ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

টি ইসলাম তারিক

আমি ভাগ্যবান ॥ ফখর জামান

প্রকাশিত: ০৬:৪২, ৫ জুলাই ২০১৭

আমি ভাগ্যবান ॥ ফখর জামান

কোন প্রশংসাবাণীই যথেষ্ট নয়। ফখর জামান রাতারাতি তারকা বনে গেছেন। বাঁহাতি এই ব্যাটসম্যান সদ্য শেষ হওয়া চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে মনোমুগ্ধকর ব্যাটিং করে পাকিস্তানকে শিরোপা জেতাতে রেখেছেন অগ্রণী ভূমিকা। ফাইনালের এই সেরা খেলোয়াড়ের ব্যাটিং তা-বেই উড়ে যায় ভারত। ক্রিকেটবিশ্ব এখন তাই ফখরের গুণগাণে ব্যস্ত। ওয়ানডে ক্রিকেট ফকরের অভিষেক হয়েছে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে, দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে গ্রুপ ম্যাচে। ক্যারিয়ারের প্রথম ওয়ানডেতে সুযোগটা খুব ভালভাবে কাজে লাগাতে পারেননি। তবে ৩০ বলে ৩১ রানের একটি ইনিংস খেলে নিজের জাতটা চেনান। অবশ্য শ্রীলঙ্কা ও ইংলান্ডের বিরুদ্ধে পরের দুই ম্যাচে দারুণ দুটি হাফ সেঞ্চুরি করে তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন ভাল কিছু করার ক্ষমতা রাখেন। আর ফাইনালে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ভারতের বিরুদ্ধে দারুণ একটি সেঞ্চুরি করে নির্বাচকদের আস্থার প্রতিদানটা ভালভাবেই দিয়েছেন। অথচ চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে পাকিস্তানের শিরোপা জয়ের অন্যতম নায়ক ফখরের ক্রিকেটে আসার গল্পটা আর-দশজনের মতো নয়। পাকিস্তানের পিছিয়ে থাকা একটি শহর খাইবার পাখতুনখায়ার একটি দরিদ্র পরিবারে জন্ম নেন তিনি। পড়ালেখায়ও খুব বেশি দূর এগোতে পারেননি। জীবনের তাগিদে যোগ দেন দেশটির নৌবাহিনীতে। কিন্তু ক্রিকেটের প্রতি ছিল তার দারুণ ভালবাসা, যেখানেই গেছেন ক্রিকেট খেলাটা চালিয়ে গেছেন। ক্রিকেটের প্রতি দারুণ ভালবাসার কারণে ২০১৩ সালে নৌবাহিনী ছেড়ে পাকাপাকিভাবে ক্রিকেটে মনোযোগী হন ফখর। সে বছরই পাকিস্তানের ঘরোয়া ক্রিকেটে অভিষেক হয় করাচী বুলসের হয়ে। পাকিস্তানের অন্যতম মার্যাদাপূর্ণ টুর্নামেন্ট কায়েদ-এ আজম ট্রফিতে অভিষেকে দারুণ একটি সেঞ্চুরি করে নিজেকে ভালভাবে জানিয়েছেন। ২৭ বছর বয়সে পাকিস্তান জাতীয় দলে সুযোগ পেয়ে বুঝিয়ে দিয়েছেন এই পর্যায়ের ক্রিকেটে খেলার জন্য ফখর যথেষ্টই যোগ্য। চার ইনিংসে ৬৩ গড়ে মোট ২৫২ রান করে ফখর শুধু নিজের দলের সাফল্যে অবদান রাখেননি, নিজেকে নিয়ে গেছেন অন্য এক উচ্চতায়। তার অন্যতম সাফল্যে পাকিস্তানের ক্রিকেট যেন নতুন করে আলোর মুখ দেখেছে। প্রথম কোন টুর্নামেন্টে খেলতে নেমেই বাজিমাত করেছেন ফখর। নিজেকে বিশ্বক্রিকেটে চিনিয়ে দিয়েছেন আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির ফাইনালের মতো বড় মঞ্চে সেঞ্চুরি করেছেন। আবার চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী দল ভারতের বিরুদ্ধে। লন্ডনের কেনিংটন ওভালে শেষ পর্যন্ত ১০৬ বলে ১২ চার ও ৩ ছক্কায় ১১৪ রান করে আউট হন জামান। প্রথমবার কোন আইসিসির টুর্নামেন্ট খেলতে নেমে শুধু নিজেকে চিনিয়েছেন এমন নয়। এমন ব্যাটিংই করেছেন, চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে পাকিস্তানী ব্যাটসম্যানদের মধ্যে সর্বোচ্চ রানও তার। এক চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে এর আগে ২০০০ সালে ওপেনার সাঈদ আনোয়ার (২০৯) সর্বোচ্চ রানটি করেছিলেন। এবার সাঈদ আনোয়ারকে আজহার আলী (২২৮) ছাড়িয়ে যান। এক চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে সর্বোচ্চ রান করেন। আজহারকেও ছাড়িয়ে যান জামান। ৪ ম্যাচ খেলে ৬৩ গড়ে ২৫২ রান করেন জামান। চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতেই ফখরের অভিষেক। প্রথম ম্যাচটি গ্রুপ পর্বে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে খেলেন। সেই থেকেই শুরু হয় জামানের ব্যাটিং ঝলক। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ৩১ রান করেন। এরপর গ্রুপ পর্বে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে হাফ সেঞ্চুরিই (৫০) করে ফেলেন। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সেমিফাইনাল ম্যাচটিতেও তার দারুণ ভূমিকা থাকে। ব্যাট হাতে ৫৭ রান করেন জামান। তখনই বোঝা হয়ে যায়, ফাইনালে প্রতিপক্ষ যে দলই থাকুক, জামান গুরুত্বপূর্ণ একজন ব্যাটসম্যান হয়ে উঠতে পারেন। সেটাই তিনি করে দেখান। প্রথম টুর্নামেন্ট খেলতে নেমেই সেঞ্চুরি পেয়েছেন। চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে এর আগে সাঈদ আনোয়ার ও শোয়েব মালিক সেঞ্চুরি করেছিলেন। সাঈদ আনোয়ার প্রথম সেঞ্চুরি করেন। ২০০০ সালে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে অপরাজিত ১০৫ ও নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ১০৪ রান করেছিলেন। টানা দুই ম্যাচে সেঞ্চুরি করেছিলেন। এরপর ২০০৯ সালে ভারতের বিপক্ষে ১২৮ রানের ইনিংস খেলেছিলেন শোয়েব মালিক। পাকিস্তানের তৃতীয় ব্যাটসম্যান হিসেবে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে সেঞ্চুরি করেছেন ফখর। ভারতের বিরুদ্ধে গ্রুপ পর্বের প্রথম ম্যাচটি খেলেননি। খেললে হয়তো, রান আরও বেশি হতো জামানের। ফাইনাল ম্যাচে চাপহীন থেকে খেলবে যে, সফল হবে সে। এমন মন্ত্রই দুই দলের ক্রিকেটারদের মধ্যে ছিল। ফখর যেন কোন চাপই নেননি! নিজের খেলাটাই খেলে যান। সাধারণ ব্যাটিং করেন। কিন্তু সেই সাধারণ ব্যাটিংই তাকে অসাধারণ করে দিয়েছে। ফাইনাল ম্যাচে সেঞ্চুরি করা মানে বিশ্বক্রিকেটে নিজেকে তুলে ধরা। নতুন ক্রিকেটার হলে তো কথাই নেই। ফখর তাই করে দেখিয়েছেন। ফাইনালে শুরুতে অবশ্য ফখর একেবারেই স্লো খেলতে থাকেন। ৭ বলে যখন তার স্কোরবোর্ডে ৩ রান, তখন অবশ্য ‘নতুন জীবন’ পান। বুমরাহর বলে ধোনির হাতে ক্যাচ আউট হন। অফ স্ট্যাম্পের বাইরের বল খেলতে গিয়ে আউট হন। কিন্তু বলটি ‘নো’ বল হয়। তাতে বেঁচে যান জামান। ‘নতুন জীবন’ পেয়ে নিজেকে পুরোপুরি মেলে ধরেন। চার ছক্কা হাঁকানো শুরু করে দেন। কোন বোলারকেই আর পাত্তা দেন না। শুরুতে যে খানিক চাপ ছিল তা বোঝাও গেছে। কিন্তু পরে নিজেকে সামলে নেন। ৬০ বলে ৫০ রান করেন। ফখর যেন ভারতীয় ক্রিকেটারদের পাগল বানিয়ে ফেলেন। কোনভাবেই জামানকে আউট করতে পারছিলেন না। রবিচন্দ্রন অশ্বিনের করা ৩১তম ওভারের প্রথম বলে সুইপ করে বাউন্ডারি হাঁকিয়ে ৯২ বলে ক্যারিয়ারের প্রথম সেঞ্চুরিটি করেন জামান। অথচ ফাইনালে তার খেলারই কথা ছিল না। আগের দিন অসুস্থ বোধ করছিলেন। খেলতে পারবেন না ভেবে বিষণœ মনে টিম হোটেলে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন। দলের ফিজিও এসে পিঠে হাত রেখে দিয়েছেন ম্যাচের সকালেই সেরে ওঠার আশ্বাস। ফিজিওর কথাই সত্যি হয়েছে। সুস্থতা নিয়েই ঘুম ভেঙ্গেছিল ফখরের। এ জন্য অবশ্য ভাগ্যও সহায় ছিল তার। বুমরাহর বলে আউট হলেও সেটা ছিল ‘নো’। আউট হওয়ার বদলে ‘ফ্রি হিট’ পেয়ে যান ফখর। এটিকে ভাগ্য বলে মানছেন তিনি। ফখর বলেন, ‘আমি ভাগ্যবান ছিলাম যে বলটি নো ছিল। ভারতের বিরুদ্ধে ফাইনাল। আমি শুধু উপভোগ করতে চেয়েছি।’ ভাগ্যের ছোঁয়ায় ‘জীবন’ ফিরে পাওয়ার সুযোগটা দুই হাত ভরে নিয়েছেন ফখর। আজহার আলীকে সঙ্গে নিয়ে ওপেনিংয়ে ১২৮ রানের জুটি গড়ে পাকিস্তানকে বড় স্কোরের ভিত গড়ে দেন। অথচ চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির আগে ফখরকে কজনই বা চিনতেন। চলতি বছরের মার্চে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে টি২০ দিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তার আবির্ভাব। কিন্তু নিজেকে চেনানোর মতো কিছু করতে পারেননি তখন। দুই ইনিংসে করেছিলেন ২৬ রান। চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে উঠতি তারকাদের তালিকায় তাকে রাখার লোক খুব বেশি ছিল না। নিজেদের প্রথম ম্যাচটি এই ভারতের বিপক্ষেই খেলেছে পাকিস্তান। কিন্তু একাদশে সুযোগ পাননি ফখর। ওই ম্যাচে আহমেদ শেহজাদের ব্যর্থতাই দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে সুযোগ করে দেয় ফখরকে।
×