ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বাহালুল মজনুন চুন্নু

জঙ্গীবাদের স্বরূপের সন্ধান এবং সমূলে উৎপাটনে করণীয়

প্রকাশিত: ০৬:৫২, ১১ জুন ২০১৭

জঙ্গীবাদের স্বরূপের সন্ধান এবং সমূলে উৎপাটনে করণীয়

জঙ্গীবাদী কর্মকাণ্ড কেন সংঘটিত হয়? মানুষ কেন জঙ্গী হয়ে ওঠে? এই প্রশ্নের উত্তর তথা কারণগুলো খুঁজে না পাওয়া অব্দি এই মানবতাবিরোধী ভয়াবহ সমস্যা কোনভাবেই নির্মূল করা সম্ভব নয়। এজন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে কার্যকারণ বিশ্লেষণ তথা উৎসের দিকে তাকানো। বিগত কয়েক দশক ধরেই এ নিয়ে বিশ্বব্যাপী সমাজবিজ্ঞানী থেকে শুরু করে নিরাপত্তাবিশ্লেষক, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, অপরাধবিজ্ঞানী, মনোবিজ্ঞানীগণ নানা গবেষণা ও কার্যকারণ বিশ্লেষণ করেছেন। বাংলাদেশে বিগত কয়েক দশক ধরে জঙ্গীবাদ, মৌলবাদের যে বিস্তার ঘটেছে এর কার্যকারণও বিশ্লেষণ করার প্রচেষ্টা চালিয়েছেন এদেশের বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা যে কারণগুলোকে উৎস হিসেবে চিহ্নিত করেছেন, যে কারণগুলোর জন্য মানুষের জঙ্গীবাদের দিকে ধাবিত হওয়ার কথা বলেছেন, সেগুলোকে সামষ্টিক ও ব্যষ্টিক দুই দিক থেকেই বিশ্লেষণ করা যায়। জঙ্গীবাদের ক্ষেত্রে সর্বাগ্রে আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটকে তথা বৈশ্বিক চালককে দায়ী করে থাকেন বিশ্লেষকরা। নোয়াম চমেস্কি, মাইকেল প্যারেন্টি, এরিক হবসবমের মতো তাত্ত্বিকগণ জঙ্গীবাদ ও সন্ত্রাসবাদের পেছনে সাম্রাজ্যবাদকে দায়ী করে থাকেন। সাম্রাজ্যবাদীরা নিজেদের ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করে রাখার জন্য এবং যুদ্ধ অর্থনীতির মাধ্যমে নিজেদের কোষাগারকে পরিপুষ্ট করার জন্য কৌশলে বিভিন্ন দেশে অর্ন্তদ্বন্দ্ব সৃষ্টি করতে জঙ্গীবাদী সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ডে অর্থায়নসহ নানা সাহায্য-সহযোগিতা করে থাকে, তার উদাহরণ বিশ্বজুড়ে অগণিত। সোভিয়েত ইউনিয়নের বিপক্ষে আমেরিকা ইসলামী মুজাহিদীনদের ব্যবহার করে। এই প্রসঙ্গে সোভিয়েত ও আফগানিস্তান যুদ্ধের কথা বলা যেতে পারে। ঐ যুদ্ধে মার্কিন সিআইএ ও পাকিস্তানের আইএসআই আফগান মুজাহিদীনদের জঙ্গি প্রশিক্ষণ দিয়েছিল। মার্কিন সরকার আফগান মুজাহিদীনদের পেছনে প্রায় তেপান্ন মিলিয়ন ডলার খরচ করেছিল সেই সময়টায়। শুধু তাই নয়, সেই মুজাহিদীনদের পরবর্তী প্রজš§কেও জঙ্গীবাদী শিক্ষায় দীক্ষিত করে তোলার জন্য আফগান স্কুল ও মাদ্রাসাগুলোতে সিলেবাস তৈরি করে দিয়েছিল মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। যেমন তখন ইংরেজী বর্ণমালা জে তে জেহাদ শেখানো হতো। আবার গণনা শেখানোর সময় পাঁচ বন্দুক যোগ পাঁচ বন্দুক সমান দশ বন্দুক শেখানো হতো। এভাবেই তারা জঙ্গীবাদের ভিতকে কৌশলে পাকাপোক্ত করে ফেলে ঐ অঞ্চলে। কী আশ্চর্য! আবার তারাই এর বিরুদ্ধে কথা বলে, মায়াকান্না করে দক্ষ অভিনেতার মতো। তাদের এই ডাবল স্ট্যান্ডার্ড গেম বিশ্ববাসীর কাছে উš§ুক্ত হয়ে যায় যখন মার্কিন সাবেক সেক্রেটারি অব স্টেট হিলারি ক্লিনটন বলেন, “আজকে আমরা যে আল কায়েদার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছি, কুড়ি বছর আগে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য আমরাই তাদেরকে সৃষ্টি করেছি, তাদেরকে অর্থ যুগিয়েছি।’ শুধু আল কায়েদা নয়, আজকের বিশ্বব্যাপী আইএস নামের যে বিষফোঁড়ার সৃষ্টি হয়েছে, তাও কিন্তু মার্কিন রাজনীতির বাইপ্রোডাক্ট। তারা সিরিয়ার আসাদ সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করতে আইএসকেই একদা অর্থ ও অস্ত্র দিয়ে সহযোগিতা করেছিল। আইএস আসলে পশ্চিমা বিশ্বের কাছে অতি প্রয়োজনীয় এমন এক শত্রু যাদের কল্যাণে পশ্চিমা বিশ্বের বহুমুখী স্বার্থোদ্ধার হয়। কিন্তু এখন সেই আইএসই বুমেরাং হয়ে পশ্চিমা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে হামলা চালাচ্ছে। প্রকৃত সত্য হলোÑশুধু আইএস নয়, সারা বিশ্বের, বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্য ও তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে অভ্যন্তরীণ যে জঙ্গীগোষ্ঠীগুলো সক্রিয় তাদের পরোক্ষ এবং কখনও কখনও প্রত্যক্ষ মদদ দিয়ে থাকে সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকা ও তাদের তাঁবেদার দালাল দেশগুলো। জঙ্গীবাদ সৃষ্টি ও মানুষের জঙ্গী হয়ে ওঠার পেছনে ধর্ম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ চালক হিসেবে কাজ করে। ইসলামের নামে সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদের উত্থানের পেছনে বিশ্বব্যাপী মুসলিমদের ওপর নির্বিচার অত্যাচার ও হত্যাযজ্ঞের বিষয়টি কাজ করে থাকে। ফিলিস্তিন, চেচনিয়া, ইরাক, কাশ্মীর, ফিলিপাইন, থাইল্যান্ড, মিয়ানমার, চীনসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মুসলমানদের বিরুদ্ধে নির্বিচারে জাতিগত নিধনযজ্ঞ চলছে বহুকাল ধরে; যার ফলে মুসলিম সম্প্রদায়ের মাঝে ক্ষোভ সঞ্চারিত হওয়াটাই স্বাভাবিক। বিভিন্ন মিডিয়ায় প্রকাশিত শিশু আয়লান ও ওমরানের ছবি তাদের ক্ষোভকে আরও চরম পর্যায়ে নিয়ে যায়। কিন্ত এই সমস্যা সমাধানের রাজনৈতিক, কূটনৈতিকসহ বিভিন্ন পথ খোলা থাকলেও সেদিকে ধাবিত না হয়ে অদম্য আবেগের বশবর্তী হয়ে প্রতিশোধ নিতে জঙ্গীবাদ নামক ভ্রান্ত পথের দিকে ধাবিত হচ্ছে কিছু মানুষ, যা কখনোই কাম্য হতে পারে না। কেননা ইসলাম কখনোই জঙ্গীবাদকে সমর্থন করে না। ইসলাম শান্তির ধর্ম। ইসলাম অন্যায়ের প্রতিবাদে অন্যায় করার অনুমতি যেমন দেয় না, তেমনি ইসলাম একের অপরাধে অন্যকে শান্তি প্রদানেরও অনুমতি দেয় না। কিন্তু মৌলবাদী গোষ্ঠী কর্তৃক প্রচারিত ইসলামের অপব্যাখ্যায় বিশ্বাস স্থাপন করে অনেকেই জঙ্গীবাদের দিকে ধাবিত হচ্ছে। অথচ বিদায় হজের ভাষণে মহানবী (স.) বলেছিলেন, ‘তোমরা ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করবে না।’ অথচ জঙ্গীবাদী কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে ধর্ম নিয়ে অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি করছে কিছু দিগভ্রান্ত মানুষ। জঙ্গীবাদের অন্যতম কারণ হিসেবে দারিদ্র্যকে দায়ী করেন অনেকেই। এরিস্টটল বলেছিলেন, দরিদ্রতা অপরাধ ও বিদ্রোহকে ত্বরান্বিত করে। এটা অবশ্যই একটা কারণ। গরিব ও সুযোগবঞ্চিত মানুষেরা বাঁচার অবলম্বন খোঁজে। বঞ্চনা, বৈষম্য ও অসহায়ত্ব তাদেরকে ধর্মাশ্রয়ী করে তোলে, যেটাকে পুঁজি করে মৌলবাদী গোষ্ঠী। মার্কস তাঁর শ্রেণীসংগ্রাম তত্ত্বে বলেছিলেন, প্রলেতারিয়েত শ্রেণী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে শ্রেণী থেকে উত্তোলিত হয়। আর এই দেশের ধর্মব্যবসায়ী স্বার্থান্বেষীরা গরিব ও সুযোগবঞ্চিত শ্রেণীকে ইহজাগতিক শ্রেণী থেকে উত্তোরণের পথ না দেখিয়ে আখিরাতে স্বর্গলাভের মাধ্যমে শ্রেণী থেকে উত্তোরণের পথ দেখিয়ে জঙ্গিতে রূপান্তরিত করার চেষ্টা চালায়। একথা সত্যি যে, আমাদের মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি পেয়েছে। সেই সঙ্গে কিন্তু বৃদ্ধি পেয়েছে ধন বৈষম্য। মোট আয়ের বেশিরভাগ সম্পদ কেন্দ্রীভূত হয়ে যাচ্ছে ধনিক শ্রেণীর হাতে। বাড়ছে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা। ফলে সমাজে হতাশা দানা বাঁধা স্বাভাবিক। ধর্মীয় জঙ্গী সংগঠনের শীর্ষ ব্যক্তিরা যারা সবাই ধনী, তারা বেকার ও গরিবের হতাশাকে পুঁজি করে ধর্মীয় উš§াদনা সৃষ্টির মাধ্যমে জঙ্গি তৈরির প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। জঙ্গীবাদের ক্ষেত্রে মগজ ধোলাই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক। মগজ ধোলাই বলতে মানুষের চিন্তা বা মানসিকতার এমন একটি গুণগত পরিবর্তনকে বোঝানো হয়, যেখানে আগের একটি চিন্তা বা দৃষ্টিভঙ্গি বা বিশেষ রাজনৈতিক মতাদর্শের জায়গায় নতুন একটি চিন্তা বা দৃষ্টিভঙ্গি কিংবা রাজনৈতিক মতাদর্শ প্রতিস্থাপিত হয়। এর মাধ্যমে ব্যক্তির অহং বা ইগোগত পরিবর্তন, ব্যক্তিত্ব পরিবর্তন ও চিন্তার পরিবর্তন ঘটে। পঞ্চাশের দশকে যেসব মার্কিন সৈনিক বন্দী হয়ে চীনের জেলখানায় গিয়েছিল, তারা কমিউনিস্ট ভাবধারায় বিশ্বাসী হয়ে পড়েছিল। এটা হয়েছিল মগজ ধোলাইয়ের কারণে। সূক্ষ্ম কৌশলে মানুষের মগজ ধোলাই করে মৌলবাদীরা তাদের জঙ্গিতে পরিণত করছে। এক্ষেত্রে তারা বিভিন্ন প্রচারপত্র, প্রশিক্ষণ মডিউল, তালিম, অর্থসহায়তা ইত্যাদি কৌশল অবলম্বন করছে। শিবিরীয় কায়দায় কোমলমতি তরুণদের ভাল আদর্শবাদী কথা বলে তাদের মনোজগতে স্থান করে নিয়ে তাদের বোঝাচ্ছে যে, জঙ্গী কার্যক্রমের মাধ্যমে খেলাফত কায়েম করে তারা সারা পৃথিবীতে শরিয়া আইন প্রতিষ্ঠা করতে পারবে। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, কেউ কেউ এসব আকাশকুসুম কল্পনা দ্বারা প্রভাবিত হয়ে জঙ্গীবাদের দিকে ঝুঁকছেও। কোন কোন তাত্ত্বিক জঙ্গীবাদ বিকাশে রাষ্ট্রীয় পরিস্থিতিকে দায়ী করেন। সমাজে যদি দুর্নীতি চরম আকার ধারণ করে, সর্বত্র নৈরাজ্য বিদ্যমান থাকে, বিচারহীনতার সংস্কৃতি যদি চালু থাকে কিংবা রাষ্ট্র কর্তৃক যদি জনগণ নিষ্পেষিত হতে থাকে তবে তা মানুষকে জঙ্গীবাদের দিকে ঠেলে দেয় বলে তারা মনে করেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো একই রকমের রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মাঝে সবাই জঙ্গী হয়ে ওঠে না। তাছাড়া বর্তমান সরকার ডিজিটালাইজেশনের মাধ্যমে বিভিন্ন ক্ষেত্রে দুর্নীতি কমিয়ে এনেছে। বিএনপি আমলে যেখানে পরপর পাঁচবার দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল বাংলাদেশ, এখন কিন্তু সেই অবস্থায় নেই বাংলাদেশ। সরকার কর্তৃক আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থার উন্নয়নের মাধ্যমে সমাজের নৈরাজ্যও অনেক কমিয়ে আনা হয়েছে। বিচার বিভাগ ও নির্বাহী বিভাগের পৃথকীকরণ বাস্তবায়নের মাধ্যমে এবং দ্রুত মামলা নিষ্পত্তিসহ বিভিন্ন কার্যক্রমের মাধ্যমে এদেশের মানুষকে ন্যায্য বিচার পাবার সুযোগ করে দিচ্ছে বর্তমান সরকার। তাছাড়া বঙ্গবন্ধুর প্রর্দশিত পথেÑ সবার জন্য সমান অধিকার নিশ্চিতকরণ এবং স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদী জনকল্যাণের জন্য নানা উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড বাস্তবায়নে কাজ করে যাচ্ছে সরকার। তাই রাষ্ট্রীয় কারণে মানুষজন জঙ্গীবাদের দিকে ধাবিত হচ্ছে, এই যুক্তি কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠে না। বরং বলা যায়, রাষ্ট্রীয় কারণের পরিবর্তে কয়েকটি রাজনৈতিক দলের স্বার্থান্বেষীতামূলক ক্রিয়াকলাপ জঙ্গীবাদের বিকাশে সহায়ক। উদাহরণ হিসেবে বিএনপি-জামায়াত জোটের কথা বলা যেতে পারে। সুইডিশ সাংবাদিক বারটিল লিন্টনার প্রণীত প্রতিবেদন থেকে জানা যায় যে, প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ভারতবিরোধী বলয়ের বিরোধী শক্তি