ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

সালাম মশরুর

হাওড়বাসীর সুখ-দুঃখ

প্রকাশিত: ০৩:৫১, ৯ মে ২০১৭

হাওড়বাসীর সুখ-দুঃখ

(পূর্ব প্রকাশের পর) জরিপ কাজ সম্পাদনকারী বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থা আইডিয়ার নির্বাহী পরিচালক নজমুল হক বলেন, ডিমওয়ালা ও পোনা মাছ নিধন, সেচের মাধ্যমে মৎস্য আহরণ, জলাশয়ে যত্রতত্র বাঁধ দিয়ে পানি প্রবাহে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি, জলবায়ুর পরিবর্তন, অতিরিক্ত কীটনাশকের ব্যবহারসহ নানা কারণে দেশীয় প্রজাতির মাছের প্রজনন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ফলে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে দেশীয় বিভিন্ন প্রজাতির মাছ। তিনি বলেন, দেশীয় প্রজাতির মাছের বিলুপ্তি রোধ ও বিস্তারে হাওড় অঞ্চলের মৎস্যজীবীদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টিতে আমরা বিভিন্ন কর্মকা- চালিয়ে যাচ্ছি। এর মধ্যে রয়েছে অসময়ে পোনা মাছ ধরা বন্ধ, মাছের ডিম ছাড়ার মৌসুম বৈশাখ থেকে শ্রাবণ মাস পর্যন্ত মৎস্যজীবীদের বিকল্প আয়ের ব্যবস্থা ও ভিন্ন পেশা গ্রহণে উৎসাহিত করা, সেচের মাধ্যমে মৎস্য নিধন বন্ধ করা ও মৎস্য আইন সম্পর্কে মৎস্যজীবীদের সচেতন করে তোলা। এ ব্যাপারে মৎস্য বিভাগের সিলেট বিভাগীয় উপপরিচালক ড. নিত্যানন্দ দাস বলেন, দেশীয় ও বিলুপ্ত প্রজাতির মাছের চাষ বাড়াতে মৎস্য বিভাগ থেকে ‘চিহ্নিত অবক্ষয়িত জলাশয় উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা এবং দেশীয় প্রজাতির ‘ছোট মৎস্য সংরক্ষণ প্রকল্প’ নামে একটি প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। প্রায় ৮১ লাখ টাকার এই প্রকল্পের মাধ্যমে দেশীয় প্রজাতির মাছের পোনা অবমুক্ত ও নার্সারি স্থাপন করে মাছের প্রজাতি সংরক্ষণের চেষ্টা করা হচ্ছে। নিত্যানন্দ দাস বলেন, ডিমওয়ালা ও পোনা চাষ নিধন থেকে বিরত রাখতে বৈশাখ থেকে শ্রাবণ মাস পর্যন্ত মৎস্যজীবীদের মধ্যে ভিজিএফ চালুরও পরিকল্পনা আছে। এই চার মাস যে কোন উপায়ে মাছ নিধন থেকে বিরত রাখতে চেষ্টা করা হচ্ছে। তিনি বলেন, আমাদের মৎস্যজীবীরা প্রশিক্ষিত নয়। তাদের মৎস্য চাষ ও আহরণের কৌশল সম্পর্কে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হচ্ছে। এ ছাড়া মৎস্য আইন প্রয়োগেও এখন অনেক কঠোরতা অবলম্বন করা হচ্ছে। এ বিষয়ে সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মৎস্যবিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক মোঃ শাহাব উদ্দিন বলেন, ‘মাছের উৎপাদন ও বিলুপ্তি ঠেকাতে হাওড়ের জলজ জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ এবং মা মাছের নির্বিঘেœ বড় হওয়া ও প্রজননের সুযোগ সৃষ্টি করে দিতে হবে। এক্ষেত্রে