ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৫ মে ২০২৪, ২২ বৈশাখ ১৪৩১

মানুষের ভালবাসায় যাত্রাপালার বিবেক গৌরাঙ্গ আদিত্য ॥ মিলন কান্তি দে ॥

প্রকাশিত: ০৪:১০, ২৫ জুলাই ২০১৭

মানুষের ভালবাসায় যাত্রাপালার বিবেক গৌরাঙ্গ আদিত্য ॥ মিলন কান্তি দে ॥

জীবন জটিলতা, আর্থসামাজিক টানাপোড়েনের মধ্যেও মানুষ এখনও মানুষের জন্য কাঁদে, অন্তরের ভালবাসা উজাড় করে দেয়। কবি শামসুর রাহমান একদা লিখেছিলেন, ‘ঝলসে যাওয়া ঘাসের মত শুকিয়ে যাচ্ছে মমতা’- কবির এ বাণী ঠিক আছে। কিন্তু এরপরও কখনও কখনও দেখি, মানুষের উৎসারিত মমতার ফল্গুধারা বয়ে যায় অসহায়কে রক্ষার জন্য। এ রকম একটি দৃষ্টান্ত দেখিয়ে দিল রাজধানী ঢাকার পাঁচটি নাট্য সংগঠনÑ থিয়েটার আর্ট ইউনিট, প্রাচ্যনাট স্কুল অব ড্রামা এ্যান্ড এ্যাক্টিং, লোকনাট্য দল (বনানী), সুবচন নাট্য সংসদ এবং ম্যাড থেটার। যৌথভাবে তারা যাত্রার বিখ্যাত বিবেক গৌরাঙ্গ আদিত্যের চিকিৎসা সহায়তায় এগিয়ে এসেছেন। প্রবীণ এ যাত্রাশিল্পীকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে দলগুলোর পরিবেশনায় নাট্য প্রদর্শনী চলছে। গৌরাঙ্গ বাবু বর্তমানে পক্ষাঘাতে আক্রান্ত। বাংলাদেশ যাত্রাশিল্প উন্নয়ন পরিষদ নাট্যবন্ধুদের এ মহতী উদ্যোগের প্রতি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছে। আমি গৌরাঙ্গ দা’কে বিশেষভাবে জানি। তার সঙ্গে আমার সখ্য অনেকদিনের। ২০১৩ সালে আমরা তাকে ‘অমলেন্দু বিশ্বাস স্মৃতি পদক’ দিয়েছিলাম। যাত্রাপালায় ‘বিবেক’ অতিগুরুত্বপূর্ণ একটি চরিত্র। বিবেক- পালাকাহিনীকে অধিকতর প্রাণবন্ত করে তোলে এবং তার সুর ও বাণী পথভ্রষ্টদের সঠিক পথে ফিরিয়ে আনার সঙ্কেত দেয়। ড. সাধন কুমার ভট্টাচার্য ‘নাট্যতত্ত্ব মীমাংসা’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘বিবেকেই হচ্ছে বাংলা যাত্রা নাটকের পতাকাচিহ্ন। বাংলাদেশে বিবেকের গানের একজন প্রখ্যাত শিল্পী গৌরাঙ্গ আদিত্য। বর্তমানে এক্ষেত্রে তিনিই একমাত্র প্রবীণতম ব্যক্তিত্ব। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানে সঙ্গীত প্রশিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। বর্তমানে তিনি ঢাকার পরীবাগে ‘আনন্দন আশ্রমে’ নিয়মিত প্রশিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত আছেন। গৌরাঙ্গ আদিত্যর জন্ম ১৯৩৩ সালে নেত্রকোনা জেলার মোহনগঞ্জ উপজেলার দেওথান গ্রামে। বাবা রমেশচন্দ্র এবং মা ঊষা রানী উভয়েই ছিলেন সংস্কৃতি অনুরাগী। বাবার কাছেই সঙ্গীতে হাতেখড়ি গৌরাঙ্গ আদিত্যর। পরবর্তীকালে ওস্তাদ বীরেন্দ্র চন্দ্র গোস্বামী, ওস্তাদ বিজয়কৃষ্ণ ভট্টাচার্য এবং ওস্তাদ গোপাল দত্তের কাছে উচ্চাঙ্গসঙ্গীতে বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হন। কিশোর বয়সে কৃষ্ণলীলায় নদের নিমাই চরিত্রে অভিনয়ের মধ্য দিয়ে যাত্রাজীবন শুরু হয় এ সঙ্গীত সাধকের। তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে নবরঞ্জন অপেরা, বুলবুল অপেরা, গণেশ অপেরা, বাবুল অপেরা এবং বাংলাদেশে আবারও নবরঞ্জন অপেরা, চারণিক নাট্যগোষ্ঠী, কৃষ্ণকলি অপেরা, বঙ্গশ্রী অপেরা প্রভৃতি যাত্রাদলে শতাধিক যাত্রাপালায় বিবেকের অভিনয়ে জীবন্ত কিংবদন্তি হয়ে আছেন গৌরাঙ্গ আদিত্য। শিল্প সাধনার স্বীকৃতিস্বরূপ বহু সম্মাননা ও পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন তিনি। এগুলো হচ্ছেÑ ‘রবীন্দ্রসঙ্গীত বিশারদ শৈলজারঞ্জন স্মৃতি পুরস্কার’, ‘নেত্রকোনার মহুয়া নাট্যগোষ্ঠীর সপ্তম নাট্যোৎসবে সংবর্ধনা’, ময়মনসিংহের দৈনিক স্বদেশ ‘মুকুটহীন সম্রাট’ হিসেবে তাকে আখ্যায়িত করে। ২০০৭ সালে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি আয়োজিত বিবেক গানের আসরে তিনি সংবর্ধিত হন। বেসরকারী চ্যানেল আরটিভির উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিনি সঙ্গীত পরিবেশন করে প্রশংসিত হন। ২০০১ সালে উদীচীর ময়মনসিংহ বিভাগীয় সম্মেলন উদ্বোধন করেন তিনি। ২০০০ সালে বিবিসির বাংলা বিভাগে তার একটি সাক্ষাতকার প্রচার হয়। গত বছর শিল্পকলা একাডেমি আয়োজিত সপ্তাহব্যাপী যাত্রা কর্মশালায় বিবেক গানের মুখ্য প্রশিক্ষক ছিলেন তিনি। যাত্রার বিবেক গৌরাঙ্গ আদিত্যকে সুস্থ করে তোলার জন্য আরও নানামুখী উদ্যোগ-আয়োজন দরকার। এগিয়ে আসতে পারেন সমাজের বিত্তশালী বিবেকবান মানুষ। গৌরাঙ্গ দা, আপনি দ্রুত আরোগ্য লাভ করুন। আবার জাগ্রত হোন। আবার ফিরে আসুন আমাদের মাঝে। আপনার দরাজ কণ্ঠে আমরা আবারও শুনতে চাই চ ীদাসের সেই অমর বাণী- ‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই।’
×