ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

সুমন্ত গুপ্ত

সম্মুখে শান্তি পারাবার, ভাসাও তরণী হে কর্ণধার ...

প্রকাশিত: ০৬:৩৭, ৬ জুলাই ২০১৭

সম্মুখে শান্তি পারাবার, ভাসাও তরণী হে কর্ণধার ...

জন্ম নিলে চলে যেতে হয় বুঝি! এমন নির্মম সত্য জেনেও আমরা আগামীর পথে হাঁটি, কারণ চলতে হয়। এটাই বোধহয় জীবনের নিয়ম। জীবন তো ছুটে চলে বহতা নদীর মতো। ঠিক তেমনি ছুটে চলতেন বিশিষ্ট সঙ্গীত গবেষক ও অধ্যাপক ড. করুণাময় গোস্বামী। প্রচারবিমুখ এই গুণী নিভৃতে কাজ করে গেছেন। গবেষণা ছিল তার অস্থি মজ্জায় তাই ঘর ও ছেড়েছেন দু’বার। বাংলা সাহিত্য ও সঙ্গীত অঙ্গনের দুই কাণ্ডারি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আর নজরুল ইসলামকে নিয়ে কাজ করে গেছেন আমৃত্যু। গত ৩০ সে জুন শুক্রবার দিবাগত রাতে একুশে পদকপ্রাপ্ত দেশের কৃতী সন্তান করুণাময় গোস্বামী চলে গেলেন না ফেরার দেশে। নজরুল জীবন সাহিত্য ও সঙ্গীত চর্চায় তার অবদান ব্যাপক। শুদ্ধবাণী ও সুরে নজরুল সঙ্গীত প্রচার ও প্রকাশের সঙ্গে তিনি যুক্ত ছিলেন। তিনি চাইতেন নজরুল গানের বাণী ও সুর যেন অবিকৃত থাকে। তিনি নজরুলের অনাবিষ্কৃত পাণ্ডুলিপির খোঁজে ভারত পাকিস্তান এবং ইংল্যান্ডে গিয়েছিলেন। নজরুল জন্মশতবর্ষে নানা অনুষ্ঠান ও আলোচনায় তিনি যুক্ত ছিলেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের প্রতি তিনি ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ। অসাম্প্রদায়িক চেতনার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত ড. করুণাময় গোস্বামীর জন্ম ১৯৪৩ সালের ১১ মার্চ ময়মনসিংহের গোসাই চান্দুরা গ্রামে। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজী সাহিত্যে ১৯৬৪ সালে এমএ এবং ১৯৮৮ সালে ‘বাংলা কাব্যগীতির ধারায় কাজী নজরুল ইসলামের স্থান’ শীর্ষক গবেষণা কর্মের জন্য পিএইচডি অর্জন করেন। ১৯৬৪ সালে তিনি সরকারী কলেজে প্রভাষক হিসেবে শিক্ষকতায় যোগদান করেন এবং ২০০১ সালে অধ্যক্ষ হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন। জীবনের শেষদিকে বেসরকারী কেমব্রিয়ান কলেজে অধ্যক্ষ ছিলেন। তিনি ২০০৮ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার এবং ২০১২ সালে বাংলাদেশ সরকারের একুশে পদক লাভ করেন। দেশে ও দেশের বাইরে তিনি বাংলা গানের ইতিহাস, রবীন্দ্রসঙ্গীত ও নজরুল সঙ্গীত সম্পর্কে অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন লেখার জন্য সুপরিচিত। সঙ্গীত বিষয়ে অভিধান, সঙ্গীত কোষ তার এক অনবদ্য সৃষ্টি। বইটি লিখতে তার সময় লেগেছিল সাড়ে ৭ বছর। সম্প্রতি তার লেখা ‘দি আর্ট অফ ট্যাগর সং’ নামে একটি বই সারা বিশ্বের ১২শ’ লাইব্রেরিতে স্থান পেয়েছে। দুই বাংলায় একই সঙ্গে নজরুল ও রবীন্দ্র গবেষক হিসেবে আর দ্বিতীয়জন নেই। তার অসমাপ্ত বইয়ের সংখ্যা প্রায় ৫টি। তার সর্বশেষ প্রকাশিত উপন্যাস ‘লাহোরের রহিম শেখ।’ তার এ যাবত প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ৬৮। তিনি শিক্ষকতা পেশায় ৫০ বছরের অধিক সময়ে কর্মরত ছিলেন। ইংরেজী ভাষার একজন শিক্ষক হিসেবে তিনি বিদেশী ভাষার সঙ্গে বাংলাভাষার কবিদের চরিত্র বিলক্ষণ বুঝতে পারতেন এবং আলোচনায় ব্রতী হতেন। জ্ঞানান্বেষা ও শিক্ষাব্রতী এই মানুষটি আজীবন শিক্ষকতা করেছেন। কোন হীনমানসিকতা তাকে কখনও আবিষ্ট করেনি। দলকানা বুদ্ধিজীবী তিনি ছিলেন না। ব্যক্তিত্ব বিসর্জন দিয়ে প্রাপ্তির বিপক্ষে দাঁড়াতেন। সত্য মুখের ওপর বলার একটা অদম্য সাহস ছিল তার। ভাল না লাগলে যত লোভনীয় হোক তিনি সেই স্থান ত্যাগ করতেন এমনকি পদটির ছেড়ে দিতেন। ইংরেজীতে নজরুলের একটা ছোট্ট অথচ গুরুত্বপূর্ণ জীবনী তিনি রচনা করেছেন। সঙ্গীত গবেষক করুণাময় গোস্বামীর মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার মৃত্যুতে সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে শোকের ছায়া নেমে আসে। বিশিষ্ট নজরুল সঙ্গীতশিল্পী এবং নজরুল গবেষক সুজিত মোস্তফা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বলেন ‘বাংলাদেশে অনেককে নিয়ে মাতামাতি অনেক সময় অত্যধিক হয়, আবার অনেক সময় নীরবে নিভৃতে চলে যান অনেক প্রকৃত লেজেন্ড যারা অন্তর্মুখী স্বভাবের কারণে হয়ত প্রাপ্য স্বীকৃতির কিছুই পান না। গতকাল রাতে আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন শ্রী করুণাময় গোস্বামী। উপমহাদেশীয় সঙ্গীতের প্রায় সব শাখা সম্বন্ধেই এই মানুষটির ছিল প্রগাঢ় জ্ঞাণ। নিজেকে প্রকাশের কোন তাগিদ তার মধ্যে কখনও দেখিনি, অথচ এই মানুষটার সঙ্গে খানিক বসলেই শিল্প, সমাজ, সংস্কৃতির কত অদেখা ভুবনের কথা জানা হতো মুহূর্ত। আমার জানা মতে রাষ্ট্র তাকে কোন স্বীকৃতি দেয়নি। কি অবাক ব্যাপার। একুশে বা স্বাধীনতা পদক যে কোন একটি ওই পদকের মানই আরও বাড়িয়ে দিত। আমি সৌভাগ্যবান যে কাকার স্নেহধন্য হতে পেরেছিলাম। তার আত্মার শান্তি কামনা করছি গভীর শ্রদ্ধায়।’ করুণাময় গোস্বামীর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থসমূহ হচ্ছে - সঙ্গীত কোষ, বাংলা গানের বিবর্তন ১ম খণ্ড, বাংলা গান স্বরলিপি-ইতিহাস, বুদ্ধদেব বসু ও অন্যান্য, রবীন্দ্রসঙ্গীত পরিক্রমা, (নব আনন্দে জাগো) রবীন্দ্রসঙ্গীত স্বরলিপি-প্রথম খণ্ড, রবীন্দ্রসঙ্গীত স্বরলিপি-দ্বিতীয় খণ্ড, নজরুল গীতি প্রসঙ্গ, রবীন্দ্র নাট্যসঙ্গীত, আব্বাসউদ্দিন, অতুল প্রসাদের গান, রবীন্দ্রনাথ হান্টিংটন ও ভারতভাগ, বাংলাদেশের উচ্চাঙ্গসঙ্গীত চর্চা ও গুণীজন, বাংলা গানের বর্তমান ও আরও, ভারত ভাগের অশ্রু কণা, রবীন্দ্রসঙ্গীতকলা-২য়, কিশোর সঙ্গীত, বাংলাগানের কথা, নজরুল সঙ্গীত জনপ্রিয়তার স্বরূপ সন্ধান, বাংলা কাব্যগীতির ধারায় কাজী নজরুল ইসলামের স্থান ইত্যাদি।
×