ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মোতাহার হোসেন

অভিমত ॥ সম্ভাবনাময় বৈদেশিক শ্রমবাজার প্রশিক্ষিত জনবল তৈরি জরুরী

প্রকাশিত: ০৩:৫১, ১২ জুলাই ২০১৭

অভিমত ॥ সম্ভাবনাময় বৈদেশিক শ্রমবাজার প্রশিক্ষিত জনবল তৈরি জরুরী

দেশের অর্থনীতি, বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ বৃদ্ধিসহ দেশের সামগ্রিক কর্মকা-ে বিদেশ থেকে পাঠানো রেমিটেন্সের গুরুত্ব অপরিসীম। এক্ষেত্রে সরকারী নজরদারি, ব্যাংকসমূহের যথাযথ ভূমিকা পালন করলে দেশে রেমিটেন্স প্রবাহ বাড়ার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য সফলতা আসবে। বাংলাদেশের শ্রমিক বিশ্বস্থ, কর্মঠ, নিষ্ঠাবান, দায়িত্বশীল, প্রতিশ্রুতিশীল বলেই বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কর্মরত শ্রমিকদের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। বিদেশে বাংলাদেশের শ্রম বাজারের সম্ভাবনা কাজে লাগাতে প্রয়োজন নতুন নতুন শ্রমবাজার অনুসন্ধান এবং কূটনৈতিক তৎপরতা, বিদেশে চাহিদা অনুযায়ী খাতভিত্তিক শ্রমিকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ভাষা শিক্ষা প্রভৃতির ব্যবস্থা করেই জনশক্তি রফতানি বা শ্রমশক্তি প্রেরণের উদ্যোগ নেয়ার বিষয়টি গুরুত্বসহ বিবেচনায় নেয়া দরকার। তাহলে দক্ষ ও প্রশিক্ষিত জনশক্তি প্রেরণ করলে বৈদেশিক রেমিটেন্স প্রবাহ আরও বাড়বে নিঃসন্দেহে। একই সঙ্গে দেশের ভাবমূতি উজ্জ্বল হবে। দেশের এক কোটি মানুষ কর্মসংস্থানের আশায় প্রিয়জন, বন্ধু, সতীর্থ ছেড়ে বিদেশ পাড়ি দিয়ে হাড়ভাঙ্গা খাটুনি, আর সীমাহীন শ্রমে, ঘামে অর্জিত অর্থই দেশের অর্থনীতি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সমৃদ্ধ করছেন। তাদের অভিনন্দন। তাদের সেই টাকায় ভর করে আরও গতিশীল হয়ে উঠছে অর্থনীতির চাকা। জনশক্তি রফতানি খাত দেশের অর্থনীতিতে নতুন প্রাণ সঞ্চার করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ এখন দাঁড়িয়েছে ৩১ বিলিয়ন ডলারে, যাতে প্রবাসী শ্রমিকদের অবদানই বেশি। ২০০৮ সালের পর ২০১৬ সালেই বাংলাদেশ থেকে সর্বোচ্চসংখ্যক কর্মী বিদেশে গেছে। সরকারী ও বেসরকারীভাবে গত বছর দেশের বাইরে গেছে প্রায় সাড়ে সাত লাখ কর্মী। পুরনো শ্রমবাজার খোলার পাশাপাশি নতুন নতুন বাজারেও লোক পাঠানো শুরু হচ্ছে। পুরুষের পাশাপাশি নারীকর্মী যাওয়ার হারও বাড়ছে। শুধু অদক্ষ কর্মীই নয়, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, নার্স থেকে শুরু করে দক্ষ জনশক্তি রফতানির হার বাড়ছে। দক্ষকর্মী গড়ে তুলতে নির্মাণ করা হচ্ছে অর্ধ-শতাধিক প্রশিক্ষণকেন্দ্র। মধ্যপ্রাচ্য ও মধ্য এশিয়ার পাশাপাশি ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া, রাশিয়াসহ উন্নত দেশেও কর্মী পাঠানো শুরু হচ্ছে। নতুন কয়েকটি শ্রম বাজারের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে। কোটি প্রবাসীর