ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০৮ মে ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪৩১

শেখ মিরাজুল ইসলাম

ধা রা বা হি ক ॥ উপন্যাস ॥ মোঘল গীবত

প্রকাশিত: ০৬:৫৯, ৯ জুন ২০১৭

ধা  রা  বা  হি  ক ॥ উপন্যাস ॥ মোঘল গীবত

(পূর্ব প্রকাশের পর) গুরু সন্ধি বাঘের চামড়া বিছানো আসনে পদ্মাসন ভঙ্গিতে বসেছেন গুরু হর রাই সিং। শাহজাদা দারা শিকোর বিশেষ আমন্ত্রণে তিনি এসেছেন ফতেহপুর সিক্রিতে। দারা চাচ্ছিলেন আগ্রায় দেখা করতে, কিন্তু গুরু রাজি হননি। শিখ সম্প্রদায়ের নেতা হিসেবে সরাসরি সম্রাট শাহজাহানের খুব কাছে যাবার ইচ্ছে হয়নি তার। সম্রাট জাহাঙ্গীর বা শাহজাহান কেউ শিখ গুরুদের প্রতি সদয় আচরণ করেননি। রীতিমত দৌড়ের ওপর রেখেছিলেন। গুরু হরগোবিন্দ গোয়ালিয়রের দুর্গে দীর্ঘদিন বন্দী ছিলেন। হর রাই শিখ সম্প্রদায়ের সপ্তম গুরু হিসেবে সরাসরি দারার সঙ্গে গোপন আলোচনায় বসা নিয়ে তার সম্প্রদায়ের মধ্যেই ব্যাপক মতভেদ শুরু হবার সুযোগ আছে। এই মুহূর্তে তার প্রায় দুই হাজার সশস্ত্র যোদ্ধা আগ্রার অদূরে মথুরা আর বৃৃৃন্দাবনে ছদ্মবেশে ছড়িয়ে আছে। গুরুর নির্দেশ পেলেই তারা এক জোট হবেন। কিন্তু শাহজাদা দারাকে বিশ্বাস করেন গুরু হর রাঈ। অবস্থা এখন অনেক বদলে গেছে। তিনি জেনেছেন দাক্ষিণাত্য আর গুজরাট হতে আওরঙ্গজেব আর মুরাদ যে কোন সময় হানা দিতে পারে আগ্রার কেল্লায়। মুক্তমনা ও সব ধর্মের প্রতি দরদী দারার পক্ষে একা সামাল দেয়া সম্ভব হবে না তা চোখ বন্ধ করে বলে দেয়া যায়। গুরু এমন সময়ের অপেক্ষায় ছিলেন হিমালয়ের অজ্ঞাতবাসে। শিকার করে সময় কাটালেও তীক্ষè নজর রাখছিলেন মুঘল সালতানাতের ঘটনাবলীর দিকে। এখন সেই মোক্ষম সুযোগ এসেছে। দারাকে সিংহাসনের লড়াইয়ে জয়ী করতে পারলে শিখদের আরও প্রকাশ্যে ধর্ম অর্চনায় কোন বাধা থাকবে না। দারা গুরুকে অনুসরণ করে বসেছেন উলের শতরঞ্জিতে। নকশা কাটা কাশ্মীরের চাদর দুই ভাঁজ করে শক্ত করে গায়ে জড়িয়েছেন। বছর শুরুর শীত তাকে সামান্য কাবু করেছে। - মুঘলদের সঙ্গে শত্রুতা থাকা সত্ত্বেও কেন আমার সঙ্গে দেখা করতে রাজি হলেন। সরাসরি প্রশ্ন করলেন দারা। দাঁড়িতে হাত বুলিয়ে মাথা ঝাঁকালেন গুরু। মিষ্টি সুরে বলতে থাকলেন, - কেউ যখন এক হাতে ফুল ছিঁড়ে অন্য হাতে কাউকে দেয়, তখন তার দুই হাতেই কিন্তু সেই ফুলের সুরভি লেগে থাকে। যে কুড়াল দিয়ে চন্দন কাঠের গাছ কাটা হয়, চন্দনের গন্ধ উল্টো সেই কুঠারকে সুগন্ধী করে তোলে। - কিন্তু আমার তিন ভাই তো আমাকে হত্যা করতে সঙ্কল্প