ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

মলয় বিকাশ দেবনাথ

নতুন প্রজন্মের এক রোল মডেল

প্রকাশিত: ০৬:৪০, ১৪ জুলাই ২০১৭

নতুন প্রজন্মের এক রোল মডেল

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তনয়া সায়মা ওয়াজেদ পুতুল বাংলাদেশ অটিজম ও নিউরো ডেভেলপমেন্ট ডিসঅর্ডার বিষয়ক জাতীয় উপদেষ্টা পরিষদের সভাপতি সায়মা ওয়াজেদ পুতুলকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলের জন্য জাতিসংঘের বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার শুভেচ্ছাদূত হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে। এর পূর্বে তিনি প্যারিসস্থ ইউনেস্কো দফতরে ‘ইউনেস্কো’ আমির জারের আল আহমদ আল-সাবাহ পুরস্কার সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক জুরি বোর্ডের সভায় সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন। উন্নত ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রা উন্নয়নে অসামান্য অবদান রাখা ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে স্বীকৃতি দেয়ার জন্য ইউনেস্কো- আমির জারের আল আহমদ আল-সাবাহ পুরস্কারটি চালু করে। কুয়েতের অর্থ সহায়তায় পরিচালিত এই পুরস্কারের অর্থমূল্য ২০,০০০ মার্কিন ডলার, যা একজন ব্যক্তি এবং একটি প্রতিষ্ঠানকে দেয়া হয়। প্রতিবন্ধীদের নিয়ে কাজ করা আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ব্যক্তিদের নিয়ে গঠিত আন্তর্জাতিক জুরি বোর্ড এই পুরস্কার প্রাপ্তির জন্য জমা দেয়া শতাধিক আবেদন পত্রের ভিতর থেকে যোগ্যতম প্রার্থীকে খুঁজে বের করার দায়িত্ব পালন করে থাকে। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অটিজম বিশেষজ্ঞ সায়মা ওয়াজেদ পুতুল জুরি হিসেবে দায়িত্ব পালনের জন্য ইউনেস্কোর মহাপরিচালক কর্তৃক মনোনীত হন। সভার শুরুতে জুরি বোর্ডের সদস্যগণ সায়মা ওয়াজেদকে আগামী দু’বছরের জন্য বোর্ডের সভাপতি নির্বাচিত করেন। সায়মা ওয়াজেদ পুতুল একজন প্রখ্যাত অটিজম বিশেষজ্ঞ। সারাবিশ্বেই তিনি অটিস্টিক শিশুদের অধিকার নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন। তিনি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর বিশেষজ্ঞ প্যানেলের একজন সদস্য। তিনি একজন মনোবিজ্ঞানী। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ব্যারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৯৭ সালে মনোবিজ্ঞান বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রী, ২০০২ সালে ক্লিনিক্যাল সাইকোলজির ওপর মাস্টার্স ডিগ্রী এবং ২০০৪ সালে স্কুল সাইকোলজির ওপর বিশেষজ্ঞ ডিগ্রী লাভ করেন। ব্যারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নের সময় তিনি বাংলাদেশের নারীদের উন্নয়নের ওপর গবেষণা করেন। এ বিষয়ে তার গবেষণাকর্ম ফ্লোরিডার একাডেমি অব সায়েন্স কর্তৃক শ্রেষ্ঠ সায়েন্টিফিক উপস্থাপনা হিসেবে স্বীকৃত হয়।