আমেরিকার সঙ্গে সম্পর্ক জোরদারের জন্য মুজাহিদীনদের পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছিলেন, যা ছিল জঙ্গীবাদ সৃষ্টির প্রাথমিক ভিত্তি। পঁচাত্তর থেকে ছিয়ানব্বই সাল পর্যন্ত সময়কাল ছিল জঙ্গীবাদের ইনকিউবেশন পিরিয়ড আর পূর্ণ বিস্তারের সময়কাল বিএনপির দ্বিতীয় মেয়াদের শাসনামল। ঐ সময় এই দলটি জঙ্গী গোষ্ঠীগুলোকে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিকভাবে। জঙ্গী সংগঠন জেএমবির নেতা মওলানা শায়খ রহমান ও বাংলা ভাইয়ের সঙ্গে বিএনপির একাংশের এবং জামায়াতে ইসলামীর সম্পর্ক ছিল নিবিড়। কয়েকজন তো ছিল আবার জঙ্গীগোষ্ঠীর গডফাদার। উদাহরণ দিলে বিষয়টি স্পষ্ট হবে। তৎকালীন ভূমি উপমন্ত্রী রুহুল কুদ্দুস দুলুর বাসায় ২০০৪ সালের এপ্রিল মাসে শায়খ আবদুর রহমান ও বাংলা ভাই দলবল নিয়ে মিটিং করেন, তৎকালীন গৃহায়ন ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী আলমগীর কবির মোবাইলে শায়খ রহমান ও বাংলা ভাইয়ের সঙ্গে প্রায়শ কথা বলতেন, তৎকালীন মেয়র মিজানুর রহমান মিনুতো মাহাবুব নামের এক জঙ্গীর কাছে বাংলা ভাইয়ের জন্য চেকও দিয়েছিলেন! সাবেক সংসদ সদস্য নাদিম মোস্তফা পুঠিয়া থানার তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আমিনুল ইসলামের মাধ্যমে বাংলা ভাইকে টাকা দেন! এইসব তথ্য তখন জাতীয় সকল দৈনিকেই উঠে এসেছিল। এখনও জঙ্গীদের সঙ্গে তাদের যে যোগসাজশ আছে, তা তাদের নেতাদের কথাবার্তায় ফুটে ওঠে। স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস যখন সমাবেশে দাঁড়িয়ে বলেন, তাদের সমাবেশ করতে দিলে দেশে জঙ্গী থাকবে না, তখন আর কিছু অবোধ্য থাকে না। আর তাদের সহযোগী জামায়াত তো জঙ্গীদের প্রত্যক্ষ মদদদাতা। একটা বিষয় খুবই লক্ষণীয় যে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে যখন তাদের একের পর এক শীর্ষনেতার ফাঁসি হয়ে যাচ্ছিল তখনই কিন্তু জঙ্গীবাদ দানা বাঁধে। জামায়াত যে জঙ্গী লালন করে, তা স্পষ্ট হয়ে যায় উইকিলিকসে ফাঁস হওয়া এক তথ্যেও। তাদের শীর্ষনেতা আব্দুর রাজ্জাক আমেরিকার রাষ্ট্রদূত এফ মারিয়ার্টিকে বলেছিল, জামায়াত নেতাদের মৃত্যুদণ্ড দিলে শিবিরের জঙ্গী অংশকে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। ঘটেছেও কিন্তু তাই! বিভিন্ন এনজিও, দাতব্যসংস্থা থেকে শুরু করে বিভিন্ন ইসলামপন্থী প্রতিষ্ঠান, ব্যবসায়ী সংগঠন ও ব্যাংক প্রত্যক্ষভাবে জঙ্গীবাদ বিস্তারের সঙ্গে জড়িত। ড. আবুল বারাকাত তাঁর মৌলবাদের অর্থনীতি সংক্রান্ত গবেষণায় দেখিয়েছেন যে, মূল স্রোতের অর্থনীতিতে বার্ষিক প্রবৃদ্ধির হার যেখানে গড়ে ছয় থেকে সাত শতাংশ, সেখানে মৌলবাদের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির হার আট থেকে সাড়ে দশ শতাংশ। এদেশে মৌলবাদী আদর্শে পরিচালিত বিভিন্ন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক মুনাফা আড়াই হাজার কোটি টাকা। এই বিপুল পরিমাণ টাকা তারা জঙ্গী সৃষ্টি, প্রশিক্ষণ, অস্ত্র ও বোমা ক্রয়সহ জঙ্গীবাদ বিস্তারের কাজে ব্যয় করে থাকে। বিভিন্ন এনজিও ও দাতব্য সংস্থাকে তারা এক্ষেত্রে কাজে লাগায়, কেননা এরা প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষজনের কাছে পৌঁছাতে পারে। এরা গ্রামাঞ্চলের ধর্মভীরু ও গরিব মানুষদের মিথ্যে তথ্য এবং অর্থ দিয়ে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়ার ছল করে তাদের বিভ্রান্ত করে জঙ্গীবাদের দিকে নিয়ে যায়। জঙ্গীবাদের বিস্তারে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাও কম দায়ী নয়। আমাদের দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে মানবিক ও সামাজিক মূল্যবোধের শিক্ষা তেমনভাবে দেওয়া হয় না। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে গণতন্ত্রের চর্চা করা হয় না, তেমনভাবে হয় না সংস্কৃতির চর্চা। শুধু দেখানো হয় অর্থ উপার্জনের পথ। শিক্ষার্থীরা মানবিক গুণ সম্পন্ন মানুষ না হয়ে, গড়ে ওঠে অর্থ উপার্জনের যান্ত্রিক মানব হিসেবে। এই পরিস্থিতিকেই কাজে লাগাচ্ছে মৌলবাদী গোষ্ঠী। বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দিকে তাদের বিশেষ নজর। কেননা এসব প্রতিষ্ঠান নিজেরা যেমন শুধু অর্থ আয়ের কথাই চিন্তা করে, তেমনি তারা মানবিক মূল্যবোধহীন অর্থ উপার্জনের যান্ত্রিক মানুষই তৈরি করে। মাদ্রাসা কেন্দ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থার দিকে তাকালে দেখা যায়, এসব প্রতিষ্ঠান থেকে জঙ্গী যারা পাস করে বের হয় তারা খুব ভাল চাকরি পায় না, সামাজিকভাবে তেমন প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না; যা তাদের মাঝে হতাশা সৃষ্টি করে, যাকে কাজে লাগায় মৌলবাদীরা। এসব প্রতিষ্ঠানের কিছু কিছু শিক্ষক নিজেরা জঙ্গী দীক্ষায় দীক্ষিত হয়ে ছাত্র-ছাত্রীদেরকেও সেই পথে টেনে নেয়, যা বিভিন্ন গবেষণায় ওঠে এসেছে। তরুণ-তরুণীদের জঙ্গীবাদের দিকে ঝুঁকে পড়ার ক্ষেত্রে পরিবারও অনেক সময় দায়ী। পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধনের শিথিলতার কারণে উচ্চ শিক্ষিত ও উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানরা জঙ্গীবাদের দিকে ঝুঁকে পড়ছে। পরিবারের সবাই যার যার কাজ নিয়ে এত ব্যস্ত থাকে যে, তরুণ-তরুণীরা নিঃসঙ্গতায় ভোগে। এমনকি জীবনবোধ সংক্রান্ত হতাশা এমনভাবে তাদের আঁকড়ে ধরে যে, তাদের কাছে জীবন অর্থহীন হয়ে পড়ে। এই সুযোগকে কাজে লাগায় মৌলবাদীরা। তারা মগজ ধোলাইয়ের মাধ্যমে এই নিঃসঙ্গ ও হতাশ তরুণ-তরুণীদের জঙ্গীবাদে উদ্বুদ্ধ করে তোলে। পরিবার অনেক সময় ছেলেমেয়েদের সামাজিক মূল্যবোধ শেখায় না, নৈতিক শিক্ষাও দেয় না। বরং নেতিবাচক ভিনদেশীয় সংস্কৃতি পালনে উৎসাহিত করে। ভিনদেশী সংস্কৃতি লালনকে আভিজাত্য ধরে নিয়ে বলগাহীন জীবন কাটাতে কাটাতে একটা সময় ছেলে-মেয়ের মাঝে ক্লান্তি দানা বাধে। হতাশা ও ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। ব্যতিক্রমধর্মী কিছু করার প্রতি ঝোঁক সৃষ্টি হয় তাদের মাঝে; এই সুযোগটিকে কাজে লাগিয়ে তাদেরকে জঙ্গিতে রূপান্তরের প্রচেষ্টা চালায় মৌলবাদী গোষ্ঠী। অত্যাধিক বইয়ের ভারে ও মাঠ এবং নিরাপত্তার অভাবে খেলাধুলার সুযোগ পাচ্ছে না শিশু কিশোররা। স্কুল-কলেজ, বাড়ি, কম্পিউটার গেমসের মধ্যেই যেন সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ছে তাদের জীবন। ফলে একদিকে তাদের সঠিক সামাজিকীকরণ হচ্ছে না, অন্যদিকে তাদের জীবন হয়ে উঠছে একঘেয়ে, যার ফলে অ্যাডভেঞ্চারিজমের জন্যও কেউ কেউ জড়িয়ে পড়ছে জঙ্গী কর্মকাণ্ডে। জঙ্গীবাদে জড়িয়ে পড়া তথা জঙ্গী হওয়ার পেছনে বর্তমানে ইন্টারনেট ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে যা ইতোমধ্যে প্রমাণিত হয়েছে। তরুণ প্রজšে§র যারা জঙ্গীবাদে জড়িয়ে পড়ছে তাদের বেশিরভাগই উগ্রবাদী প্রচারণার শিকার। ইসলাম আক্রমণের বা বিপদের মুখোমুখি, নিজের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য হুমকির মুখে এমন সব প্রচারণার মাধ্যমে কোমলমতি তরুণ-তরুণীর মাঝে ক্ষোভের সঞ্চার হয়, যাকে কাজে লাগায় মৌলবাদীরা। এখন তো ছেলেমেয়েরা দশ-এগারো বছর বয়স হতেই ফেইসবুক, টুইটার, ব্লগসহ নানা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করছে। ফলে