ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

একটু হলেও নাড়া দিয়েছে

সুবোধ তুই পালিয়ে যা... -স্বদেশ রায়

প্রকাশিত: ০৪:০৬, ২৮ জুলাই ২০১৭

সুবোধ তুই পালিয়ে যা... -স্বদেশ রায়

খুব চকচকে কোন দেয়াল নয়, অতি সাধারণ একটি দেয়াল তাও কোন বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় নয়, একেবারে সাধারণ কয়েকটি স্থানের দেয়াল। সেই দেয়ালের গায়ের দেয়াল চিত্র বা গ্রাফিটি সমাজের হাতেগোনা কয়েকটি মনকে হলেও নাড়া দিয়েছে। কী আছে ওই গ্রাফিটিতে- একটি খাঁচা, তাতে বন্দী একটি সূর্য আর পরিচর্যাহীন চুল-দাড়ির এক তরুণ, শরীরের তুলনায় পায়ের পাতার আকার বড় তবে সম্পূর্ণ নয়। আর পাশে বেশ সুন্দর হাতের লেখায় দুটি লাইন, ‘সুবোধ তুই পালিয়ে যা... সময় এখন পক্ষে না’। কোথাও কোথাও শেষের লাইনটি পালটে গেছে। কোথাও বা হাতের ভঙ্গি ও রেখা পালটে গেছে। বিশেষ করে যেখানে খাঁচা বন্দী সূর্যটিকে বুকে আটকে ধরেছে। পায়ের পাতার রেখাকে আলতো করে ছেড়ে দিয়ে শিল্পী একে অসীম করেছে। আবার খাঁচা বন্দী সূর্যটিকে যখন বুকের কাছে এনেছে তখন সূর্য ও বুককে মিলিয়ে দিয়েছে। দুটো অসীম সম্ভাবনাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন শিল্পী। বুকের আলো ও সূর্যের আলোর মিলনের পথের জন্য বুকের অসীম ভালবাসা দিয়ে খাঁচা ভর্তি সূর্যটাকে বুকের ভেতর নিয়ে এসেছে। আর কতটা পথ চলতে হবে, তা যে এখনও কেউ জানে না- তাই পায়ের পাতা অসম্পূর্ণ তবে সে অসীম- সেখানে রেখা সম্পূর্ণ নয়। অজানা এই শিল্পীর এই গ্রাফিটি কেন এভাবে সমাজের এক কোনে হলেও নাড়া দিল? কেন দেয়াল থেকে উঠে এলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বা সামাজিক ফোরামে, উঠে এলো পত্রিকায় পাতায়, টেলিভিশনের পর্দায়। কেন এই দেয়াল চিত্রগুলো হয় মিসরীয় সভ্যতা, সিরিয়ান সভ্যতা, গ্রীক সভ্যতা ও ভারতীয় সভ্যতার পাথর খুঁড়লে সব খানে দেখা যায় দেয়াল চিত্র আছে। চিত্রগুলো যেমন সমাজকে উপস্থিত করেছে, সময়কে উপস্থিত করেছে, তেমনি প্রতিবাদীও হয়েছে। সব সময় দেখা যায়, কিছু কিছু দেয়াল চিত্রের ভেতর একটা লাভার উদগিরণ আছে। আসলে এই জ্বালা মুখগুলো কেন হয়, যখন দেখা যায় লাভা স্বাভাবিকভাবে বের হতে পারছে না তখন সে কোন না কোন জ্বালা মুখ সৃষ্টি করে বেরিয়ে আসে। তখন মনে হয়, এই লাভাই তো শীতল হয়ে মাটি হয়েছে। এই লাভা পাহাড় হয়েছে। তারা সবাই স্বাভাবিক পৃথিবীতে- কেবল ওই জ্বালা মুখ থেকে বের হয়ে আসা গলিত লাভাটুকু উত্তপ্ত। বাস্তবে এখানে এসেই বুঝি সৃষ্টি হয় গ্রাফিটিগুলো। যেমন ষাটের ও সত্তরের দশকের নিউইয়র্ক শহরে অনেক গ্রাফিটি হয়েছিল। তাদের তো প্রচারের সব পথ খোলা ছিল তার পরেও কেন হয় ওই