বটতলায় মেলা বসেছে। বৈশাখী মেলা। প্রতিবছরের মতো এবারও। টুনটুন তার বারবি ডল এখনও মেলায় খুঁজে পায়নি। সন্জন্ সমানতালে ঘ্যান্ ঘ্যান্ করে যাচ্ছে- আমি টমটম নেব- আমি টমটম নেব...।
রন্জন্ টুনটুন আর সন্জন্কে নিয়ে মেলায় এসেছে। টুনটুন রন্জনের চাচাত বোন। শহরে থাকে। চৈত্রসংক্রান্তিতে প্রতিবছরের মতো এবারও দেশের বাড়িতে এসেছে। টুনটুন শহরের কিন্ডার গার্টেনের স্টান্ডার্ট ওয়ানের ছাত্রী। সন্জন্ রন্জনের ছোট ভাই। দু’ভাইয়ের বয়সের ব্যবধান প্রায় সাত বছরের। গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সন্জন্ প্রথম শ্রেণীতে পড়ে। রন্জন্ গঞ্জেরহাটের মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে সপ্তম শ্রেণীর ফার্স্ট বয়।
সোনা দীঘি। তার দক্ষিণ-পশ্চিম পাড়ের সেই বিশাল বটগাছ। এক শ’ বছরেরও বেশি বয়স। চারদিকে ডালপালা ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বটগাছের নিচে অনেকটা জায়গাজুড়ে বটের ছায়া। শীতল ছায়া। পথচারীরা বটগাছের ছায়ায় শরীর জুড়ায়। তার দক্ষিণ পাশে খোলা মাঠ আর মাঠ। হাওয়া এসে বটগাছের ডাল-শাখা পাতার হাত ধরে খেলা করে। আর এ বটতলাজুড়ে দখিন পাশের খোলা মাঠে প্রতিবছরের মতো এবারও মেলা বসেছে।
-আমি বারবি ডল নেব তো ভাইয়া-টুনটুন রন্জন্কে তাগাদা দেয়।
-দেখছি তো তোমার বারবি ডল। কই, কোন দোকানেই তো চোখে পড়ছে না। বারবি ডল গ্রামের এ মেলায় পাওয়া যাবে বলে তো মনে হয় না। আসলে শহরের মেলাতেই বারবি ডল পাওয়া যায়।
-না, আমি বারবি ডল নেব। বাবা বলেছে, গ্রামের মেলা থেকে কিনে নিতে- টুনটুন আবারও রনজনকে তাগাদা দেয়।
-আহা দেখি তো আগে, অন্য কোন দোকানে পাওয়া যায় কিনা। চলো সামনের দিকে গিয়ে দেখি।
Ñভাইয়া, আমি চড়কি নেব- দু’চার কদম এগিয়েই রন্জনের হাত ধরে থামিয়ে দিয়ে চড়কি বিক্রেতার সামনে দাঁড়িয়ে যায় সন্জন্।
-কেন তুমি টমটম কিনবে বলেছ। টমটম নেবে না? তা ছাড়া তুমি তো ঢোল কিনেছ। চড়কিও নেবে নাকি?
বোশেখের দুষ্টু হাওয়ায় রঙিন কাগজে তৈরি চড়কিগুলো ঘুরছে ফর ফর করে।
-হ্যাঁ ভাইয়া আমি চড়কি নেব। দাও না কিনে একটা ভাইয়া। অগত্যা কী আর করা! সন্জনের জন্য চড়কি কেনা হলো।
-টুনটুন, তুমিও একটা চড়কি নেবে নাকি?
-না, আমার বারবি ডল চাই। -আমি বারবি ডল নেব। টুনটুনের সে একটিই কথা- তার বারবি ডল চাই-ই চাই।
টুনটুনের মুখে তার বারবি ডলের কথা শুনে পাশ দিয়ে যাওয়া এক ভদ্রলোক বললেন- তোমরা বারবি ডল কিনবে তো? মেলার অই একেবারে উত্তর পাশের বড় দোকানটাতে চলে যাও। ওখানেই একমাত্র শহরের নামী-দামী, ভাল এবং কিছু পুতুল খেলনা বিক্রি করছে।
মনের মতো বারবি ডল পেয়ে টুনটুন সে কী খুশি। না, তার আর কিছু চাই না। টুনটুন মেলা থেকে আর কিছু নেয়নি।
সন্জন্ তার মাটির তৈরি টমটম রাস্তায় আসার সময় টেনে চালিয়ে এসেছে খানিক দূর পর্যন্ত।
-বাড়িতে যেয়ে ঘরে-বারান্দায় টমটম গাড়ি নিয়ে খেলছে সন্জন্। টমটম হাতে নিয়ে চলো-রন্জন্ তাড়া দেয়।
ঢোল, চড়কি, টমটম পেয়ে সন্জন্ খুশিতে আত্মহারা। বারবি ডল হাতে পেয়ে টুন্টুনের মহাআনন্দ। সন্জন্ নিজের জন্য মেলা থেকে কিছু কিনে নেয়নি। বাড়ির সবার জন্য চিড়ার মোয়া, গজারি, গরম জিলাপি কিনেছে শুধু।
হঠাৎ ধপাস করে পড়ে যাওয়ার শব্দে সেদিক তাকায় সকলে। হায় হায় সন্জন্ পড়ে গেছে! বারান্দার সিঁড়িতে উঠতে গিয়ে পা ফসকে গেছে। তার হাত থেকে ঢোল, চড়কি, টমটম ছিটকে পড়ে গিয়ে মাটিতে গড়াগড়ি যায়।
সর্বনাশ! মাটির তৈরি চাকা দু’টো ভেঙ্গে চুরমার। আর যায় কোথায়! উঠোন কাঁপিয়ে, বাড়ি কাঁপিয়ে, পাড়া কাঁপিয়ে সন্জনের গগনবিদারি কান্না। মেলা থেকে কেনা তার এত সখের টমটম কিনা ভেঙ্গে খান খান হয়ে গেল?
কোন মতেই সন্জনের কান্না থামানোর জো নেই। বাবা, মা, কাকিমা সকলেই বিফল। কাকা বাইরে ছিলেন এতক্ষণ। এসেই শোনেন সন্জনের সিঁড়িতে পড়ে যাওয়ার কথা। কাকা সন্জনকে কোলে তুলে নেন।
-শোনো, লক্ষ্মী সন্জুবাবু। কাকামনির কথা শোনো। আগামী সপ্তাহে তো তোমার ভাইয়া মানে রন্জনের সঙ্গে আমার কাছে শহরে বেড়াতে যাচ্ছ তোমরা। তখন লালদীঘি মেলা বসবে। ওখান থেকেই তোমাকে কাকাবাবু চমৎকার একটি টমটম গাড়ি কিনে দেব। হলো তো- লক্ষ্মী সন্জুবাবু! এবার আর কান্না নয়Ñ কাকার কথায় সত্যি সন্জন্ শান্ত হয়।
রন্জনকে উদ্দেশ করে বলে- ভাইয়া, আমার ঢোল, চড়কি কই? আমাকে দাও। রন্জন্ সন্জনের হাতে তার ঢোল-চড়কি দেয়। ভাগ্যিস টমটমের মতো ঢোল আর চড়কির সত্যি কোনই ক্ষতি হয়নি। সন্জনের গলায় মেলা থেকে কেনা ছোট্ট ঢোল ঝুলিয়ে নেয় আর তার হাতে বৈশাখের দুষ্টু হাওয়ায় রঙিন চড়কি ঘোরে র্ফ র্ফ করে।