মৌলবাদী গোষ্ঠী সহজেই তাদের কাছে পৌঁছাতে পারছে, আর বিভিন্ন প্রপাগা-া, প্রচারণা চালিয়ে তাদেরকে জঙ্গীবাদে উদ্বুদ্ধ করছে; যার ভয়াবহ রুপ আমরা চাক্ষুস করেছি গুলশানের হলি আর্টজানের হামলার মধ্য দিয়ে। জঙ্গীবাদ সমূলে উৎপাটনে করণীয় চিরকাক্সিক্ষত শান্তিময় বিশ্বের জন্য, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার জন্য জঙ্গীবাদকে সমূলে উৎপাটন করা সময়ের প্রয়োজনেই অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনার সরকার কেবল জঙ্গীবাদের প্রতিরোধই নয়, প্রতিকারের জন্য নানারকম পদক্ষেপ নিয়েছে। জঙ্গীবাদ, সন্ত্রাসবাদের ক্ষেত্রে সরকার কর্তৃক জিরো টলারেন্স নীতি অনুসৃত হচ্ছে। জঙ্গীবাদবিরোধী অভিযান চলছে বেশ জোরেশোরেই। যার ফলে একে একে ধ্বংস হচ্ছে জঙ্গী আস্তানা, কোন কোন জঙ্গী ধরা পড়ছে আবার কেউ কেউ নিহত হচ্ছে। ফলে জঙ্গীরা কোণঠাসা হয়ে পড়েছে তবে একেবারে নির্মূল হয়নি। জঙ্গীবাদবিরোধী অভিযান অব্যাহত আছে যা আশাব্যঞ্জক। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জঙ্গীবাদের প্রতিরোধ করতে পারে, নিয়ন্ত্রণ করতে পারে কিন্তু প্রতিকারের জন্য, সমূলে বিনাশের জন্য সরকারের সুচিন্তিত কৌশল অবলম্বন করে আরও ম্যাসিভ আকারে পদক্ষেপ নেয়ার কোন বিকল্প নেই। সামষ্টিকভাবে সরকারকে যেমন জঙ্গীবাদ নির্মূলে কাজ করে যেতে হবে, তেমনি ব্যষ্টিকভাবেও জঙ্গীবাদ নির্মূলে সবাইকে সচেতন করে তুলতে হবে। মনে রাখতে হবে জঙ্গীদের যদি সমূলে ধ্বংস করা না যায়, তবে যে কোন সময়েই জঙ্গীবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে। আর তা হলে স্যামুয়েল হান্টিংটনের ক্ল্যাশ অব সিভিলাইজেশনের ভবিষ্যদ্বাণীর প্রতিচ্ছবি এই দেশে দেখা দিতে পারে। আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন প্রতিকূল প্রেক্ষাপটের কারণে সমূলে জঙ্গীবাদ নির্মূল করা সত্যিই বেশ কঠিন ও শ্রমসাধ্য বিষয়, তবে অসম্ভব নয়। ‘অসম্ভব’ শব্দটি খুঁজে পাওয়া যায় বোকাদের শব্দকোষেÑ নেপোলিয়নের এই কথাটি মনে রেখেই জনকল্যাণের স্বার্থে জঙ্গীবাদ নির্মূলের জন্য সরকারকে স্বল্পমেয়াদী ও দীর্ঘমেয়াদী উদ্যোগ নিতে হবে। জঙ্গীবাদ প্রতিরোধের ক্ষেত্রে শক্তি প্রয়োগের প্রয়োজন রয়েছে। কেননা জঙ্গীরা এখন আত্মঘাতী হতেও দ্বিধা করে না। তাদের মগজ ধোলাই এমন পর্যায়ে পৌঁছে গেছে যে, তারা বিশ্বাস করে জেহাদের নামে মানুষ হত্যা করতে গিয়ে যদি তারা মারাও যায়, তবে স্বর্গ নিশ্চিত। এমন ভ্রান্ত ধারণাকারী জঙ্গীরা যখন কোন জঙ্গী কর্মকাণ্ডের প্রয়াস চালায় তখন অবশ্যই বলপ্রয়োগের মাধ্যমে তাদের দমন করার গত্যন্তর থাকে না। জঙ্গীবাদী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্তদের এবং তাদের মদদ দাতাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই সর্বোচ্চ বলপ্রয়োগ করতে হবে, তাদের বিচারের আওতায় আনতে হবে এবং সর্বোচ্চ কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। দ্রুত বিচার আইনে জঙ্গীদের বিচারের উদ্যোগ নেয়াটা জরুরী হয়ে পড়েছে। আরেকটি বিষয় হলো জঙ্গীবাদী কর্মকাণ্ডকে অজামিনযোগ্য অপরাধ হিসেবেও চিহ্নিত করা জরুরী। কেননা জঙ্গীরা আইনের ফাঁক-ফোকর গলে বেরিয়ে আবারও জঙ্গী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হবার সুযোগ পায়। আর শাস্তিপ্রাপ্ত কিংবা হাজতে বন্দী জঙ্গীদের কারাগারে পৃথক কোন স্থানে রাখার ব্যবস্থা করাও জরুরী। কেননা এরা কারা অভ্যন্তরের কয়েদিদের জঙ্গীবাদে দীক্ষিত করে তুলতে পারে। জঙ্গীবাদ নির্মূলে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে পরিবার ও সমাজকে। একজন ব্যক্তির সামাজিকীকরণের যাত্রা শুরু হয় পরিবার থেকে। পারিবারিকভাবে শিশুকে মূল্যবোধ শিক্ষা দিতে এবং অসাম্প্রদায়িকতার চর্চা করাতে বাবা-মা, ভাই-বোনসহ আত্মীয়-স্বজনকে ভূমিকা রাখতে হবে। শিশু-কিশোররা যেন নিঃসঙ্গতায় না ভোগে, নিজেদের সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন না মনে করে সেই দিকেও পরিবারের অন্য সদস্যদের নজর দিতে হবে। বিশৃঙ্খল জীবনযাপন যেন তারা না করে সেদিকেও গুরুত্ব দিতে হবে। অবশ্য তার আগে নিজেদের মূল্যবোধকেও শানিয়ে নিতে হবে। পরিবারকে ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়ার পাশাপাশি খেলাধুলাসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত করতে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। তাদের আচার আচরণে সন্দেহজনক কিছু ধরা পড়লে মনোকষ্টের মধ্যেও সংশ্লিষ্ট থানায় জানাতে হবে এবং প্রয়োজনে সংশোধনমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। জঙ্গীবাদ দূরীকরণে শিক্ষাব্যবস্থা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে সক্ষম। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত বহুমুখী শিক্ষাব্যবস্থা শিক্ষার্থীদের মাঝে বিভাজন, বৈষম্য সৃষ্টি করে যা বঞ্চনার অনুভূতি সৃষ্টি করতে এবং জঙ্গীবাদে উদ্বুদ্ধ করতে পরোক্ষ হলেও কিছুটা ভূমিকা যে রাখে না তা বলা যাবে না। উন্নত দেশগুলোর মতো আমাদেরও একমুখী শিক্ষা ব্যবস্থার দিকে যেতে হবে যদিও তা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। তবে এখন থেকেই এর জন্য প্রয়াস চালাতে হবে। আর যতদিন তা না হচ্ছে, ততদিন পর্যন্ত কওমী মাদ্রাসাগুলোকে সরকারী নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসে এদের পাঠ্যসূচীতে আরবী, উর্দুর সঙ্গে বাংলা ভাষায় চর্চা চালু করতে হবে; সমাজ, বিজ্ঞান, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসসহ মানবিক মূল্যবোধ সৃষ্টিকারী পাঠ্যপুস্তক শিক্ষাক্রমে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। এগুলোর অর্থায়নের বিষয়টিও সরকারের নজরদারিতে নিয়ে আসতে হবে। ইংরেজী মাধ্যমের স্কুল-কলেজগুলোর শিক্ষা কার্যক্রম ও পাঠ্যসূচীর দিকেও সরকারের নজর দেয়া প্রয়োজন। অন্যদিকে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। সরকারী ও বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গোয়েন্দা তৎপরতা বৃদ্ধি করতে হবে। বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মানবিক মূল্যবোধ সৃষ্টিতে উপযোগী বিষয়সমূহ অন্তর্ভুক্তকরণ বাধ্যতামূলক করার উদ্যোগ নিতে হবে। শিক্ষকরা মানুষ গড়ার কারিগর। তাই একাডেমিক বিষয়ের পাশাপাশি শিক্ষকদের মানবিক মূল্যবোধ সংক্রান্ত বিষয়াদি, জঙ্গীবাদের কুফল, ধর্মের অপব্যাখ্যার খণ্ডন ইত্যাদি বিষয়ে শিক্ষা দিতে হবে। তাছাড়া একাডেমিক লেখাপড়ার পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের বেশি করে সাংস্কৃতিক কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত করতে হবে। শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে গণিত অলিম্পিয়াড, বিতর্ক, পাঠচক্র, খেলাধুলা ইত্যাদির আয়োজন নিশ্চিত করতে হবে। জঙ্গীবাদের নির্মূল করতে হলে রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার নিষিদ্ধ করা খুবই জরুরী। রাজনীতিতে ধর্ম ব্যবহার করলে মৌলবাদী গোষ্ঠী রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় নিজেদের সংগঠিত করার সুযোগ পায়, যার ফল তো আমরা হাতেনাতেই পেয়েছি। একটা বিষয় মনে রাখতে