ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৫ মে ২০২৪, ২২ বৈশাখ ১৪৩১

বিশ্বজিত রায়

বিপর্যস্ত হাওড়ে স্বস্তির নিশ্বাস

প্রকাশিত: ০৩:৫৭, ৩০ জুন ২০১৭

বিপর্যস্ত হাওড়ে স্বস্তির নিশ্বাস

হাওড়ে এখন পিনপতন নীরবতা। হিজল করচার সম্মুখঘেঁষা হাওড়ের স্বচ্ছ পানিতে মৃদু ঢেউয়ের মাতলামি দেখলে মনে হয় নিশ্চিন্তের খেলা খেলছে জলমগ্ন বিস্তৃত প্রান্তর। সর্বনাশী এই পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে কৃষকের প্রাণের খোড়াক কচি ধান। হাওড়ের নিস্তব্ধ প্রকৃতিও যেন আনন্দে আত্মহারা। সেখানে কখনও মেঘ, কখনও রোদ আবার কখনও রোদবৃষ্টিহীন আনমনা পরিবেশ। প্রকৃতির এই লীলা খেলায় বানভাসী মানুষের কপালে চিন্তার চিকন রেখা স্পষ্টতই ভেসে উঠেছে। হাওড় পারের অধিকাংশ মানুষের ঘরে ছিল না ঈদের আনন্দ। সর্বস্ব হারিয়ে অভাব অনটনে কাবু কর্মহীন মানুষ ছুটছে শহরে। অনেকে হাওড়ে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করছে। সবকিছু মিলে অভাবের এক নীরব বিপ্লব আঁচ করা যাচ্ছে। তারপরও মানুষের জীবনাচরণ দেখলে মনে হয় অভাব স্পর্শ করতে পারেনি কাউকে। হাতে হাতে দামী মোবাইল সেট। সেই বাক্সতে বাজছে মধুর সঙ্গীত। এক কথায় অভাব থাকলেও তার রেশ চেপে ধরে সাবলীল জীবনযাপন করছে হাওড়ের নির্ভেজাল মানুষগুলো। প্রকৃতি হাওড়ের সকলকে সর্বস্বান্ত করেছে। এটা বাস্তবতার নিরিখে সম্পূর্ণ সঠিক। কিন্তু সেই বিপর্যয় থেকে হাওড়কূলে যে মহামারী দেখা দেয়ার কথা ছিল তা হয়নি। সরকারের চাল বিতরণের গৃহীত পদক্ষেপ কিছুটা স্বস্তি এনে দিয়েছে। কেউ কেউ বলছেন, যদি সরকার এভাবে চাল বিতরণ না করত তাহলে এক শ’ টাকা কেজি দরে চাল কিনে খেতে হতো আমাদের। সুনামগঞ্জের ‘হাওড় বাঁচাও, সুনামগঞ্জ বাঁচাও আন্দোলন’ সংগঠনের আহ্বায়ক বলেন, ‘সরকারের বিশেষ সহায়তা হিসেবে প্রতিমাসে দেড় লাখ কৃষককে ৩০ কেজি চাল ও ৫০০ টাকা করে দেয়া হচ্ছে। সহায়তার বাইরে আছে আরও পৌনে দুই লাখ মানুষ।’ সংগঠন প্রধানের এ হিসাব মতে প্রায় অর্ধেকেরও বেশি কৃষক চাল সহযোগিতার বাইরে আছেন। কিন্তু আমার জন্মস্থান সুনামগঞ্জের জামালগঞ্জে বেহেলী ইউনিয়নের সার্বিক পরিস্থিতি দেখলে বোঝা যায়, গরিব-অসহায় মানুষজন ঠিকই চাল পাচ্ছেন। তবে তার পাশাপাশি সচ্ছল অনেক পরিবারও তাদের সঙ্গে এই উপকারভোগী হচ্ছেন। এছাড়া জনপ্রতিনিধিদের স্বজনপ্রীতির সংযোগে একই পরিবারের বাপ-বেটা চাল সংগ্রহ করে অন্যের প্রাপ্তিতে ব্যাঘাত সৃষ্টি করছেন। এ থেকে এমনটি প্রতীয়মান হয় যে, যদি চাল বণ্টনের সঠিক নিশ্চয়তা বজায় থাকত তাহলে অন্তত অসংখ্য অভাবী পরিবারের চাহিদা পূরণ হতো। বিপর্যস্ত হাওড় এলাকা পরিদর্শনে এসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘কোন মানুষ না খেয়ে মরবে না।’ প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী কাজও চলছে। হাওড়াঞ্চলের বাস্তব পরিস্থিতি দেখে মনে হয় হাওড় ডুবে এক হিসেবে ভালই হয়েছে। সেখানকার একশ্রেণীর দুর্গত মানুষ মোটামুটি স্বস্তিতে আছেন। পাশাপাশি দিন আনে দিন খায় এমন মানুষের ঘরে এখন স্বাচ্ছন্দ্যের সুর। অর্থাৎ বিভিন্ন কর্মসূচীর আওতায় যেভাবে চাল বিতরণ করা হচ্ছে তাতে হাওড়ের প্রত্যন্ত অঞ্চলের গরিব অসহায় শ্রেণীর মাঝে এক ধরনের বাড়তি সুখ বাসা বেঁধেছে। প্রায় প্রতি ঘরেই চাল মজুদ আছে। অসময়ে হাওড় তলিয়ে যাওয়া পরবর্তী পরিস্থিতি যে ভয়াবহ আকার ধারণ করার কথা ছিল তার বিপরীত বাস্তবতা এখন লক্ষণীয়। সরকারের জনবান্ধব কর্মসূচী নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবি রাখে। এক ফসলি হাওড় হিসেবে পরিচিত সুনামগঞ্জের ভাটির জনপদ অসময়ের অকাল বন্যায় ভেসে গেলেও এর বিপর্যস্ত রেশ এখন তেমন আর নেই। সবার মাঝে স্বস্তি দানা বাঁধতে শুরু করেছে। যে অঞ্চল মঙ্গা মড়কের মহামারীতে মুমূর্ষু হওয়ার কথা ছিল তা হয়নি। হাওড়াঞ্চলখ্যাত সুনামগঞ্জের ভাটি অঞ্চলে জন্ম হওয়ায় সুখ-দুঃখ দুটোরই অংশীদার হতে পারছি। তাই এখানকার মানুষের হাসিতে যেমন হাসতে পারছি তেমনি বেদনার অসহনীয় যন্ত্রণাও বার বার সজোরে ঝাঁপটে ধরেছে। ধানের শহর সুনামগঞ্জের অদূরে জামালগঞ্জ উপজেলাধীন বেহেলী ইউনিয়নের রহিমাপুরের নির্জন এলাকায় বেড়ে ওঠার অনেক স্মৃতি পিছু ডাকে। কৃষকপুত্র হিসেবে সেগুলো এড়িয়ে চলা আমার পক্ষে সম্ভব হয় না। তারপর সবকিছু পেছনে ফেলে বর্তমানকে নিয়ে ভাবতে হয়। শহরের পরিশ্রান্ত জীবন কাটিয়ে গ্রামের নিশ্চিন্ত পরিবেশে চলে আসায় এবারকার বন্যাকবলিত চৈত্রের চতুর্মুখী ছলচাতুরি একেবারে কাছ থেকে দেখা সম্ভব হয়েছে। কৃষকের দুর্দিনে দুর্নীতিবাজ শয়তান জনপ্রতিনিধিদের ভয়ে এলাকা ছেড়ে যেমন পালাতে দেখেছি তেমনি সরকারের চালবান্ধব নীতির পরিচ্ছন্ন প্রেক্ষাপটে চাষীগোত্রের বারোটা বাজানো সেই সস্তা জনপ্রতিনিধিদের ইউপি কার্যালয় কিংবা রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে নীতিভ্রষ্ট কথাবার্তা আওড়ানোর জোর তৎপরতাও কানে বাজছে। আবার অনেক ক্ষেত্রে এদের পায়ে হাতে ধরে চাল সংগ্রহের পাসপোর্ট অর্থাৎ টুকা পাওয়া সাধারণ মানুষের তৃপ্তির ত্যক্ত কথা শুনেও বেশ ভাল লাগে। প্রকৃতিবৈরিতা ও দুর্নীতির দাবানলে দহনকৃত মানুষ সরকারের দেয়া চাল সুবিধায় কতটা আত্মনির্ভরশীল ভরসাবন্ধনে আবদ্ধ হতে পেরেছে কিংবা ঘরে কয়েক মাসের খাদ্য মজুদ আমার লেখক মনে খোড়াক জুগিয়েছে। ফসলহারা এলাকায় বসে নিজ কর্ণে শোনা একটি তরতাজা গল্প না বললেই নয়। যেখানে নিহিত রয়েছে সরকারের জনবান্ধব নীতির উপকৃত উপমা। ছোটবেলা থেকেই গ্রাম্য এলাকায় কম-বেশি চুরির উপদ্রবের কথা শুনে আসছিলাম। এখনও মাঝে মধ্যে তা শোনা যায়। তেমনি একটি চুরির ঘটনা ঘটে আমাদের পাশের প্রতিবেশী কাঠমিস্ত্রি এক বড়ভাইয়ের ঘরে। একদিন পড়ন্ত বিকেলে চুরি হওয়া গৃহমালিক জ্যোতি সূত্রধরকে নিয়ে সড়কের পাশে বসে আড্ডা দেয়ার ফাঁকে ওই চুরি সম্পর্কিত বিষয়টি জানতে চাইলাম। রসবোধসম্পন্ন সদা হাস্যোজ্জ্বল মানুষটি শুরুতেই বলে ওঠেন, ‘ভাইরে ভাই আমারে এক্কেবারে ডাকাতি কইরালছে। আমার বউয়ে (স্ত্রী) সরকারের দেয়া চাউল আইন্না প্রায় দুই আড়াই মণ চাউল জামাইছিল। চোরের বাচ্চাইনতে সবডি চাউল লইয়া গেছে। যে চাউলডি আছিল প্রায় ছয় মাসের খোরাক হইয়া গেছিল আমার। কারবারটা কিতা করল। চাউলডি পাইয়া কয়েক মাসের লাইগ্গা নিশ্চিন্ত হইয়া গেছিলাম। কিন্তু চোরে দিল আমার বারোডা বাজাইয়া। সরকারে যেমন আমারে দিছে তেমন তারারেওতো দিছে। তারপরেও আমার ঘরডা খালি করল। এইডা কোন কথা হইল।’ সবশেষ তিনি অস্বস্তিসূচক যে বুলিটা তুলে ধরেছেন তার সারমর্ম যেমন অতৃপ্তিতে ভরপুর তেমনি অনুচ্ছেদের ভেতরগত বর্ণনায় রয়েছে সরকারের বিনামূল্যে চাল বিতরণের তুষ্টিদায়ক বিবরণ। কৌতূহলবশত তাকে আবার জিজ্ঞেস করলাম, সরকার তো প্রতিজনকে ৩৮ কেজি চাল আর ৫০০ টাকা করে দিচ্ছে, তাহলে তোমার এক শ’ কেজির ওপরে চাল হলো কিভাবে? প্রতিউত্তরে তিনি বললেন, ‘আরে বেডা দুই মাসের চাউল আর ১৫ টাকা কেজির চাউল যে আনছে, সবডি মিল্লাইতো হইছে।’ যাই হোক চুরি কাহিনীর ভেতরে যে সন্তোষজনক কথোপকথন উঠে এসেছে তাতে বোঝা যায় হাওড় এলাকার মানুষ মোটামুটি ভালই আছেন। তবে এর মাঝেও একটা প্রশ্ন থেকে যায়। চিহ্নিত কোন এলাকা কিংবা নির্দিষ্ট কারও কথায় পুরো হাওড়ের চিত্র বিবেচনা করা ঠিক নয়। দুই-চারজন মানুষের চাল প্রাপ্তি হয়ত সরকারের ভাল কাজের অনুকূলে যেতে পারে। কিন্তু অনেক অঞ্চল আছে যেখানে ন্যায্য প্রাপ্তি ও সরকারের বিনামূল্যের চাল বিতরণ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে সাধারণ মানুষ। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের কাছে ধরনা দিয়েও প্রাপ্য বুঝে পাচ্ছেন না অনেকে। এ নিয়ে শুরু হয়েছে স্বজনপ্রীতি। দেখা যাচ্ছে একই পরিবারের পিতাপুত্র দুজনেই চাল পাচ্ছে আবার অনেক ক্ষেত্রে কেউই পাচ্ছে না। এ নিয়ে কোন কোন ক্ষেত্রে স্থানীয় ইউপি সদস্যদের সঙ্গে এলাকার সচেতন মানুষের বাগ্বিত-া প্রকট আকার ধারণ করছে। দেখা দিচ্ছে মনমালিন্য। শুধু কোন কোন ইউপি সদস্যের অতিরিক্ত স্বজনপ্রীতির জন্য পথেঘাটে সৃষ্টি হচ্ছে এমন বচসা ভর্ৎসনা। হাওড় পারে দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে ঘোষণা দিয়েছিলেন তা ইতিবাচক। তিনি তার কথা রাখার যথাসাধ্য চেষ্টা করছেন। তবে কোন কোন ক্ষেত্রে ঘটছে এর ব্যতিক্রম। সরকারের চাল বিতরণ কর্মসূচী যেমন একদিকে স্বস্তি নিয়ে এসেছে তেমনি অন্যদিকে অস্বস্তির কথাও শোনা যাচ্ছে। চাল সহায়তায় নানা অনিয়ম ও চাল ঘাটতিসহ অনেক এলাকা চাল সহযোগিতার বাইরে থাকায় সরকারের কল্যাণপ্রসূত কর্মকা- অকল্যাণ ডেকে আনছে। শেখ হাসিনার চাল বিতরণ কর্মসূচীর সফল উদ্যোগে উপকারভোগী হওয়ার কথা সকল বিপর্যস্ত কৃষক পরিবার। কিন্তু হাওড়ের এক এলাকা চাল পাচ্ছে, অন্য এলাকার মানুষ অসহায়ের মতো অভাব যন্ত্রণা ভোগ করছেন সেটা সরকারের দ্বৈত নীতি বৈকি! এতে সরকারের ভাবমূর্তি বিনষ্ট হওয়ার উপক্রম। সরকার বার বার খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতার যে গল্প শুনিয়ে আসছিল তা অসারে পরিণত হচ্ছে। এখনও বানভাসী অনেক পরিবার সরকারের সহযোগিতার দিকে তাকিয়ে আছে। কি করলে কি হবে তা ভেবে পাচ্ছেন না দিশেহারা কৃষক শ্রেণী। বিপদসঙ্কুলতার পথে এগিয়ে যাওয়া এই মানুষগুলো সত্যিই অসহায়। তাদের পর্যাপ্ত সহযোগিতা প্রয়োজন। সরকারের চালবান্ধব কর্মসূচী ফসল অনিষ্ট কৃষকের ঘরে ঘরে পৌঁছে দিতে হবে। এক্ষেত্রে কোন গাফিলতি ও উদাসীনতা নেতিবাচক ফল বয়ে আনবে। সকালের খানা রাতে খেলে চলবে না। যে সময়ের যে ক্ষুধা নিবারণের প্রয়োজন সেই সময়ে সে ক্ষুধা নিবারণ করাটা বুদ্ধিমানের কাজ। হাওড়ের মানুষ এখন মারাত্মক সঙ্কটকাল অতিক্রম করছে। যথাসময়ে যথোপযুক্ত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। বাঁচাতে হবে হাওড়বাসীকে। মনে রাখবেন, হাওড় বাঁচলে বাঁচবে দেশ, অভাব অনটন হবে শেষ। সেই বিশ্বাস ও ভবিষ্যত পথ চলার কথা মাথায় রেখে অবশ্যই হাওড়ের প্রতি বিশেষ মনোযোগী হওয়া একান্ত প্রয়োজন। কৃষি ও কৃষকের মঙ্গল হোকÑ সেই প্রত্যাশা রইল শেখ হাসিনা সরকারের কাছে। লেখক : সাংবাদিক
×