে সব প্রতিশ্রুতির খুব কমই বাস্তবায়ন হয়েছে। বরং শ্রমবাজারে বেড়েছে অনিশ্চয়তা। কমেছে কাজ ও কাজের নিরাপত্তা। জাতীয় অর্থনীতিতে নিয়মিত অবদান রেখে যাওয়া সত্ত্বেও শ্রমিকদের কর্মসংস্থান কমছে, এ অভিযোগের স্বপক্ষে সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ১৯৯৯-২০০০ থেকে ২০০৯-২০১০ সাল পর্যন্ত এক দশকে মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বা জিডিপি বৃদ্ধির হার যেখানে ছিল প্রতিবছর ৭ দশমিক ৫২ শতাংশ, সেখানে কর্মসংস্থান বৃদ্ধির হার থমকে গিয়েছে মাত্র ১ দশমিক ৫ শতাংশে। ১৯৭২-৭৩ থেকে শুরু করে পরবর্তী চার দশকে কর্মসংস্থান বাড়ার হার যেখানে ছিল বার্ষিক ২ শতাংশ। সেখানে পরবর্তীতে তা আরও কমেছে। দেশজ মোট শ্রমশক্তিতে ঠিকা শ্রমিকের হারও প্রতি বছর বেড়েই চলছে। এ মুহূর্তে এই হার ৩০ দশমিক ৯ শতাংশ। নিয়মিত কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে নিয়োগদাতারা ঠিকা ও চুক্তিতে শ্রমিক নিয়োগে ক্রমে আগ্রহী হয়ে উঠছে। এর স্বপক্ষে যুক্তি দিতে গিয়ে নিয়োগদাতারা বলছেন, এতে অর্থ সাশ্রয় ঘটছে। আইনী ঝামেলা কমছে। দায়বদ্ধতা প্রায় নেই। নিয়োগদাতাদের এ প্রবণতা থেকে ১৯৯৯ সালে যেখানে ঠিকা শ্রমিকের অংশ ছিল মাত্র ১০ দশমিক ২৫ শতাংশ। এক দশকের ব্যবধানে ২০১০ সালে তা বেড়ে হয়েছে ২৫ দশমিক ৬০ শতাংশ। একই সময়ে সরাসরি নিযুক্ত শ্রমিকের সংখ্যা ৬৮ দশমিক ৩ শতাংশ থেকে কমে দাঁড়িয়েছে ৫২ দশমিক ৪ শতাংশে। এমনকি স্থায়ী কাজেও স্বল্প-সময়ের মেয়াদে চুক্তিতে নিয়োগের সংখ্যা বাড়ছে। যেখানে আদৌ থাকছে না কোন ধরনের সামাজিক নিরাপত্তা। এভাবেই সংগঠিত শ্রমের বাজার রূপ নিচ্ছে অসংগঠিত চরিত্রে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, দেশের জিডিপির অর্ধেকই আসে অসংগঠিত ক্ষেত্র থেকে। যেখানে আছে মোট শ্রমশক্তির ৯০ শতাংশ। সরকারী তথ্য অনুযায়ী, ঠিকা শ্রমিকদের ৯৩ শতাংশ এবং চুক্তিতে নিয়োগপ্রাপ্ত ৬৮ দশমিক ৪ শতাংশের কোন ‘জব কন্ট্রাক্ট’ নেই। সোজা কথায় ‘হায়ার এ্যান্ড ফায়ার।’ চলছে যখন-তখন অবাধ ছাঁটাই। অথচ ঠিকা শ্রমিকদের অধিকাংশই আসছে সমাজের সবচেয়ে শোষিত অংশ থেকে। যার মধ্যে গ্রাম-শহরের তফসিলি জাতি ও তফসিলি উপজাতি সবচেয়ে বেশি। মানবিক মূল্যবোধ হারিয়ে রাষ্ট্র ক্রমে বাণিজ্যিক হয়ে যাওয়া ও মুক্তবাজার অর্থনীতি, শ্রমবাজারের এ অবস্থার জন্য দায়ী বলে মনে করছেন শ্রমবান্ধব অর্থনীতিবিদরা।
×