প্রতিটি উন্মুক্ত জলাশয়, বিল ও নদীতে অভয়াশ্রম স্থাপন করা প্রয়োজন। এক কথায় মাছের প্রজনন ও বৃদ্ধির জন্য নিরাপদ বিচরণস্থল তৈরি করতে না পারলে কোনভাবেই মাছের বিলুপ্তি রোধ করা সম্ভব হবে না। মাছের প্রজনন বৃদ্ধি, পোনা নিধন বন্ধ ও মৎস্য আহরণের নীতিমালা অনুসরণ, অবাধে নিষিদ্ধ কারেন্ট জালের ব্যবহার বন্ধসহ নানান বিষয়ে সরকারী ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতা রয়েছে। বাস্তবে এই নিয়ে চোখে পড়ার মতো কোন কার্যক্রম দেখা যাচ্ছে না। অবাধে সর্বত্র চলছে পোনা নিধন। হাওড়ে নিষিদ্ধ ঘোষিত কারেন্ট জালের ব্যবহার অব্যাহত আছে। উজান থেকে পাহাড়ী ঢলের সঙ্গে নেমে আসা পলিতে ভরাট হয়ে যাওয়া বিল-জলাশয়গুলো ক্রমশ মাছশূন্য হয়ে যাচ্ছে। এক সময় প্রতি ৩ বছর পর বিলে মৎস্য আহরণ করা হতো। এতে অধিক হারে মাছের বংশ বিস্তার হতো। গত ক’বছর যাবত প্রতি বছর বিল ফিসিং এবং অনেক ক্ষেত্রে বিলের পানি সেচে মৎস্য আহরণের ফলে মাছের বংশ বৃদ্ধি লোপ পাচ্ছে। ॥ তিন ॥ সাম্প্র্রতিক বন্যা এই অঞ্চলের কৃষকের মুখের ভাত কেড়ে নিয়েছে। বোরো ধান তলিয়ে গেছে পানির নিচে। সুনামগঞ্জের বিশাল এলাকা ভাটি অঞ্চল হিসেবে পরিচিত। হাওড় অঞ্চলে বোরো ধানের বাম্পার ফলন হয়। কিন্তু কৃষক ধান ক্ষেতে কাস্তে হাতে নামার আগেই বন্যার তা-বে ব্যাপক ফসলহানি ঘটে। জানা যায় অধিক ফসলের জেলা সুনামগঞ্জ ও কিশোরগঞ্জে এবার প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকার ফসল নষ্ট হয়েছে। ধান ছাড়াও ক্ষতির মুখে পড়েছে রবিশস্য। এ অঞ্চলের কৃষকের অর্থ উপার্জনের প্রধান উৎস ধান চাষ। ধান বিক্রি করে তারা সংসারের যাবতীয় চাহিদা পূরণ করে। ফসল তুলে ঋণ পরিশোধ করবে। মহাজনের দেনা মেটাবে। কেউ মেয়ে বিয়ে দেবে। কেউ চিকিৎসার অর্থ যোগাড় করবে। কেউ মসজিদ-মাদ্রাসায় দান করবে। আবার কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া ছেলেমেয়ের বার্ষিক খরচা দেবে। কৃষকের এসব হিসাব নিকাশ ওলট-পালট হয়ে গেছে। আগাম এই বন্যার জন্য কেউ প্রস্তুত ছিল না। ভাটি অঞ্চলে ধান কেটে অর্থ উপার্জন করবে। ধান মাড়াইয়ের যন্ত্র বিক্রয় ও বিনিয়োগের জন্য ফ্যাক্টরিগুলো উৎপাদন বাড়িয়েছিল। তাদের প্রস্তুতি ও পরিকল্পনা ভেস্তে গেছে। ফসল নষ্ট হওয়ায় কৃষক পরিবারে নেমে এসেছে হাহাকার। সবাই এখন চোখে অন্ধকার দেখছে। কি করে সারা বছর সংসার চালাবে? দুশ্চিন্তায় সময় অতিবাহত করছে কৃষক পরিবার। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে হাওড়ের মাছের মড়ক। জেলে পরিবারেও উদ্বেগের শেষ নেই। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কাছে মানুষ অসহায়। এটা ঠেকানো যায় না। তবে পূর্ব পরিকল্পনা থাকলে ক্ষয়ক্ষতি কমানো সম্ভব। অতীতে বিভিন্ন বছর সুনামগঞ্জের বোরো ধান বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে এবারের ক্ষয়ক্ষতি অতীতের যে কোন সময়ের চেয়ে বেশি। অপরিকল্পিত বেড়িবাঁধ ও সড়কপথ হাওড়ের স্বাভাবিক প্রবাহকে ব্যাহত করে। ফলে হাওড় স্তরে স্তরে পানি ধরে রাখতে কিংবা পর্যায়ক্রমে পানি নিষ্কাশন করতে বাধাগ্রস্ত হয়। সময়মতো কৃষি জমি জেগে না ওঠার কারণে চাষাবাদ হয় না। যে কারণে সময়ের হিসাবে ঢলের হাত থেকে ফসল রক্ষা করা যায় না। তাছাড়া অধিক ফলনশীল ও দীর্ঘ সময়ে উৎপাদিত ধানের ভুল চাষবাস তো আছেই। তাই বর্তমানে শুধু নদী খনন, পরিকল্পিত বেড়িবাঁধ কিংবা সড়কপথসহ স্নুইসগেট নির্মাণই নয়, সময় উপযোগী সঠিক জাতের ধানচাষ, নিয়ম অনুযায়ী মাছ ধরা, সর্বোপরি স্থানীয়ভাবে ধানের ও মাছের প্রক্রিয়াজাতকরণ দরকার। প্রয়োজন ইজারা প্রথার আধুনিকায়ন, পর্যটন কেন্দ্র স্থাপন ও সংস্কৃতি চর্চা। শিক্ষা ব্যবস্থায় হাওড় বিভাগ চালু করা দরকার। হাওড় মন্ত্রণালয় স্থাপনের মাধ্যমে এই বিষয়টি গবেষণায় নিয়ে দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়ন দরকার। পানি উন্নয়ন বোর্ড হাওড়ের ফসল রক্ষা প্রকল্প নামে প্রতি বছর অকালবন্যার কবল থেকে ফসল রক্ষায় নতুন বাঁধ নির্মাণ ও সংস্কার কাজ করছে। এবার হাওড়ে এক হাজার ৫০০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের ৮৫০টি অংশে সংস্কার ও নির্মাণকাজ করে। এর মধ্যে ৫২৫টি বাঁধের অংশ ভেঙ্গে একে একে ফসলহানি ঘটে ছোট-বড় ১৫৪টি ফসলি হাওড়ের। হাওড়-বাঁওড়ের জেলা সুনামগঞ্জ। মাছ ও ধানের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ এখান থেকে বেরিয়ে আসছে। দেশে ২৬০ প্রজাতির মিঠাপানির মাছের মধ্যে সুনামগঞ্জে প্রায় ১০০ প্রজাতির মাছ ছিল। সম্প্রতি সরকারী জরিপ মোতাবেক ১৫ প্রজাতির মাছ বিলুপ্তির পথে। অবশ্য বেসরকারী হিসাবে বিলুপ্ত প্রায় মাছের সংখ্যা আরও বেশি। সরকারী হিসেবে এই জেলায় মৎস্যজীবীর সংখ্যা ৮৮ হাজার ৫৬৩ জন। অনুসন্ধানে দেখা যায় সীমান্তবর্তী এই জেলায় প্রতিবছরই মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে। একইভাবে মাছনির্ভর ব্যবসা-বাণিজ্যেরও সম্প্রসারণ ঘটছে। জেলায় মাছের আড়তদারও বেড়েছে। মৎস্যজীবীরা বলেছেন, বিল শুকিয়ে এবং বিষ দিয়ে মাছ ধরা বন্ধ হলে মাছের উৎপাদন বহুগুণ বেড়ে যাবে। একই সঙ্গে সম্ভাবনাময় এই খাতে নজরদারি ও যতœ বাড়াতে হবে। বছরের ৬ মাস জেলার বেশিরভাগ এলাকা থৈ- থৈ করে পানিতে। জেলায় হাওড় রয়েছে ৮২টি। এই হাওড়গুলোয় বিল বা জলমহালের সংখ্যা ৯৭৬টি। ইজারাদার না শুকালে এই জলমালগুলোয় সারা বছরই পানি থাকে। পুকুরের সংখ্যা ১৭ হাজার ২৯ টি। সরকারী হিসাবে ২০১১ সালে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৬৫ হাজার ৮৮৭ মে.টন, উৎপাদন হয়েছে ৬৫ হাজার ১৬১ মে.