পাঠানো টাকায় মাথা উঁচু করে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। সদ্য প্রকাশিত জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৭ সালের জুন পর্যন্ত জনশক্তি রফতানিতে গত আট বছরের রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে বাংলাদেশ। চলতি বছরে মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে সাত লাখ ৪৯ হাজার ২৪৯ শ্রমিক গেছে। ২০১৬ সালে বাংলাদেশ থেকে সবচেয়ে বেশি কর্মী গেছে ওমানে। এক লাখ ৮৭ হাজার ৩৪৮ জন। ওমানের পরই সবচেয়ে বড় শ্রমবাজার সৌদি আরবে গেছে। এক লাখ ৩৯ হাজার ৪৫০ জন। কাতারে গেছে। এক লাখ ১৯ হাজার ৬৩৭ জন। এর পরই বাহরাইনে। ৭১ হাজার ৭৪০ জন, সিঙ্গাপুরে ৫৪ হাজার ও কুয়েতে গেছে ৩৮ হাজার ৬৮২ জন বাংলাদেশী শ্রমিক। এভাবে ১৬২টি দেশে বাংলাদেশ থেকে কর্মী পাঠানো হচ্ছে। শুধু সৌদি আরবেই বাংলাদেশী শ্রমিক আছে ২৬ লাখের বেশি। মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে সে সংখ্যা ৫০ লাখের বেশি। গত ৮ বছরে আট লাখ ৭৫ হাজার ৫৫ জন কর্মী বিদেশে গেছে। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর বাংলাদেশি শ্রমিকদের জন্য সৌদি আরবের শ্রমবাজার ফের চালু হয়েছে। এরপর সেখানে কর্মী যাওয়ার হারও বেড়েছে। সেখানে নারীকর্মী পাঠানোর পাশাপাশি নারী কর্মীর সংখ্যা বেড়েছে। নারীকর্মী পাঠানোর ক্ষেত্রে আগের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে ২০১৬ সালে। গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত এক লাখ ১৫ হাজারের বেশি নারী শ্রমিক অভিবাসী হয়েছে। কর্মসংস্থানের জন্য নারী কর্মীর বিদেশযাত্রা গত বছর আগের বছরের তুলনায় ১০ শতাংশের বেশি বেড়েছে। তবে বিদেশে নারীকর্মীদের ওপর নির্যাতনের অভিযোগও উঠেছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে সরকার গৃহকর্মীসহ বিভিন্ন কাজে প্রবাসে যাওয়া নারীকর্মীদের সহায়তায় সৌদি আরবসহ বেশ কয়েকটি দেশে শেল্টার হোমের ব্যবস্থা করেছে। শ্রম বাজারের হিসাবে বাংলাদেশী কর্মীদের জন্য সৌদি আরব ও আরব আমিরাতের পরেই মালয়েশিয়ার অবস্থান। সেখানে কর্মরত রয়েছে পাঁচ লাখের বেশি শ্রমিক। চলতি মাসেই মালয়েশিয়ার বাজার খুলতে পারে, সে ক্ষেত্রে আগামী পাঁচ বছরে সেখানে প্রায় ১০ লাখ শ্রমিক যেতে পারবে। আরব আমিরাতের শ্রমবাজার খোলার বিষয়েও উভয়পক্ষের মধ্যে আলোচনা চলছে। আরব আমিরাতের সরকার বাংলাদেশ থেকে নতুন করে কর্মী নেয়ার আগ্রহ জানিয়েছে। আর লিবিয়া, ইরাক, কাতার, ওমানসহ পুরনো বিভিন্ন শ্রমবাজারে বাংলাদেশ থেকে কর্মী যাওয়া শুরু হয়েছে। বাংলাদেশের জন্য মধ্যপ্রাচ্যের শ্রমবাজার কিছুটা সঙ্কোচিত হলেও জনশক্তি রফতানির নতুন বাজার হিসেবে যুক্ত হতে যাচ্ছে বেশ কয়েকটি উন্নত দেশ। বাংলাদেশ থেকে কর্মী নিতে রাশিয়া, অস্ট্রেলিয়াসহ কয়েকটি দেশের সঙ্গে সমঝোতা চুক্তি সই হয়েছে। রুশ সরকার তৈরি