ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

প্রস্তাবিত বাজেটে আসছে প্রণোদনা

শতভাগ চাহিদা পূরণ করছে দেশীয় পোল্ট্রি শিল্প

প্রকাশিত: ০৩:৫১, ১ মে ২০১৭

শতভাগ চাহিদা পূরণ করছে দেশীয় পোল্ট্রি শিল্প

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ তৈরি পোশাক খাতের পর দেশে বিপ্লব ঘটাতে যাচ্ছে পোল্ট্রি শিল্প। কয়েক দশক ধরে দেশের পোল্ট্রি শিল্পে ক্রমাগত উন্নতি ঘটছে। বর্তমানে ২৫ লাখ মানুষ প্রত্যক্ষভাবে এ খাতে সম্পৃক্ত। পরোক্ষভাবে কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে ৬০ লাখ মানুষের। পরিস্থিতি বিবেচনায় আগামী ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেটে এ খাতে বিশেষ পদক্ষেপ নেয়ার ঘোষণা দিয়েছে সরকার। খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, মেধাবী ভবিষ্যত প্রজন্ম গড়তে পুষ্টির ঘাটতি পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলছে পোল্ট্রি শিল্প। দেশ এখন মুরগির ডিম ও মাংসে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে এ খাতের অবদানে। বর্তমানে বাংলাদেশের মোট মাংসের চাহিদার ৪০ থেকে ৪৫ শতাংশই এ শিল্প থেকে আসছে। বর্তমান বাজারে যে পরিমাণ ডিম, মুরগি, বাচ্চা এবং ফিডের প্রয়োজন তার শতভাগ এখন দেশীয়ভাবেই উৎপাদিত হচ্ছে। দেশের ডিম ও মাংসের শতভাগ চাহিদা পূরণ করার পাশাপাশি অতিরিক্ত উৎপাদনও করছে এ শিল্প। এমনকি দেশীয় চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রফতানির প্রস্তুতিও নিচ্ছে দেশীয় কোম্পানিগুলো। এর মধ্যে বাজেটে সরকারের বিশেষ পদক্ষেপ থাকলে এ শিল্প আগামীতে তৈরি পোশাক খাতকেও ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে মন্তব্য করেছেন সংশ্লিষ্টরা। বেসরকারী গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, বর্তমানে দেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রায় এক শতাংশ আসে পোল্ট্রি শিল্প থেকে। গার্মেন্টসের পর এটিই দ্বিতীয় বৃহত্তম কর্মসংস্থান সৃষ্টিকারী খাত। ব্রিডার্স এ্যাসোসিয়েশনের হিসাব অনুযায়ী মুরগির মাংসের দৈনিক চাহিদা এক হাজার ৪০০ মেট্রিক টন অথচ উৎপাদিত হয় এক হাজার ৫০০ মেট্রিক টন। ডিমের দৈনিক চাহিদা এক কোটি ৫০ লাখ পিস, সেখানে দৈনিক উৎপাদন হয় এক কোটি ৬০ লাখ পিস। একদিন বয়সী মুরগির বাচ্চার সাপ্তাহিক চাহিদা ৮৫ লাখ পিস, উৎপাদন ৯৫ লাখ পিস। ভোক্তা একটি ডিম কিনছেন আট টাকায়, যেখানে উৎপাদন খরচ প্রায় ৫ টাকা। খামারিরা প্রতিটি ডিম বিক্রি করছে মাত্র ৪ দশমিক ৩০ টাকায়। সূত্র জানায়, বাংলাদেশে পোল্ট্রি শিল্পের শুরুটা মোটেও আশাব্যঞ্জক ছিল না। সাধারণ মানুষ পোল্ট্রির ডিম কিংবা ব্রয়লার মুরগির মাংস খেতেই চাইত না। পোল্ট্রির মাংস যে কতটা সুস্বাদু, নরম এবং স্বাস্থ্যসম্মত তা বোঝাতে শুরুর দিকের উদ্যোক্তাদের অতিথি ডেকে এনে রান্না করা মাংস পরিবেশনও করতে হয়েছে। আশির দশকে এ শিল্পে বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল মাত্র দেড় হাজার কোটি টাকা আর বর্তমানে এ শিল্পে বিনিয়োগের পরিমাণ ২৫ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। পোল্ট্রি উদ্যোক্তা ও খামারিদের অক্লান্ত পরিশ্রম, ত্যাগ এবং সরকারের আন্তরিক সহযোগিতার কারণেই এ অসাধ্য অর্জন সম্ভব হয়েছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। মাত্র তিন যুগের ব্যবধানে সম্পূর্ণ আমদানিনির্ভর খাতটি এখন অনেকটাই আত্মনির্ভরশীল। বর্তমানে পোল্ট্রি মাংস, ডিম, একদিন বয়সী বাচ্চা এবং ফিডের শতভাগ চাহিদা মেটাচ্ছে বাংলাদেশের পোল্ট্রি শিল্প। এখানে যেসব মানুষের জীবন-জীবিকা জড়িত, তার প্রায় ৪০ শতাংশই নারী। গ্রামীণ অর্থনীতিতে, নারীর ক্ষমতায়নে কৃষির পরই সবচেয়ে বড় অবদান রাখছে বাংলাদেশের পোল্ট্রি শিল্প। জানা গেছে, বর্তমানে সারাদেশে প্রায় ৬৫-৭০ হাজার ছোট-বড় খামার রয়েছে। এছাড়াও আছে ব্রিডার ফার্ম, হ্যাচারি, মুরগির খাবার তৈরির কারখানা। পোল্ট্রি শিল্পকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে লিংকেজ শিল্প, কাঁচামাল ও ওষুধ প্রস্তুতকারক এবং সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান। জাতীয় অর্থনীতিতে পোল্ট্রি শিল্পের অবদান প্রায় ২ দশমিক ৪ শতাংশ। তবে এ পরিমাণ ক্রমশ বাড়ছে। খাতসংশ্লিষ্টদের মতে, বর্ধিত জনসংখ্যার খাদ্য ও পুষ্টির চাহিদা পূরণ করতে হলে পোল্ট্রি শিল্পের আকার আরও বাড়াতে হবে। কারণ এটিই একমাত্র খাত, যা ভার্টিক্যালি বাড়ানো সম্ভব। জানা গেছে, বর্তমান সরকার ২০২১ সাল নাগাদ জনপ্রতি বার্ষিক ডিম খাওয়ার গড় পরিমাণ ১০৪টিতে উন্নীত করার লক্ষ্য নিয়ে কাজ শুরু করেছে। প্রাণিজ আমিষের চাহিদা পূরণে সরকারের এ লক্ষ্য বাস্তবায়ন করতে হলে ২০২১ সাল নাগাদ দৈনিক প্রায় সাড়ে চার কোটি ডিম এবং দৈনিক প্রায় তিন দশমিক পাঁচ থেকে চার হাজার মেট্রিক টন মুরগির মাংস উৎপাদনের প্রয়োজন হবে। আরও জানা গেছে, এসব বিবেচনায় নিয়ে এ খাত বিকাশে বিশেষ জোর দিচ্ছে সরকার। পোল্ট্রি শিল্পের উন্নয়নে প্রয়োজনে শিল্পটির জন্য বিশেষায়িত জোন করা হতে পারে বলে জানিয়েছেন পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এ বিষয়ে সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি আরও বলেন, পোল্ট্রি শিল্পের সম্ভাবনা অনেক বেশি। সরকার এ খাতের বিকাশে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে। কিন্তু এ শিল্প কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছানোর পথে কিছু প্রতিবন্ধকতার কথা বলেছেন তিনি। মন্ত্রী বলেন, প্রধান সমস্যা হলো, এ খাতের সবাই একসঙ্গে কাজ করতে পারছে না। এ খাতে একেক সময় একেক গ্রুপের সৃষ্টি হয়। বড় এবং ছোট কোন খামারি না বলে সবাই যখন এক হয়ে কাজ করতে পারবে তখনই এ খাত কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছতে পারবে। এদিকে, পোল্ট্রি শিল্পের উন্নয়নে আগামীতে বিশেষ পদক্ষেপ নেয়ার ইঙ্গিত দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। সম্প্রতি প্রাক-বাজেট আলোচনায় তিনি বলেছেন, পোল্ট্রি শিল্প গ্রামীণ আর্থসামাজিক উন্নয়ন ও অধিক কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে ব্যাপক সম্ভাবনাময় খাত। সরকার এ শিল্পের উন্নয়নে আগামী বাজেটে বিশেষ পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, আগামী অর্থবছরের বাজেটকে সামনে রেখে এ খাতের কিছু বিষয় সমন্বয় করার পরিকল্পনা রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হলোÑ পোল্ট্রি খাদ্যের উপকরণ আমদানিতে অগ্রিম আয়কর কমানো বা প্রত্যাহার, সয়াবিন মিল আমদানির ওপর থেকে কাস্টমস শুল্ক কমানো, ভেজিটেবল প্রোটিন হিসেবে ব্যবহৃত ডিডিজিএস এসআরওতে অন্তর্ভুক্তিকরণ, আমদানিকৃত পণ্যের এইচএস কোডজনিত জটিলতা নিরসন এবং কাঁচামাল আমদানিকারক ও সরবরাহকারীদের ওপর থেকে সব ধরনের পরোক্ষ কর প্রত্যাহার, আয়কর কমানো প্রভৃতি। একই সঙ্গে আগামী তিন বছরের মধ্যে দেশের পোল্ট্রি শিল্পে মাংস ও ডিমের উৎপাদন দ্বিগুণ করার আহ্বানও জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে মন্ত্রী বলেছেন, এ খাতে স্বল্প পুঁজি বিনিয়োগ করে আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার পাশাপাশি দরিদ্র জনগোষ্ঠীর পুষ্টির চাহিদাও পূরণ করা সম্ভব। এছাড়া পোল্ট্রি ফিডসহ এ শিল্পের অন্য উপ-খাতগুলোও অর্থনৈতিকভাবে চাঙ্গা হয়ে উঠছে।
×