টন। ২০১২ সালে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৬৮ হাজার ৪৭৫ মে.টন, উৎপাদন হয়েছে ৬৮ হাজার ৫৮১ মে.টন। ২০১৩ সালে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৭০ হাজার ৩৬৬ মে.টন, উৎপাদন হয়েছে ৭০ হাজার ৩৭২ মে.টন। ২০১৪ সালে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৭৪ হাজার ২৫০ মে.টন, উৎপাদন হয়েছে ৭৪ হাজার ৩৮৫ মে.টন। ২০১৫ সালে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৭৬ হাজার ৮৬১ মে.টন, উৎপাদন হয়েছে ৭৬ হাজার ৭৫৬ মে.টন। অর্থাৎ গত ৫ বছরে মাছের উৎপাদন বেড়েছে। জেলাব্যাপী মাছের আড়তও বেড়েছে। মাছের আড়তে অসংখ্য বেকার লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে। হাওড়াঞ্চলে মৎস্য প্রকল্প বাস্তবায়নরত সিলেটের দুটি বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থার দু’জন কর্মকর্তা এবং সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনজন শিক্ষক জানান, সিলেটে ৪ লাখ ৭০ হাজার ৫৫৬ হেক্টর হাওড়, বিল ও জলাশয় রয়েছে। এসব উৎস থেকে প্রতিবছর প্রায় সোয়া লাখ থেকে দেড় লাখ মেট্রিকটন মাছ আহরণ করা হয়। তবে এক দশক আগে মাছ আহরণের পরিমাণ আরও বেশি ছিল। কারণ জলবায়ুর পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবের কারণে দেশী প্রজাতির অনেক মাছের বংশবিস্তার হচ্ছে না। আগের মতো হাওড়ে পর্যাপ্ত পানি না থাকা, ‘পাইল ফিশিং’ (দু-তিন বছর নির্দিষ্ট এলাকায় মাছ না ধরা) না হওয়া এবং হাওড়ে নতুন পানি আসার সময় জাল দিয়ে অবাধে মাছ ধরা অব্যাহত থাকলে কিছুদিন পর হাওড়গুলো মাছশূন্য হয়ে পড়বে। এশিয়ার বৃহত্তম হাওর হাকালুকিতে শুধু প্রাণী সম্পদ বিভাগের ক্ষতি হয়েছে ২৬ কোটি ১০ লাখ টাকা। সাম্প্রতিক বন্যায় হাওড় অঞ্চলের সাত জেলায় গড়ে ৭৫ ভাগ ফসল বিনষ্ট হয়েছে। এতে ২২ লাখ টন ধান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ১১ লাখ ৩৪ হাজার ৬০০ পরিবার। প্রায় দুই হাজার টন মাছ এবং ৩০ হাজার হাঁস মারা গেছে। প্রায় এক হাজার টন সবজি নষ্ট হয়েছে। সব মিলিয়ে অর্থের হিসাবে ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ১৩ হাজার কোটি টাকা। মাঠপর্যায়ের জরিপে এসব তথ্য উঠে এসেছে বলে জানিয়েছে বেসরকারী সংগঠন পরিবেশ ও হাওড় উন্নয়ন সংস্থা। বর্তমানে সিলেট বিভাগে কৃষি পরিবারের সংখ্যা ১১ লাখ ১৯ হাজার ৩৮৮, যা ১০ বছর আগেও ছিল প্রায় দ্বিগুণ। সিলেট বিভাগের চার জেলায় এবার ৪ লাখ ৫৬ হাজার ৮৩৫ হেক্টর জমিতে বোরো চাষ হয়েছে। এর মধ্যে সুনামগঞ্জ জেলায় ২ লাখ ১৫ হাজার ৯১৭, হবিগঞ্জ জেলায় ১ লাখ ১৩ হাজার ৬০০, সিলেট জেলায় ৭৬ হাজার ৮৩৩ ও মৌলভীবাজার জেলায় ৫০ হাজার ৪৮৫ হেক্টর জমিতে চাষাবাদ করা হয়, যা থেকে ১৮ লাখ টন চাল উৎপাদন হওয়ার কথা। চলবে... লেখক : সাংবাদিক
×