পোশাক, নির্মাণশিল্পসহ বিভিন্ন খাতে বাংলাদেশ থেকে কর্মী নিতে আগ্রহী। কর্মী নিতে ইতোমধ্যে চাহিদাপত্রও পাঠিয়েছে রাশিয়া। কয়েক বছরের তুলনায় বিদায় অর্থবছরে জনশক্তি রফতানির হার বেড়েছে। বাংলাদেশের শ্রম বাজারের সঙ্গে নতুন করে যুক্ত হচ্ছে রাশিয়া। ইতোমধ্যে ৪০০ জনের ডিমান্ড লেটার পাওয়া গেছে। তৈরি পোশাক, নির্মাণসহ বিভিন্ন খাতে রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে কর্মী যাবে। অস্ট্রেলিয়া সরকারও বাংলাদেশ থেকে দক্ষ কর্মী নিতে আগ্রহী। অল্প সময়ের মধ্যে অস্ট্রেলিয়াও বাংলাদেশের কর্মীদের জন্য বড় শ্রম বাজারের অংশ হতে যাচ্ছে। থাইল্যান্ড, ম্যাকাও, জাপান, হংকং, দক্ষিণ আফ্রিকা, নিউজিল্যান্ড, কানাডা, সুইডেন, এ্যাঙ্গোলা, গ্রিস, জর্দান, ইতালি, সাইপ্রাস, সুদান, লাইবেরিয়া, তানজানিয়া, আজারবাইজান, তাইওয়ান, স্পেন, পোল্যান্ডসহ আরও বেশ কয়েকটি দেশে শ্রমবাজার সৃষ্টির উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। গত বছর প্রবাসীরা ব্যাংকিং চ্যানেলে এক হাজার ৩৬১ কোটি ডলারের সমপরিমাণ রেমিটেন্স দেশে পাঠিয়েছে। ২০১৫ সালে রেমিটেন্স এসেছিল এক হাজার ৫৩১ কোটি ডলার। রেমিটেন্সের প্রবাহ বাড়ায় দেশের অর্থনীতিতে তার অবদানও বেড়েছে। আগের ছয় লাখ কোটির মধ্যে রেমিটেন্সের অবদান ছিল ৬ শতাংশ। আর এখন ১৭ লাখ কোটির জিডিপিতে রেমিটেন্সের অবদান ৭ শতাংশ। মোট আমদানি ব্যয়ের ৩৯ শতাংশ মেটানো হয় রেমিটেন্স দিয়ে। ২০১৫ সালে বিদেশে গেছে পাঁচ লাখ ৫৫ হাজার ৮৮১ কর্মী। বাংলাদেশ থেকে সাধারণত মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতেই সবচেয়ে বেশি কর্মী পাঠানো হয়। সৌদি আরব, কাতার, আরব আমিরাত ও ওমানেই ৫০ লাখের বেশি বাংলাদেশী কর্মী আছে। তবে এর মধ্যে ৯০ শতাংশেরও বেশি অদক্ষ শ্রমিক। দেশগুলোতে চিকিৎসক ও নার্সের ব্যাপক কর্মসংস্থানের সুযোগ রয়েছে। কিন্তু চাহিদার তুলনায় সেখানে চিকিৎসক ও নার্স পাঠাতে পারছে না বাংলাদেশ। জনশক্তি রফতানি খাত থেকে রেমিটেন্স বাড়াতে তাই অদক্ষ কর্মীর পাশাপাশি দক্ষকর্মী পাঠানোর উদ্যোগ প্রয়োজন। ‘বিদেশের প্রচলিত শ্রমবাজারগুলো ঘিরেই মূলত বৈদেশিক কর্মসংস্থান হচ্ছে। এর মধ্যে কোন দেশ তাদের অভ্যন্তরীণ নানা কারণে কর্মী নেয়া বন্ধ বা স্থগিত রাখলে চাপ পড়ে দেশের অর্থনীতিতে। এমন পরিস্থিতিতে বৈদেশিক কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে নতুন নতুন শ্রমবাজার অনুসন্ধান ও বিদ্যমান শ্রমবাজার ধরে রাখার লক্ষ্যে কাজ চলছে। বাজার বিশ্লেষণের মাধ্যমে ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া, ব্রাজিলসহ ১০টি নতুন দেশে শ্রমবাজার সম্পর্কে স্টাডি সম্পন্ন করা হয়েছে। পুরনো অনেক শ্রমবাজারে আগের চেয়ে অনেক বেশি কর্মী নেয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছে। দক্ষ শ্রমিক গড়ে তুলতে সারাদেশে প্রশিক্ষণ সেন্টার নির্মাণ করা হচ্ছে; যেখান