করেছে। তাদের কি আমার প্রত্যাঘাত করা উচিত? আমি এই বিষয়ে আপনার সার্বিক সহযোগিতা চাই। - শত্রুর প্রতি ক্রোধান্বিত হবেন না মহামান্য। এর ফলে আপনার বিচার-বুদ্ধি লোপ পেতে পারে। আর সরাসরি আপনার মনের ভাব আমার কাছে প্রকাশ করে খুব একটা ভাল করেননি শাহজাদা। তা আপনার অপরিণত চিন্তাকেই স্পষ্ট করে তোলে। সবাইকে এত বিশ্বাস করা কি ভাল? শান্ত স্বরে গুরু হর রাই সরাসরি দারাকে পাল্টা প্রশ্ন করলেন। দারা অপ্রস্তুত হলেন না। - আপনার প্রতি বিশ্বাস না রাখলেও আপনার সব খবরাখবর না রাখলে আমি আপনাকে খোলাখুলি কিছু বলতাম না গুরুজী। কিন্তু আমি জানি আপনি আওরঙ্গজেবকে ঘৃণা করেন। আওরঙ্গজেবও আপনাদের ঘৃণা করে। তার চেয়ে বড় কথা উচ্চ বংশীয় হিন্দু রাজারা শিখদের উত্থানকে সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখেন। আপনাদের ভক্তিবাদের কঠোর সমালোচনা শুধু আমাদের সুন্নি মোল্লারা নয়, অন্যরাও করেন। গুরু কবীরের ‘আমি রাম ও আল্লাহর সন্তান’ বলাকে তারা কেউ পছন্দ করেন না এটা আপনি ভালভাবেই জানেন। দারা থামলেন। - তবে আপনি এটাও তো জানেন গুরু নানকের বাণী পাতিয়ালা, নভ্য, জিন্দ, কৈথাল ও বাগারিয়ানের মতো সম্ভ্রান্ত পরিবারের লোকজন মনে প্রাণে ভালবেসেছে। তাদের মতো অনেকেই আমাদের সাদরে গ্রহণ করছেন। আমাদের কোন ভয় নেই হে মহান মুঘল শাহজাদা। কারণ আমরা বিশ্বাস করিÑ চেতনার মৃত্যু ঘটে/এরপর অহঙ্কার মারা যায়/কিন্তু আত্মা অমর থাকে। গুরু নানকের কয়েকটি বাণী সুর করে বললেন হর রাই। - জানি বলেই আপনাকে ডেকে এনেছি এটা জানাতে আগামী দিনের যুদ্ধে আমি আপনাকে পাশে চাই। যদিও আব্বাজানকে এই ব্যাপারে গোপন রাখা হয়েছে। মুরাদকে পরাস্ত করতে মির্জা কাসিম খানকে গুজরাটে ও রাজা যশোবন্ত সিংকে মারওয়ারে পাঠানো হয়েছে শায়েস্তা খানের কাছ হতে দায়িত্ব বুঝে নিয়ে আওরঙ্গজেবকে ঠেকাতে। দারা তার উদ্দেশ্য আরও খোলাসা করলেন গুরুর কাছে। চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ স্তব্ধ থাকলেন গুরু হর রাই সিং। - আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন। নিশ্চয় একদিন হিন্দুস্তান হবে সকল ধর্মের নিরাপদ আস্তানা। আমি এই লড়াইয়ে আপনার পাশে আছি, থাকব। দারা উঠে এসে গুরুর হাত নীল রঙের সুগন্ধীর শিশি উপহার দিলেন। - এটা মহামতি আকবরের প্রিয় খুশবু ‘আম্বর-ই-আসহাব।’ মুঘল খুশবুখানায় সবচেয়ে সেরা। ছিপি খুলতেই তীব্র মিষ্টি গন্ধে ভরে উঠল চারপাশ। বিনিময়ে হর রাই সিং তার আলখেল্লার ভেতর হতে কারুকাজ করা বাঁকানো এক ছুরি বের করে শাহজাদার হাতে দিলেন। তামার হাতলে ড্রাগনের মাথাসদৃশ জন্তুর মুখ খোদাই করা ছুরিটিকে স্থানীয় ভাষায় বলে ‘বিছুয়া’। সন্ধির উপহার হিসেবে অসামান্য। আগ্রার নিজস্ব কিতাবখানায় একা একা ঢুকলেন শাহজাদী জাহান আরা। তার নিজস্ব বার্তাবাহক কিছু গোপনীয় কাগজ দিয়ে গেছে। সন্তর্পণে আলাদা করে পড়ে দেখবেন তিনি। ততক্ষণে সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। চেরাগখানা হতে দারোগার তত্ত্বাবধানে প্রতিটি মহলে পাঠানো হচ্ছে চাহিদা মোতাবেক প্রদীপ, মোমবাতি, মশাল, আকাশ-দিয়া। মোমদানিতে একসঙ্গে পাঁচটি মোমবাতি জ্বালিয়ে দিয়ে গেল দাসী। প্রথম চিরকুটটি খুললেন জাহান আরা। আওরঙ্গাবাদ হতে গোপন সংবাদ এসেছে। আওরঙ্গজেব যুদ্ধযাত্রার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। অবাক হলেন না। এমনটিই অনুমান করেছিলেন। তিনি এটাও জানেন রাজা যশোবন্ত সিংকে ইতোমধ্যে পাঠানো হয়েছে সন্ধিচুক্তি করে আওরঙ্গজেবকে ফেরাবার জন্য। পরবর্তী মোড়কটি একটু আকারে বড়। পাঠানো হয়েছে সুরাট হতে ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির এক জাহাজ মালিকের পক্ষ হতে। হলুদ রঙের গোটানো কাগজটি খুলে তাজ্জব হয়ে গেলেন শাহজাদী। এক ইউরোপিয়ান ছাপচিত্র। অনেক ওস্তাদ মুঘল শিল্পীর চিত্রকর্ম তার সংগ্রহে আছে। ওস্তাদ মনসুর, আবুল হাসান, বিষণ দাস, নানহা, গোবর্ধন, মিসকিন, দোস্ত মোহাম্মদসহ অনেক জানা না জানা শিল্পীর কাজ তার দেখা। এদের সব ছবি ফুল লতা পাতা পশুপাখিতে ভরা আর মানুষের মাথা এক পাশ হতে আঁকা। পাশাপাশি অটোমান সুলতান ও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বণিকদের কাছ হতে উপহার পাওয়া ইতালিয়ান শিল্পীদের কিছু কাজ দেখেছেন। যার বেশিরভাগই যিশুখ্রিস্ট ও বিবি মরিয়মকে নিয়ে আঁকা। কিন্তু এই রকম আশ্চর্য প্রাণবন্ত পুরুষ ও নারীর ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে অঁাঁকা ছবি তিনি এই প্রথম দেখলেন। কামসূত্রের ছবির চেয়েও আলাদা এর প্রকাশ ভঙ্গি। কালো কালিতে আঁকা নরম শয্যায় এক জোড়া নারী-পুরুষের সঙ্গম দৃশ্য। শিল্পীর নাম পড়ার চেষ্টা করলেন শাহজাদী। রেমব্রান্ট, ১৬৪৬ সাল। অচেনা ডাচ শিল্পীর নাম বিদ্ঘুুটে লাগলেও চোখ ফেরাতে পারছিলেন না জাহান আরা। লালচে মোমের আলো হাল্কা বাতাসে কেঁপে উঠছিল। সেই কম্পিত নরম আলোয় যেন সামনে পেছনে দুলে উঠছে ছবির দুটো শরীর। তাদের ঊরুসন্ধির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আসন্ন যুদ্ধের কথা কিছুক্ষণের জন্য ভুলে গেলেন শাহজাদী। (চলবে)
×