গ্রাফিটিগুলো। বাস্তবে ওই সময়ে সমাজ বদলের একটি জোয়ার উঠেছিল পৃথিবীতে। আমেরিকাও সে জোয়ার থেকে পিছিয়ে ছিল না। সেখানেও লাখ লাখ মানুষ ছিল ওই জোয়ারের পক্ষে। তার পরেও খোদ প্রশাসনের একটি সূক্ষ্ম বাধা ছিল। যে বাধা পার হতে পারত না সাধারণ মানুষ। এমনকি তারা বুঝতেও পারত না কোথা থেকে কীভাবে বাধা দেয়া হচ্ছে। কিছু কিছু শিল্পী বুঝতে পারত ওই বাধা। তাঁর বুকের ভেতরের সূর্য তখন সমাজ বদলের জন্য, সমাজে একটি নতুন প্রভাত দেয়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠেছিল। সেই টান থেকেই ষাট ও সত্তর দশকে নিউইয়র্কের ওই গ্রাফিটি। ঠিক তেমনি যুদ্ধবিরোধী আন্দোলনে, ব্রিটেনের গ্রাফিটি। আমাদের দেয়াল ও চিকা আমাদের দেয়ালের ইতিহাস গ্রাফিটির থেকে দেয়াল লিখনের ইতিহাস। তবে দেয়াল লিখনও গ্রাফিটির ভেতরই পড়ে। ট্রেনের কামরায়, বাসস্ট্যান্ডে এমনকি গ্রামের স্কুলের পেছনের কোন গাছের গায়ে যে একটি ছেলে ও একটি মেয়ের নাম লিখে রাখা হয় তাও তো গ্রাফিটি। এই গ্রাফিটিরও কিন্তু একই কারণ, অর্থাৎ কোন কিশোর বা কিশোরী কোথাও প্রকাশ করতে পারছে না যে তারা দুজন এক হতে চায়। তাই শেষ পর্যন্ত গাছের গায়ে বা কোন দূর এক রেল স্টেশনে লিখে রাখে কোন কিশোর তার নামের সঙ্গে আরেকটি কিশোরীর নাম। এটা আমাদের সমাজে বেশি তার কারণ আমাদের সমাজে ডেটিং নেই, প্রকাশ্যে তরুণ-তরুণীর ভালবাসা প্রকাশের সুযোগ খুবই কম। স্বাভাবিক সেখানে এই গ্রাফিটির সৃষ্টি হয়। আমাদের দেয়াল লিখনে অবশ্য ভালবাসা প্রকাশ এক পার্সেন্টও নয়। নব্বই ভাগ রাজনৈতিক। এর কারণ আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্র বেশি সময় শাসিত হয়েছে সামরিক শাসকের দ্বারা। সেখানে মত প্রকাশের কোন স্বাধীনতা ছিল না। পত্রপত্রিকাগুলো সোজাসুজি কোন মত প্রকাশ করতে পারত না। এমনকি সামরিক শাসনামলে টেলিফোনেও কেউ সরাসরি মত প্রকাশ করতে পারতেন না। যেমন যেদিন ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান মার্শাল ল’ জারি করেন ওই খবর সংবাদ সম্পাদককে টেলিফোনে জানিয়েছিলেন সাব এডিটর হিসেবে কর্মরত কবি হাবিবুর রহমান এই বলে যে, চলে নীল শাড়ি, নিঙাড়ি নিঙাড়ি পরানও মোর। এরপরে তিনি জানতে চান অন্য খবরগুলোর কী হবে? সামরিক শাসনের আমলে এক মাত্র মত প্রকাশের জায়গা ছিল এই দেয়াল লিখন। তাও এমনি ওই সুবোধ তুই পালিয়ে যা গ্রাফিটির শিল্পীর মতো নিজেকে লুকিয়ে রেখে। যেমন দেয়াল লিখন এখনও দেয়ালে চিকা মারা নামে পরিচিত। এ নিয়ে গল্প আছে, দুজন ছাত্র দেয়ালে লেখার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন এ সময়ে সেখানে পুলিশ এসে জানতে চায় তারা কী করছে এখানে। ওরা বলে চিকা (ছুচো ইঁদুর) মারছি। সেই থেকে দেয়াল লিখনের