থেকে একটি বিশেষ কাজে দক্ষ হয়ে বিদেশে যেতে পারবে শ্রমিকরা। এতে বাংলাদেশে রেমিটেন্সের হার বাড়বে। বলা হচ্ছেÑ উন্নত যেসব দেশ বাংলাদেশ থেকে দক্ষ কর্মী নিতে চায়, সেসব দেশের চাহিদাকে গুরুত্ব দিয়ে আরও ১৫টি নবনির্মিত কারিগরি প্রশিক্ষণকেন্দ্রে প্রশিক্ষণ কার্যক্রম খুব শীঘ্রর শুরু হবে। অধিক হারে দক্ষ জনশক্তি তৈরির লক্ষ্যে উপজেলা পর্যায়ে ৪৩৯টি কারিগরি প্রশিক্ষণকেন্দ্র স্থাপনের সিদ্ধান্ত হয়েছে। প্রথম পর্যায়ে ‘৪০টি উপজেলায় ৪০টি কারিগরি প্রশিক্ষণকেন্দ্র এবং চট্টগ্রাম জেলায় একটি ইনস্টিটিউট অব মেরিন টেকনোলজি স্থাপন’ শীর্ষক প্রকল্পের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। কারিগরি প্রশিক্ষণকেন্দ্রের প্রশিক্ষণের মান আন্তর্জাতিক পর্যায়ে উন্নীত করতে কয়েকটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি হয়েছে। দুখঃজনক হলেও সত্য প্রবাসী শ্রমিকদের পাঠানো রেমিটেন্স দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখলেও তাদের কল্যাণে তেমন পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। ৪৫ বছর পর প্রবাসীদের কল্যাণে ‘প্রবাসীকল্যাণ বোর্ড’ গঠনের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। প্রবাসী কর্মীদের জন্য প্রবাস বীমার পাশাপাশি পরিবারের সদস্যদের স্বাস্থ্য ও চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করতে বিশেষায়িত হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার, সন্তানদের পড়ালেখার সুবিধার্থে দেশে আবাসিক স্কুল ও কলেজ প্রতিষ্ঠা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিদ্যমান কোটার সংখ্যা বৃদ্ধিসহ আবাসন ব্যবস্থার বিষয়টি ভাবনায় আনা দরকার। প্রত্যাশা থাকবে, প্রশিক্ষিত শ্রমশক্তি তৈরির লক্ষ্যে ব্যাপক হারে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা জরুরী। একই সঙ্গে প্রবাসীদের সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর পাশাপাশি বিদেশগামী কর্মীদের বিমানবন্দরে হয়রানি, ভোগান্তি, দীর্ঘসূত্রিতা বন্ধে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করা জরুরী। বিদেশগামীদের সঙ্গে বহির্গমন ছাড়পত্র প্রদান কার্যক্রমকে বিকেন্দ্রীকরণ করা দরকার। ঢাকার পাশাপাশি চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, সিলেট, কুমিল্লা রংপুর ও যশোর থেকে বিদেশগামী কর্মীদের ফিঙ্গার প্রিন্ট নেয়ার কার্যক্রম জোরদার করা দরকার। পাশাপাশি এ ছাড়া অসুস্থ, বয়স্ক, বৃদ্ধ মৃতকর্মী ও তাদের পরিবারের সেবা প্রদানে চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে পর্যাপ্ত এ্যাম্বুলেন্স সার্ভিসের ব্যবস্থা করা দরকার। এসব বিষয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা ও নেতৃত্বে বাস্তবায়ন হলে এই খাতে গতি ফিরে আসবে। বাড়বে দেশে রেমিটেন্স প্রবাহ। লেখক : সাংবাদিক [email protected]
×