সায়মা ওয়াজেদ হোসেন পুতুল ২০০৮ সাল থেকে শিশুদের অটিজম এবং স্নায়বিক জটিলতাসংক্রান্ত বিষয়ের ওপর কাজ শুরু করেন। অল্প সময়ের মধ্যেই তাঁর কাজ বিশ্বজুড়ে প্রশংসা পেয়েছে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে পুতুলকে হু- এ্যাক্সিলেন্স এ্যাওয়ার্ডে ভূষিত করে। মনস্তত্ত্ব¡বিদ সায়মা যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান অটিজম স্পিকসের পরামর্শক হিসেবেও কাজ করেন। তিনি ২০১৩ সালের জুন থেকে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা বিশেষজ্ঞ পরামর্শক প্যানেলে অন্তর্ভুক্ত হন। সায়মা ওয়াজেদ তার বিভিন্ন ভূমিকা এবং যোগ্যতায় এএসডি বিষয়ে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন। তিনি ২০১১ সালে জুলাই মাসে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অটিজম নেটওয়ার্ক গড়ে তোলেন এবং মেন্টাল হেলথ বিষয়ে হু’র গ্লোবাল এক্সপার্ট এডভাইজারি প্যানেলের একজন সদস্য হন। অটিজম সত্যিকার অর্থে কোন রোগ না। এটা স্নায়ুগত বা মানসিক সমস্যা। এ সমস্যাকে ইংরেজীতে নিউরো ডেভেলপমেন্টাল ডিজঅর্ডার বলে। অটিজমকে সাধারণভাবে শিশুর মনোবিকাশগত জটিলতা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। অটিজমের লক্ষণগুলো শৈশব থেকেই, সাধারণত তিন বছর থেকে প্রকাশ পেতে থাকে। অটিজমে আক্রান্তরা সামাজিক আচরণে দুর্বল হয়, পারস্পরিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে কম সক্ষম হয়। মানসিক সীমাবদ্ধতা ও একই কাজ বার বার করার প্রবণতা দেখা যায়। এই রোগে আক্রান্ত শিশু কারও সঙ্গেই, সে সমবয়সী হোক কিংবা অন্য যে কোন বয়সী কারও সঙ্গে সামাজিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারে না। নাম ধরে ডাকলেও সাড়া দেয় না। এরা অনেকেই আকার ইঙ্গিতে কথা বলতে পছন্দ করে। এ ধরনের শিশু আপন মনে থাকতে পছন্দ করে। নিজের ইচ্ছের মতো চলে। যখন যা করতে ইচ্ছে হয় তা করতে না পারলে এদের খিঁচুনি ভাব হয়। এরা কারও চোখের দিকে তাকায় না। কারও সঙ্গে নিজের ব্যবহারের জিনিসপত্র শেয়ার করতে চায় না। কারও দিকে তাকিয়ে হাসে না কিংবা আদর করলেও ততটা সাড়া দেয় না। অনেকে আবার আদর ও পছন্দ করে না। সাধারণভাবে অটিষ্টিক শিশুরা একই কথা বার বার বলে এবং একই কাজ বার বার করতে পছন্দ করে। অটিস্টিক শিশুরা প্রতিবন্ধী না। কেননা প্রতিবন্ধিত্ব অর্থ প্রতিবন্ধকতার জন্য কোন কাজ করতে না পারাকে বোঝায়। পরিবারে এমন কিছু শিশু দেখা যায় যাদের শারীরিক গঠন স্বাভাবিক নয়। কানে শোনে না। ফলে কথা বলতে পারে না। অনেকে চোখে দেখে না বা কম দেখে। অন্যদিকে অটিস্টিক শিশুদের সাধারণত এ ধরনের প্রতিবন্ধকতা থাকে না। এ ধরনের শিশুদের সাধারণত মানসিক ক্ষমতার বিকাশ বন্ধ হয় না। শুধু তার বিকাশটা অনেক সময় কাক্সিক্ষত হয় না। তবে শিশুর মধ্যে অটিজম ও প্রতিবন্ধিত্ব একসঙ্গে থাকতে পারে। অটিস্টিক শিশুরা কখনও কখনও বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে অত্যন্ত পারদর্শী হয়। এই ধরনের শিশুদের তাই বিশেষ প্রয়োজন সম্পন্ন শিশু বা বুদ্ধিবৃত্তিক চাহিদাসম্পন্ন বলা হয়। যথাযথভাবে তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হলে তারা সম্পূর্ণ স্বাভাবিক জীবন-যাপন করতে পারবে বিধায় এদের প্রতিবন্ধী আখ্যায়িত করা সঠিক নয়। সাধারণত ১৪ মাস থেকে ২ বছর বয়সের মধ্যে মা বাবা বাচ্চার আচরণে অস্বাভাবিকতা বা সাধারণের চেয়ে ভিন্ন বলে ধরতে পারেন। এর মধ্যে রয়েছে, অন্য একই বয়সের বাচ্চাদের চেয়ে খেলার আগ্রহে ভিন্নতা, সামাজিক মেলামেশা যেমন কথা বলা বা ভাব প্রকাশ করার ভিন্নতা ইত্যাদি। কিছু কিছু বাচ্চা আবার ১ থেকে ২ বছর বয়স পর্যন্ত খেলাধুলা কথা বলা সব ঠিক থাকে কিন্তু হঠাৎ করে কথা বলা ও সামাজিক মেলামেশা বন্ধ করে দেয়। এটাকে বলা হয় রিগ্রেসিভ অটিজম। এ ধরনের বাচ্চাদের প্রতি পরিবার এবং সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি যথাযথ হওয়ার জন্যই সায়মা ওয়াজেদের পথচলা।
×