ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

এনামুল হক

পৃথিবীর আদিম বায়ুমণ্ডল যেভাবে লুপ্ত হয়েছিল

প্রকাশিত: ০৭:১৭, ২ জুন ২০১৭

পৃথিবীর আদিম বায়ুমণ্ডল যেভাবে লুপ্ত হয়েছিল

পৃথিবীর আদিম বায়ুম-ল ও আজকের বায়ুম-লের মধ্যে তেমন কোন মিলই খুঁজে পাওয়া যাবে না। বিজ্ঞানীরা বলছেন যে চার শ’ কোটি বছরেরও বেশি আগে পৃথিবী সৃষ্টি হওয়ার পর থেকে এর বায়ুম-ল অন্তত দু’বার সম্পূর্ণ মুছে গিয়েছিল। তবে কি কারণে এমন হয়েছিল সেটা এখনও ঠিক পরিষ্কার নয়। নতুন একদল গবেষক অবশ্য এই সম্ভাব্য একটা ব্যাখ্যা হাজির করেছেন। সেটা হলো চাঁদ যে সময়ের দিকে গঠিত হয় সে সময় মহাকাশের ছোট ছোট শিলাপাথর বা গ্রহাণু অনবরত পৃথিবীর ওপর বর্ষিত হয়েছিল। এগুলোর অভিঘাতে গ্যাসের মেঘমালা প্রবল বেগে পৃথিবীর বুক থেকে বেরিয়ে যায়। এইভাবে বায়ুম-লের ছোট ছোট অংশ স্থায়ীভাবে মহাশূন্যে উৎক্ষিপ্ত হয়ে এক পর্যায়ে গোটা বায়ুম-লই সম্পূর্ণ মুছে যায়। গবেষকরা হিসাব করে দেখেছেন যে এ ধরনের হাজার হাজার ছোট ছোট অভিঘাত আদিম পৃথিবীর গোটা বায়ুম-লই নিশ্চিহ্ন করে দিয়ে থাকতে পারে। এমন অভিঘাতে অন্যান্য গ্রহেরও হয়ত একই পরিণতি হয়েছিল যেমন মঙ্গল ও শুক্রগ্রহ। গবেষকরা বলেন যে, পৃথিবীর বায়ুম-ল মুছে দেয়ার ব্যাপারে বিশাল বিশাল গ্রহাণু বা উল্কার আঘাত যতটা কার্যকর হওয়ার কথা তার চেয়ে ছোট ছোট গ্রহাণুুর আঘাত সম্ভবত অধিকতর কার্যকর হয়েছিল। তারা হিসাব করে দেখেছেন যে বিশাল কোন কিছুর আঘাতে যদি পৃথিবীর বায়ুম-লের অধিকাংশ মুছে গিয়ে থাকত তাহলে সেটার আকার হতো পৃথিবীরই মতো বিশাল। কিন্তু অসংখ্য ছোট ছোট বস্তুর আঘাত মিলিতভাবে ধরা হলেও তার প্রভাব একই রকমের হতো। যুক্তরাষ্ট্রের এমআইটির সহকারী অধ্যাপক হিলকে শিলিচটিং বলেন, পৃথিবীর প্রাচীন বায়ুম-লের চালিকাশক্তিগুলোক বুঝতে পারলে প্রাণ গঠনের অনুকূল অবস্থাবলীকে চিহ্নিত করতে পারা বিজ্ঞানীদের পক্ষে সম্ভব হবে। তিনি বলেন, বর্তমান গবেষণার ফলাফল থেকে পৃথিবীর আদি বায়ুম-ল খুব সম্ভব কেমন ছিল সে ব্যাপারে সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের প্রারম্ভিক ধারণা পাওয়া যাবে। সেই বায়ুম-লের গঠন বিন্যাস কেমন ছিল এবং প্রাণীর উন্মেষ ঘটার অবস্থাবলীই বা কেমন ছিল তা বোঝবার ব্যাপারে এক নতুন যাত্রাবিন্দু সূচিত হবে। মঙ্গলগ্রহের মতো কি তার চেয়ে বড় সাইজের বস্তুর আঘাতে এবং ২৫ কিলোমিটার বা তার চেয়েও কম আয়তনের গ্রহাণুসমূহের আঘাতে পৃথিবীর বায়ুম-লের কতটা থাকত আর কতটাই বা হারিয়ে যেতে পারত গবেষক দলটি তা পরীক্ষা করে দেখেছেন। তারা নির্দিষ্ট গতিতে বস্তুর আঘাত হানার ফলে উৎপন্ন শক্তি এবং তা থেকে যে পরিমাণে বায়ুম-লীয় গ্যাস বেরিয়ে যেতে পারে সেটা হিসাব কষেছেন, বিশ্লেষণ করেছেন। তারা দেখেছেন যে মঙ্গলের মতো বড় কোন বস্তুর সঙ্গে সংঘর্ষ হলে পৃথিবীর ভেতরভাগ দিয়ে একটা শকওয়েভ সৃষ্টি হতো। তাতে করে স্থলভাগের উল্লেখযোগ্য সঞ্চালন ঘটত। পৃথিবীজুড়ে একই সঙ্গে বড় বড় ভূমিকম্প হলে যেমন অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে ঠিক সে রকম। সেই আলোড়নের শক্তি স্থলভাগ থেকে ছিঁড়েছুড়ে বেরিয়ে বায়ুম-লে চলে যেত। এই প্রক্রিয়ায় বায়ুম-লের পুরোটা না হলেও একটা উল্লেখযোগ্য অংশ মহাশূন্যে উৎক্ষিপ্ত হতে পারত। অবশ্য এ ধরনের সংঘর্ষ হলে যে প্রচ- তাপ সৃষ্টি হতো তাতে পৃথিবীর ভেতরকার