ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

আমরা যেন ভুলে না যাই হরিপদ কাপালীকে

প্রকাশিত: ০৭:০৮, ৯ জুলাই ২০১৭

আমরা যেন ভুলে না যাই হরিপদ কাপালীকে

সারাদেশে সাড়া জাগানো হরিধানের উদ্ভাবক হরিপদ কাপালী আর নেই। ঝিনাইদহের এই মডেল কৃষক বুধবার মধ্যরাতে আসাননগর গ্রামে বার্ধক্যজনিত কারণে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৯৫ বছর। ঝিনাইদহের সাধুহাটি ইউনিয়নের আসাননগরে জন্ম নেয়া হরিপদ কাপালীর জন্ম ১৯২২ সালে। দারিদ্রের কারণে প্রথম শ্রেণীর পর আর স্কুলে বারান্দা মাড়ানোর সুযোগ হয়নি। ১৩ বছর বয়সে বাবাকে হারানোর পর তার রেখে যাওয়া ২ বিঘা জমিতে চাষাবাদ করে সংসারের হাল ধরেন তিনি। ১৭ বছর বয়সে নিজ গ্রামের মেয়ে সুনীতি রানীকে বিয়ে করলেও সারাজীবন নিঃসন্তান ছিলেন তিনি। তবে ওই দম্পতি পালক নিয়েছিলেন রূপকুমার নামে এক বালককে। ছোটবেলা থেকে বিভিন্ন সময় নানা ধান নিয়ে গবেষণা করেছেন হরিপদ। নতুন কোন ধান দেখলেই তা নিয়ে আলাদা করে ভেবেছেন। তার বিশ্বাস ছিল এমন করেই তিনি হয়ত পেয়ে যাবেন নতুন কিছু। অবশেষে তাই হলো। সাত-আট বছর আগে বিআর-১১ ধানের ক্ষেতে আগাছা পরিষ্কার করতে গিয়ে দেখেন একগোছা ধান অন্য ধানের চেয়ে একটু আলাদাভাবে বেড়ে উঠছে। অনুসন্ধিৎসু হরির মনে হলো এটা বিশেষ কোন ধান। তিনি চোখে চোখে রেখে বিশেষ যতেœ বড় করলেন এই গোছাটিকে। মৌসুম শেষে দেখলেন এটি সত্যিই অন্যগুলোর চেয়ে আলাদা। এই বিশেষ গোছার ২০০ থেকে ৩০০ গ্রাম ধান পরের বছর স্বর্ণা ধানের সঙ্গে আলাদা করে চাষ করলেন তিনি। মৌসুম শেষে দেখলেন এবারও অভাবনীয় ফলন। এবার আর বুঝতে অসুবিধা হলো না এটি সত্যিই বিশেষ কোন ধান। তার পরের বছর সব ধান ১০ কাঠা জমিতে রোপণ করলে অভাবনীয় ফসল পান হরি। মাঠের সবচেয়ে উঁচু স্বাস্থ্যবান ক্ষেতের দিকে চোখ পড়ে গ্রামবাসীর। সবাই হরিপদের ঘরে হুমড়ি খেয়ে পড়ে নতুন প্রজাতির এই ধান বীজের জন্য। এভাবেই আশপাশের গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে বিশেষ এই ধান। সৃষ্টি তো অদম্য উৎসাহী হরিপদ কাপালীর নামেই দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ল হরিধানের বিস্তৃতি। ঝিনাইদহে ২০০৬-এর আমন মৌসুমে কৃষি বিজ্ঞানীরা প্রতিটি প্লট থেকে সাড়ে সাত সেন্টিমিটার জায়গার ধান কেটে তা ওজন দিয়ে দেখেন, প্রতি হেক্টরে হরিধানের ফলন হয়েছে পাঁচ দশমিক পাঁচ টন। আর অন্য জাতের ধান হয়েছে পাঁচ দশমিক দুই টন। প্রান্তিক কৃষক হরিপদ কাপালী স্কুলের বারান্দায় পা না দিলেও জ্ঞান সাধনায় তিনি অর্জন করেছিলেন শিক্ষার চেয়ে অনেক বেশি কিছু। তাঁর নামের সঙ্গে মিল রেখে তার আবিষ্কৃত ধানের নাম রাখা হয় হরিধান। এর চেয়ে বড় প্রাপ্তি একজন কৃষকের আর কি থাকতে পারে? ১৯৯৯ সালে হরিপদ কাপালীর নামের সঙ্গে মিল রেখে এই ধানের নামকরণ করা হয় ‘হরিধান’। এটি বিশেষ জাতের উচ্চফলনশীল ধান। যা গোটা দেশে সাড়া জাগায়। বাংলার কৃষকরা যে প্রকৃতি বিজ্ঞানী হরি কাপালীই তাঁর বড় প্রমাণ। হরি ধানের গোছা বেশ পুষ্ট এবং গাছের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে বেশি। এ কারণেই বিশেষ জাতের উচ্চফলনশীল ধানের আবিষ্কারক কৃষক বিজ্ঞানী হরিপদ কাপালী। তার আবিষ্কৃত ধান ঝিনাইদহ জেলার অনেক জমিতে এখন এই ধান চাষ হচ্ছে। বিঘাপ্রতি ফলন ১৮ থেকে ২০ মণ। ২০০২ সালে তার এই উদ্ভাবনের খবর সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হলে হৈচৈ পড়ে যায় দেশে। সরকারীভাবে হরিধানের স্বীকৃতির পাশাপাশি তিনি চ্যানেল আই কৃষি পদকও লাভ করেন। এ ছাড়াও তিনি বিভিন্ন সংগঠন থেকে অন্তত ১৬টি পদক পান। এক সাক্ষাতকারে হরিপদ কাপালী বলেছিলেন- হরিধান নাম দিয়েছে লোকজন। আমান নামে ধানের নাম শুনতে বেশ ভাল লাগে। মনে হচ্ছে এই ধানটা আমি সৃষ্টি করলাম। কৃষি বিভাগের লোকজন বাড়িতে আসছেন। দামী-দামী গাড়িতে করে তারা যখন আসছেন, তখন নিজের মধ্যে গর্ববোধ হচ্ছে। মনে হচ্ছে পাড়া গাঁয়ের অশিক্ষিত হরিকে আজ সবাই চিনে ফেলেছে। তাছাড়া বিভিন্ন গ্রাম থেকে কৃষকরা বীজের জন্য এসে হরি লোকটি কে তার খোঁজ করছেন। এটাও আমাকে খুব আনন্দ দিচ্ছে। আমাদের কোন ছেলে-মেয়ে নেই। এখন মনে হচ্ছে হরিধানটি আমাদের জীবনের আশীর্বাদ হয়ে এসেছে। এই ধান আমার মনের সব কষ্ট দূর করে দিয়েছে। ধানটি যে জাতেরই হোক কৃষকের দেয়া নামটি যেন থাকে। আমার বংশে যেহেতু কেউ নেই তাই হরিধানের মাধ্যমেই আমি বেঁচে থাকতে চাই। আমরাও চাই হরিপদ কাপালী বেঁচে থাকুন হরিধানের নামের মাঝেই।
×