মতো গ্রাফিটি বাংলাদেশে চিকা মারা নামে চিহ্নিত। আমাদের দেয়ালে সশস্ত্র বিপ্লবের কথা বলা হয়েছে, জাতীয়তাবাদের সর্বোচ্চ আবেগ মথিত স্লোগান, তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা মেঘনা যমুনাÑ দেয়ালে শোভা পেয়েছে। আবার বঙ্গবন্ধু হত্যার পরে, যখন সমস্ত পত্রপত্রিকায়, রেডিও-টেলিভিশনে বঙ্গবন্ধু নাম নিষিদ্ধ সে সময়েই দেয়ালেই লেখা হয়েছে, এক মুজিব লোকান্তরে, লক্ষ মুজিব ঘরে ঘরে। মুজিব হত্যার পরিণাম, বাংলা হবে ভিয়েতনাম। আবার লেখা হয়েছে, তুমি বঙ্গবন্ধুকে ভালবাসো, আমি তোমাকে ভালবাসব। এই শেষের গ্রাফিটি লিখনটির পাশে কোন ছবি ছিল না কিন্তু যে কেউ তার মনে মনে একটি ছবি একে নিতে পারবে। আমাদের দেয়ালের লিখনের ইতিহাস যেমন দীর্ঘ তেমনি এই লিখনের সংখ্যাও অনেক। সিদ্দিকুর রহমান স্বপন একটি গবেষণা করেছেন এর ওপর। তবে সুবোধ তুই পালিয়ে যা, সময় এখন পক্ষে না এ ধরনের গ্রাফিটি এর আগে এসেছে মাত্র একটি তা ছিল, ‘কষ্টে আছে আইজুদ্দিন’। সেখানে মোটা দাগে আইজুদ্দিনের একটি স্কেচ থাকত। সেটা সুবোধ তুই পালিয়ে যার মতো এত গভীর শিল্পকর্ম নয়। কেন এ গভীরতা এলো বাস্তবে যে কোন শিল্পকর্মে সময় একটি বড় বিষয়। আমাদের যে দীর্ঘ দেয়াল লিখনের ইতিহাসের সময় সে সময় অনেক মৃত্যু আছে, অনেক কষ্ট আছে ঠিকই তবে সে সব মৃত্যু দৈহিক মৃত্যু। এক একটি মৃত্যুর ভেতর দিয়ে লাখ লাখ প্রাণ জেগে উঠত। ওই সময়টিতে আমাদের মনোজগতের বিকাশে কেউ বাধা দিতে পারেনি। বরং কষ্টগুলো, দুঃশাসনগুলো আমাদের মনোজগতকে আরও বেশি শক্তিশালী ও সমৃদ্ধ করত। করত উদার ও গতিশীল। তাছাড়া তখন পৃথিবীজুড়ে একটি উন্মুক্ত ও উদার পরিবেশের উঁচু হাত ক্রমেই উঁচু হচ্ছে। পৃথিবীর দিকে দিকে তখন সর্বহারার জন্য রাষ্ট্রের জন্ম নিচ্ছে। জন্ম নিচ্ছে জাতীয়তাবাদীর রাষ্ট্র, জন্ম নিচ্ছে উদার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। আমেরিকায় চলছে কালো মানুষের অধিকারের আন্দোলন। সেখানে সাদা মানুষ গিয়ে বুকের রক্ত ঢেলে দিচ্ছে, যোগ দিচ্ছে বাঙালী মেয়েও। আবার ইউরোপজুড়ে তখন যুদ্ধবিরোধী ও শান্তির আন্দোলন। এই চমৎকার সময়ের একটি পৃথিবীতে আমাদের মাথার ওপর যতই সামরিক শাসন চেপে থাকুক না কেন, তখন আশা এসে বলছে, এই তো আমি এসে যাচ্ছি, সময় হলো বলে নতুন সূর্য ওঠার। আর নতুন সূর্যের জন্য যেমন দীর্ঘদেহী নেতার আবির্ভাব ঘটেছে তেমনি প্রতিদিন রাজপথে মানব শিশু দেব শিশুতে পরিণত হচ্ছে। ওই সময়ে সকলের অন্তরে ছিল গভীর আশা, বাহুতে ছিল শক্তি। সুবোধ তুই পালিয়ে যার মতো সূর্যটাকে খাঁচায় ভরে নেয়ার মতো দুঃসময় আসেনি তখন। এখন আঘাত যা তা মনোজগতে, বদলে যাচ্ছে যে- সে মনোজগত, পালাতে বলতে হচ্ছে শিল্পীর নিজের মনকে। শিল্পীর নিজের