ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

ডি.এম তালেবুন নবী

চাঁপাইয়ের জঙ্গী আস্তানার নেপথ্যে

প্রকাশিত: ০৪:০০, ৬ মে ২০১৭

চাঁপাইয়ের জঙ্গী আস্তানার নেপথ্যে

(গতকালের পর) আটককৃতদের একজন সোনামসজিদ সীমান্তের বালুয়াদীঘি গ্রামের আব্দুস সাত্তারের ছেলে আবুল কালাম ও অপরজন দুর্লভপুর ইউপির কালুপুরের সাহাবুদ্দিনের ছেলে সাদেকুল। তাদের প্রধান হোতা ঈশ্বরদীর আনোয়ার হোসেন এখনও পলাতক। বন্দরের ৩ নং গেট এলাকার শরিফুলের বাড়িতে অভিযান চালিয়ে জালনোটের মেশিন উদ্ধার করে। পাওয়া যায় এক হাজার টাকার নোট ৪৯টি, ৫শ’ টাকার নোট তিনটি ও ২০ টাকার ৯০টি। সবই ভারতীয় জালনোট। আইন প্রয়োগকারীদের জিজ্ঞাসাবাদের মুখে তারা স্বীকার করে সীমান্তে এ ধরনের একাধিক কারখানা রয়েছে। সিন্ডিকেট করে ভারতীয় অর্থে সীমান্তে এসব জালনোটের ব্যবসা করছে। ছয় মাসে শত শত কোটি টাকার জালনোট ছাপানোর কথা স্বীকার করে। পলাতক ঈশ্বরদীর আনোয়ার হোসেন ধরা পড়লে নানান তথ্য বেরিয়ে আসবে। জানা গেছে, বাংলাদেশের মধ্যে সীমান্তের এসব কারখানায় ভারতীয় জালনোট ছাপে। অনুরূপভাবে ভারতীয় এলাকার মধ্যে সীমান্তে বাংলাদেশের জালনোট ছাপানোর একাধিক কারখানার কথা স্বীকার করে তারা। উভয় দেশের জালনোট ছাপানোর ব্যাপারে উভয়পক্ষের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে। এখন এ ব্যাপারে আইন প্রয়োগকারীরা তদন্তের স্বার্থে মুখ খুলতে চায়নি। পাশাপাশি এদের মাধ্যমে বিস্ফোরক এবং অস্ত্রের চালান ও চোরাচালান বেড়ে যায়। ধারণা করা হচ্ছে জালনোট সিন্ডিকেটের সঙ্গে অস্ত্র, বিস্ফোরক ও মাদক ব্যবসায়ীদের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ও সম্পৃক্ততা রয়েছে। শিবগঞ্জের ঘটনার সপ্তাহখানেকের মধ্যে ঢাকার মোহাম্মদিয়া হাউজিংয়ের সাততলা থেকে পাঁচজনকে আটক করে। এরা হচ্ছে বুলবুল আহম্মেদ, খাইরুল ইসলাম, শামসুল হক, শাহীন আখতার ও আলমগীর হোসেন। এদের মধ্যে শামসুল হকের বাড়ি চাঁপাইয়ে। ঢাকার পুলিশের উত্তর বিভাগের উপকমিশনার শেখ নাজমুল আলম এদের কাছ থেকে জালনোট তৈরির সরঞ্জামসহ ১৫ লাখ ৩৪ হাজার টাকা উদ্ধার করেন। তিনি জানান, এই চক্রের সঙ্গে পাকিস্তান কানেকশন রয়েছে। তারা পাকিস্তান থেকে জালনোট তৈরির ট্রেনিং নিয়েছে। ভারতে জালনোট বিক্রির একাধিক প্রতিনিধি রয়েছে। চক্রটি চাঁপাইয়ের শিবগঞ্জ ও বেনাপোলের সীমান্ত এলাকায় জাল রুপী বিক্রি করে থাকে। এর কয়েকদিন আগে খাইরুল একবার ধরা পড়েছিল। তখন তার কাছে ভারতীয় বেশ কিছু রুপী পাওয়া যায়। তাদের তথ্যের ভিত্তিতে ঢাকায় মোহাম্মদিয়া হাউজিংয়ের সাততলার একটি ফ্ল্যাট হতে বাকিদের আটক করা হয়। জঙ্গীরা বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তান কানেকশনে খুবই পটু। জঙ্গীদের অপর একটি ইউনিট বিস্ফোরক বহন ও অস্ত্র, মাদক চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত। বেশ কিছুদিন ধরে সীমান্তপথে ব্যাপকহারে আসছিল গান পাউডার, এখনও আসছে। গত তিন মাসে কয়েকশ’ কেজি গান পাউডার ধরা পড়েছে। একটি সূত্র নিশ্চিত করে চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও পার্শ্ববর্তী গোদাগাড়ি সীমান্তপথে গত ৪ মাসে হাজার কেজির অধিক গান পাউডারের চালান এসেছে যা নির্বিঘেœ গিয়ে ঢুকেছে চাঁপাইয়ের জঙ্গী আস্তানায়। এসেছে ছোট সেফ অস্ত্রের কয়েকশ’ চালান। এই বাড়িতে বিভিন্ন সীমান্তপথে আসা বিস্ফোরক মজুদ করা হতো। মজুদকৃত বিস্ফোরকে অন্যান্য উপকরণ মিশিয়ে সেখানেই শক্তিশালী গ্রেনেড তৈরি হতো। পরে বিভিন্ন স্থানের জঙ্গীরা এসে তা নিয়ে যেত। গোয়েন্দা সংস্থার ধারণা অভিযানকালে বার বার জঙ্গীদের আত্মসমর্পণ করার আহ্বান জানালে তা ছুড়ে মারত আইন প্রয়োগকারীদের প্রতি। গ্রেনেড বা বিস্ফোরক শেষ হবার আগে সর্বশেষ গ্রেনেড বিস্ফোরণ ঘটিয়ে জঙ্গীরা আত্মহত্যা করে। এই আখড়া থেকে মাত্র চারটি বোমা উদ্ধার করা হয়। এখানে উল্লেখ্য, ত্রিমোহনীর আম বাগান ঘেরা আধাপাকা বাড়িতে দু’দিনের সফল অভিযান শেষে চারজনের লাশ, আগ্নেয়াস্ত্র, সুইসাইডাল ভেস্ট উদ্ধার হয়। চারজনের মধ্যে রফিকুল আলম বাবুর লাশ চেনা যায়। দু’জন আত্মঘাতী ও অপর দু’জন পুলিশের গুলিতে মারা যেতে পারে বলে ধারণা করা হলেও শরীর ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। আবুর স্ত্রী সুমাইয়া ও শিশু সন্তানকে জীবিত উদ্ধার করা সম্ভব হয়। মজুদ বিপুল পরিমাণ অস্ত্র কদিন আগেই সরিয়ে ফেলা হয়েছিল বলে জানা গেছে। শিশু সন্তান সাজিদা এখন সেফ হোমে। আর সুমাইয়া রাজশাহী মেডিক্যালে চিকিৎসা নিচ্ছে। এই সুমাইয়াকে প্রধান আসামি করে বহু অজ্ঞাতনামার নামে মামলা হয়েছে। নির্ভরযোগ্য সূত্র নিশ্চিত করেছে জঙ্গী আবু মাঝে-মধ্যে ভারতে গিয়ে অস্ত্র, বিস্ফোরক ও মাদকের অর্ডার দিয়ে আসত। নিয়ে আসত অঢেল অর্থ। যা সরবরাহ করত ভারতীয় জঙ্গীরা। চাঁপাইয়ের জঙ্গী আস্তানার একনিষ্ঠ তত্ত্বাবধানকারী জঙ্গী আবু পুরো দেশের অস্ত্রসহ নানান ধরনের বিস্ফোরক সরবরাহ ও পাহারা দিত। এছাড়া এই নির্জন আম বাগানে নানান ধরনের ট্রেনিং হতো। এখানে শীর্ষস্থানীয় জঙ্গীরা প্রায়ই আসত। তারাই আস্তানাটি পরিচালনায় অর্থ যোগান দিত। অনুমান করা হচ্ছে জঙ্গী আবুর স্থানীয় শতাধিক সঙ্গী যারা বাইরে ছিল তারা এই মুহূর্তে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে গেছে। তাদের অধিকাংশ সীমান্ত অতিক্রম করেছে। তাদের একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে শিবগঞ্জ ও ভোলাহাটের একাধিক স্থানে ও বরেন্দ্র অঞ্চলে অনুরূপ জঙ্গী আস্তানা থাকার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। তবে শিবগঞ্জের আস্তানাটি ছিল সমগ্র দেশের মধ্যে অন্যতম প্রধান কেন্দ্র বলে অনেকেই ধারণা করছে। তাই এখনও রয়েছে পুলিশের নজরদারিতে। (সমাপ্ত) লেখক : সাংবাদিক
×