হবে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করে রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার শূন্যের কোঠায় নামিয়ে না আনলে, জঙ্গীবাদ সমূলে উৎপাটন করা যাবে না। অনেক নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গী সংগঠনগুলোর কর্মীরা বর্ণচোরার রূপ ধরে ইতোমধ্যে বিভিন্ন ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলে নাম লিখিয়ে নিজেদের গোপনে সংগঠিত করছে, তা অনেক পত্রপত্রিকাতে ওঠে এসেছে। তাই এসব বর্ণচোরাদের চিহ্নিত করে প্রয়োজনমাফিক শাস্তিমূলক ও সংশোধনমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। আর সেই সঙ্গে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলও নিষিদ্ধ করতে হবে। ধর্মভিত্তিক নানা সংগঠন থাকতে পারে, কিন্তু তাই বলে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল নয়। এদেশে জঙ্গীবাদ দমনে ব্যাংকগুলোর প্রতি কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর নজরদারী বৃদ্ধি পেলেও কুরিয়ার সার্ভিস বা মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে অনিয়ন্ত্রিতভাবেই এখনও অর্থনৈতিক লেনদেন হচ্ছে। এগুলোকে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে নিয়ে আসতে হবে। অর্থ লেনদেন সহজ করতে গিয়ে জঙ্গী অর্থায়নকে সহজ করে ফেলার কোন যুক্তিই থাকতে পারে না। ধর্মভিত্তিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অর্থের উৎস খুঁজে বের করতে হবে এবং কোন প্রতিষ্ঠানের জঙ্গী অর্থায়নের কোন নমুনা পাওয়া গেলে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। জঙ্গীবাদের বিস্তারের ক্ষেত্রে যে ইন্টারনেট প্রযুক্তি, বিশেষ করেÑ ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, ওয়েবসাইট, ব্লগ যে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এসবের মাধ্যমে খুব সূক্ষ্ম কৌশলে স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী তরুণ-তরুণীদের মাঝে জঙ্গীবাদের বীজ রোপণ করে দেয়। ইন্টারনেট বর্তমান যুগের জন্য অনিবার্য। কিন্তু একে নিয়ন্ত্রণ করাও জরুরী। যদিও দুঃসাধ্য তবুও সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে এর ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে। যেসব ওয়েবসাইট ও ব্লগ জঙ্গীবাদ প্রচার করে থাকে সেগুলো এদেশে বন্ধ করে দিতে হবে। আর ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যারা উস্কানিমূলক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত তাদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। জঙ্গীবাদ প্রতিরোধ ও নির্মূলে গণমাধ্যম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। বিটিভিতে জঙ্গীবাদবিরোধী বিজ্ঞাপন প্রচারিত হচ্ছে। এরকম আরও অনেক বিজ্ঞাপন, সচেতনতামূলক অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে হবে। এই দায়িত্ব কেবল বিটিভির নয়, অন্য সকল টিভি চ্যানেলগুলোতে এ ধরনের অনুষ্ঠান, বিজ্ঞাপন প্রচার বাধ্যতামূলক করে দিতে হবে। পত্রিকা, অনলাইন পোর্টালসহ সকল গণমাধ্যমে জঙ্গীবাদবিরোধী প্রচারণা এবং বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা জাগ্রতকরণ সংক্রান্ত প্রচারণা বৃদ্ধি করা জরুরী। একটা বিষয় নিশ্চিত যে, যদি সকল বাঙালীর মাঝে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ-চেতনা এবং মহান মুক্তিযুদ্ধের মহিমা বপন ও আত্মস্থ করানো যায় তবেই এদেশ থেকে জঙ্গীবাদ সমূলে উৎপাটিত হবে। (সমাপ্ত) লেখক : সিনেট ও সিন্ডিকেট সদস্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
×