মনকে যখন পালাতে বলতে হয় তখন তো শিল্পকর্মে গভীরতাই আসবে। তাই তো মনে হয় সুবোধ আর কেউ নয়, শিল্পী নিজেই। শিল্পী তাঁর মনকে পালাতে বলছে। এখন আঘাতটা শিল্পী মনে ওপর, আঘাতটা উদার মনের ওপর। পৃথিবীজুড়ে শিল্পী মন, উদার মনের কোন স্বাধীনতা নেই, নেই তাদের বিজয়ের পাল্লা ভারির লক্ষণ। তথ্য প্রবাহের অবাধ যুগ যে কেউ বলতে পারে এটা তো তথ্য প্রবাহের অবাধ যুগ। এখানে তো যেমন খুশি তেমনিই মত প্রকাশ করছে। প্রতিদিন টেলিভিশনের টকশোগুলোতে এক রাজনৈতিক দলের নেতা অন্য রাজনৈতিক দলের নেতাকে যা খুশি তাই বলছে। তার পরেও কেন এমন গ্রাফিটি, কেন সূর্য এমন খাঁচায় বন্দী! তথ্য প্রবাহের অবাধ যুগে বাস্তবে কী প্রকাশ হচ্ছে? একটি রাজনৈতিক দল আরেকটি রাজনৈতিক দলকে দোষারোপ করছে। কখনও বা একে অপরের নেতৃত্বকে দোষারোপ করছে। এর বেশি কি কোন মত প্রকাশ হতে পারছে? দিকে দিকে পৃথিবীজুড়ে যে ধীরে ধীরে হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রীস্টান এমনিভাবে ধর্মের নামে মানুষ ভাগ হয়ে গিয়ে ধর্মীয় মৌলবাদ জেগে উঠেছেÑ তার বিরুদ্ধে কি কোন মত প্রকাশ করতে পারছে কেউ? সারা পৃথিবী এই যে পিছন ফিরে চলতে শুরু করেছে এর বিরুদ্ধে পৃথিবীজুড়ে প্রতিবাদ কই, আশার আলো কই? তাই কি কোন ভবিষ্যতের জন্য সূর্যটাকে খাঁচায় নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে সুবোধ! সুবোধ তো অনেক বোধের অধিকারী। সে বুদ্ধিমান অর্থাৎ বুুদ্ধিতে বা বোধে দ্বীপ্ত যে মানুষ সেই তো সুবোধ। তাকে পরিচালিত করবে অশিক্ষিত কিছু মানুষ! তাদের কথা মতো গড়া হবে সমাজ, তাদের কথা মতো চলবে আমার সমাজের মঙ্গল আর অমঙ্গলের যাত্রার হিসাব নিকাশ! তাদের বিরুদ্ধে কোন কথা বললে মাথাটি শরীর থেকে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে! কনসার্টের সুর বোমার শব্দে বন্ধ হয়ে যাবে, মানুষের থেকে গরুর জীবনের মূল্য বেশি হবে- অথচ সে সব নিয়ে কথা বলা যাবে না? নীরবে দেশ ত্যাগ করবে গণজাগরণ ঘটাতে পারে যেসব তরুণরা তারা, দেশ ত্যাগ করেও তারা পাবে না প্রগতিশীলতার মূল্য। সেখানে তাদের ধর্ম দিয়ে মাপা হবে, মানুষ হিসেবে নয়? এখানে কে কখন মারা যাচ্ছে, কে কী খাচ্ছে এই তথ্যের প্রবাহ যতই অবাধ হয় হোক, তাতে একটি সমাজের, একটি উদার মানুষের কী যায় আসে? বাস্তবে সুবোধ তো মৃত্যুর সংখ্যা প্রকাশ করতে চায় না, পোষাকের ডিজাইন প্রচার বা প্রকাশ করতে চায় না। সুবোধ প্রকাশ করতে চায় তার সেই মনের কথা, তার সেই রেখার ভাষা- যা দিয়ে সে বদলে দিতে পারবে পৃথিবীকে, এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবে পৃথিবীকে। পৃথিবীর পরিচালকরা কি এগিয়ে নেয়ার পক্ষে বর্তমান পৃথিবীতে ধীরে সব পরিচালকরা সামনের থেকে পেছনে