সব কিছু গলে গিয়ে একাকার হয়ে যেত এবং এক ও অভিন্ন রূপ ধারণ করত। অথচ আজকের পৃথিবীর গভীরে হেলিয়াম-৩ এর মতো অভিজাত গ্যাসগুলোর (যে গ্যাসের উপাদান কখনই অন্য কোন উপাদানের সঙ্গে মিশ্রিত হয় না) বৈচিত্র্যময় উপস্থিতি দেখে বিজ্ঞানীরা উপসংহার টেনেছেন যে পৃথিবীর কেন্দ্রভাগ গলিয়ে দেয়া এমন কোন বিশাল বস্তুর আঘাত না ঘটে থাকারই বরং বেশি সম্ভাবনা। বিজ্ঞানী দলটি পৃথিবীর বায়ুম-লের ওপর অনেক বেশি ছোট আকারের বস্তুর অভিঘাতের প্রভাবও হিসাব করে দেখেছেন। এ ধরনের মহাকাশীয় শিলা বা গ্রহাণুর আঘাতে বিস্ফোরণ ঘটার এবং ধ্বংসাবশেষের ধূম্র ও গ্যাস নির্গত হওয়ার কথা। সবচেয়ে বড়গুলোর আঘাতে এমন শক্তি উৎপন্ন হওয়ার কথা যে তা বস্তুটির আবক্র পথের সমকোণে অবস্থিত সমতলের ঠিক উপরের বায়ুম-ল থেকে সমস্ত গ্যাস বাইরের মহাকাশে বের করে দেয়ার জন্য যথেষ্ট। আর ছোট ছোট বস্তু বা গ্রহাণুর আঘাতে বায়ুম-লের সামান্য অংশ মাত্র বিলীন হয়ে যাবার কথা। বিজ্ঞানী দলটি হিসাব করে দেখেছেন যে পৃথিবীর বায়ুম-লের পুরোটা সম্পূর্ণরূপে বের করে দেয়ার জন্য এ ধরনের হাজার হাজার ছোট গ্রহাণু বর্ষণের প্রয়োজন ছিল এবং এমনটাই সম্ভবত ঘটেছিল সাড়ে চার শ’ কোটি বছর আগে চাঁদ গঠিত হওয়ার সময়। ওই সময়টা ছিল সৌরজগতের অন্যতম বিশৃঙ্খলাপূর্ণ একটা অধ্যায়। হাজার হাজার মহাকাশীয় শিক্ষা বা গ্রহাণু আমাদের সৌরজগতের চারদিকে ছোটাছুটি করে বেড়াচ্ছিল এবং ঘন ঘন পরস্পরের সঙ্গে সংঘর্ষের মধ্য দিয়ে গ্রহ, চাঁদ ও অন্যান্য বস্তুর জন্ম হয়েছিল। বিজ্ঞানী দলটির এই গবেষণা ও বিশ্লেষণ চলাকালে একটা প্রশ্ন অনিবার্যভাবে উঠেছিল তাহলো পৃথিবীর বায়ুম-ল নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার পর শেষ পর্যন্ত আবার তা পুনর্প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল কিভাবে? কিভাবেই বা সেই বায়ুম-লীয় শূন্যতা পূরণ হয়েছিল? এ নিয়ে শিলিচটিং ও তার দল আরও হিসাব নিকাশ এবং বিশ্লেষণ করে দেখেছেন যে গ্রহাণুুগুলো পৃথিবীপৃষ্ঠে আঘাত হেনে বায়ুম-লের গ্যাসপুঞ্জকে মহাশূন্যে বের করে দিয়েছিল সেগুলোই আবার নতুন গ্যাসও সঞ্চার করে থাকতে পারে। শিলিচটিং বলেন, গ্রহাণু আঘাত হানলে যে প্রচ- উত্তাপ সৃষ্টি হয় তাতে গ্রহাণু গলে যায় এবং এর উদ্বায়ু পদার্থরাজি বায়ুম-লে চলে যেতে পারে। সুতরাং গ্রহাণুর আঘাতে বায়ুম-ল শুধু নিঃশেষিতই হয় না উপরন্তু বায়ুম-লের একাংশ পূরণও হতে পারে। গবেষক দলটি হিসাব করে দেখেছে যে হাজার হাজার মহাকাশীয় শিলা বা গ্রহাণুর আঘাতে বিলীন হয়ে যাওয়া পৃথিবীর বায়ুম-লের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ সম্ভবত পূরণ হয়ে গিয়েছিল। পার্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জে. মেলোশ বলেন, এতদিন পর্যন্ত বেশিরভাগ বিজ্ঞানী ধরে নিয়েছিলেন যে একটি মাত্র বিশাল বস্তুর আঘাতে পৃথিবীর বায়ুম-ল মুছে গিয়েছিল। আবার অন্যদের মতে সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মির প্রবল বিকীরণ কিংবা অস্বাভাবিক মাত্রায় সক্রিয় সৌরবায়ুর প্রভাবে এমনটা হয়ে থাকতে পারে। সেদিক থেকে শিলিংটিংয়ের এই ব্যাখ্যা নিঃসন্দেহে বিস্ময়কর। পৃথিবীর আদিম বায়ুম-ল কিভাবে হারিয়ে গিয়েছিল সেটা ছিল বিজ্ঞানী মহলের কাছে দীর্ঘদিনের প্রশ্ন। সেই প্রহেলিকার সমাধানে এই ব্যাখ্যা বহুদূর সাহায্য করবে। সূত্র : ন্যাশনাল জিওগ্রাফি
×