হাঁটছে। তাদের বিশ্বাসের কারণে হোক, আর রাষ্ট্রক্ষমতার স্বার্থে হোক সকলেই আত্মসমর্পণ করছে ধর্ম বা বর্ণের ক্ষুদ্রতা বা কূপম-ূকতার কাছে। উদারতার প্রতীক হিসেবে সারা পৃথিবীতে সত্যিকার অর্থে একটিই কসমোপলিটান সিটি গড়ে উঠেছিল লন্ডন। যেখানে কেউ কারো ধর্ম, বর্ণ, জাতীয়তা কোন কিছুই জিজ্ঞাসা করত না। সেখানেই বর্ণ, জাতীয়তা ও ধর্ম ঠেকাতে হলো ব্রেক্সিট। এর পরেও কি সুবোধ বলবে, সময় এখন পক্ষে। যখন সুবোধ দেখে হেফাজতীদের কথামতো রবীন্দ্রনাথ খ-িত হয় পাঠ্যবইয়ে তখন সুবোধ কী করবে, সে কি ভবিষ্যতের আলোটুকু বাঁচিয়ে রাখার জন্য সূর্যকে বুকের কাছে চেপে ধরবে না? আর পৃথিবীতে দিকে দিকে অসহিষ্ণুতা, মতামতকে ধর্মের মোড়কে বেঁধে ফেলা হচ্ছে, চিন্তার বৈচিত্র্য ও ইহজাগতিকতাকে প্রতি মুহূর্তে গলা টিপে করা হচ্ছে হত্যা। শিশুকে শিশুর মতো বেড়ে উঠতে না দিয়ে তাকে ধর্মীয় আচ্ছাদনে বা খোলসের মধ্যে পুরে বড় করা হচ্ছে। স্বাধীনতার থেকে আচরণে ফেলে শিশুকে বড় করার তাড়া পড়ে গেছে দিকে দিকে। মানুষের স্বাভাবিক বেড়ে ওঠার, স্বাধীন চিন্তার জীব হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার স্থানটুকু ক্রমেই কেড়ে নেয়া হচ্ছে। সেখানে রাজত্ব দখল করে চলেছে বোধহীন, অপরিশীলিত কিছু কদাকার হাত। সূর্য যখন সঙ্গে সময় যখন এমন হয় তখন সুবোধ নিজেই নিজেকে বলে তুই পালিয়ে যা। তবে সুবোধ পালালেও সে আশা নিয়ে পালায়। সে তার নিজের খাঁচায় করে একটি সূর্যকে নিয়ে পালায়। এই খাঁচাও আসলে শিল্পীর নিজের মন। যে মনের খাঁচাতে তিনি সূর্যকে নিয়ে যাচ্ছেন। আপন বুকের ভেতর গোটা সূর্যের আলোটাকে নিয়ে কোন এক অজানার পথে পালাচ্ছে। সুবোধ জানে কোন রাত্রি চিরকালের জন্য আসে না। পৃথিবীজুড়ে এখন এক অদ্ভুত অন্ধকার নেমেছে। এই অন্ধকারে বুড়ো প্যাঁচারাও নেমে গেছে শিকারে। তাদের সামনে সুবোধ আর ইঁদুর এক হয়ে গেছে। তারা ধর্মের নামে উন্মাদ, তারা নারী লোলুপ, নারীর কথা বলতে তাদের মুখ দিয়ে লালা আসে। অথচ তাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর মনোজগতটি এ মুহূর্তে মৃত। তাদের বিরুদ্ধে যে যুদ্ধ হচ্ছে তা শুধু স্বার্থের লড়াই। সত্য ও সুন্দরকে প্রতিক্ষার লড়াই নয়। এ সময়টা সুবোধের জন্য মোটেই ভাল সময় না। তার পরেও শেষ পর্যন্ত সুবোধ কি পালাবে? যার হাতের খাঁচায় হোক আর বুকের মাঝে হোক সূর্যের আলো, সে কি শেষ পর্যন্ত পালাতে পারে? একবার তার মনে হতে পারে অনেক বেশি অন্ধকার। অনেক গাঢ় অন্ধকার। এ অন্ধকারে কেবল মৃত, গলিত, পচা এই সব নষ্টে ভরে থাকে নগরীর রাস্তা। তাদের কাছ থেকে সুবোধ পালতে পারে। তবে সূর্য যখন সঙ্গে- শেষ অবধি সুবোধের চোখেই তো দেখা যাবে সূর্য উঠেছে, নতুন ভোর এসেছে। [email protected]
×