ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

শেখ মিরাজুল ইসলাম

ধা রা বা হি ক ॥ উপন্যাস ॥ মোঘল গীবত

প্রকাশিত: ০৬:৪৮, ২১ এপ্রিল ২০১৭

ধা  রা  বা  হি  ক ॥ উপন্যাস ॥ মোঘল গীবত

(পূর্ব প্রকাশের পর) - ওহে আমার খোজা সম্রাট। আবার কাকে হত্যা করতে হবে বলো? - না জাঁহাপনা, কাউকে না। তবে মনে হয় এখন খোদ হিন্দুস্তানকে কুরবানী দেবার সময় হয়ে এলো। আরেক কাঠি সরস বুলন্দ। - বুঝেছি। তোমার নাজির উপাধিটা আর যথেষ্ট মনে হচ্ছেনা। এখন তামাম হিন্দুস্তানে খোজাদের প্রধান পদবী ‘এতবার খান’ হাসিলের খায়েস হয়েছে, তাই না? হিক্কার ঢেঁকুর তুলে পাল্টা খোঁচা মারলেন শাহজাদা। - আয় হায়! না মালিক ... এটা আমার ঐ ফালতু নজরানার চেয়েও অনেক গুরুত্বপূর্ণ। নিজেই একবার দেখুন। বুলন্দ দুই হাতে তালি মেরে গা ঝাঁকিয়ে তার মেয়েলি কণ্ঠে ভারিক্কি আনার চেষ্টা করলো। উরুর ফাঁকে বন্দী মেহজাবীনকে মুক্ত করে সোজা হয়ে বসলেন মুরাদ। হাতে নিয়ে গভীরভাবে পরখ করে দেখলেন শাহজাদা দারা’র হাতের লেখা নকল করা চিঠিটি। মুরাদের গুপ্তচর তা সরাসরি বুলন্দের হাতে পৌঁছে দিয়েছে। - বদমাইশের বাচ্চা! কি ভাবে এই কাফেরটা আম্মাজানের পেটে জন্ম নিল? সুজা’র সঙ্গে যুক্তি করে আমাকে রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলতে চায়? ক্ষোভে-রাগে ফেটে পড়লেন মুরাদ। - শান্ত হন মালিক ...’ বুলন্দ বাঁকা চোখে ইশারা দিয়ে বললো, ‘এমন তো হতে পারে আওরঙ্গাবাদের আওরঙ্গজেব এই চিঠিটি দারা’র নামে নকল করিয়ে আপনাকে উত্তেজিত করতে চাইছেন।’ - থামো তুমি বুলন্দ। বলদের অধম তুমি। তোমার মাথাও কি তোমার ওই নীচেরটার মতো বিকল হয়ে গেছে নাকি? ঝাঁঝের সঙ্গে বললেন মুরাদ। মুরাদের অশ্লীল ইঙ্গিতটা গায়ে মাখলো না চতুর বুলন্দ। একটু মনোক্ষুণœ হলেও মনের ভাব গোপন রাখলো। এইসব কথায় রাগ অভিমান দেখাবার সময় এখন নয়। অনেক কষ্টে সাধারণ খোজা প্রহরী হতে এই অবস্থানে এসেছে বুলন্দ। শুরুতে তার প্রধান কাজ ছিল হেরেমের বেগম-বাঁদীদের জন্য বাহির হতে আনা জিনিসপত্র পরীক্ষা করে দেখা। বিশেষ করে সবজির বাজারগুলো ভালোভাবে পাহারা দিতে হতো। হেরেমে অসুখী অতৃপ্ত নারীরা স্বমেহনের জন্য বেগুন, শসা, মুলা এই জাতীয় সবজি ব্যবহার করতেন। তাই সেগুলো বিশেষ হুকুমে ভেতরে ঢোকানো নিষেধ ছিল। অথচ বুলন্দ প্রধান মহিয়সীদের কোন জিনিসই পরীক্ষা করতো না। ফলে তাদের প্রিয়পাত্র হওয়া তার জন্য সহজ হয়ে গেল। এমনকি প্রয়োজনে রাজমহীয়সী ও বাছাই করা দাসীদের জন্য বুলন্দ তাঁদের গোপন প্রেমিকদেরও অন্দর মহলে ঢোকার বন্দোবস্ত করে দিতো। ইশারায় মেহজাবীনকে চলে যেতে বললো বুলন্দ। বুকের কাছে ওড়না পেঁচিয়ে নিঃশব্দে পালিয়ে বাঁচলেন মেহজাবীন। তাঁর অনাবৃত নিতম্বের ঢেউ খেলানো সৌন্দর্যের দিকে এক ঝলক তাকিয়ে বুলন্দ মুখস্থের মতো বলতে থাকে, - জাঁহাপনা, আমি কি আপনার অমঙ্গল চেয়েছি কোন দিন? তখত-ই-তখতের লড়াইটা এতো সহজ নয় তা আমার চেয়ে আপনি ভালো বোঝেন। - তা জানি বলেই তো দারা’র শয়তানি চাল টের পেয়ে গেছি। একদিকে সে বাজারে গুজব ছড়াবে সম্রাট অসুস্থ। তারপর আবার হিন্দু বৈদ্য দিয়ে আব্বাজানের চিকিৎসা করিয়ে আমাদের ঈমানী ঐক্যে ফাটল ধরাবে। সম্রাটকে পুতুল বানিয়ে নিজেই এখন হিন্দুস্তানের বাদশাহ সাজতে সুজার সঙ্গে হাত মেলাচ্ছে। কেন, আমরা বাকীরা কি সব মরে গেছি? আমাদের রক্তে কি তৈমুরের রক্ত নেই? মুরাদ অস্থিরভাবে পায়চারী করতে থাকলেন। - আরো খবর শুনেছি হুজুর। সুজা নাকি বাংলায় বসে নিজেকে সম্রাট ঘোষণা করেছেন। - বুলন্দ! থামলে ভালো লাগে। আর কোন গুজবে আমি কান দেবো না। সময় চলে যাচ্ছে। আমি যত তাড়াতাড়ি পারি আমার ভাই আওরঙ্গজেবকে চিঠি দিয়ে অবিলম্বে দিল্লি আক্রমণের ইচ্ছে জানাবো। - তারপর? জানতে চায় বুলন্দ। - আর কি? আমি আর আওরঙ্গজেব এক হলে কেউ আমাদের ঠেকাতে পারবে না। এরপর আমি দিল্লির বাদশাহ হলে আওরঙ্গজেব’কে বাংলার সুবেদার হিসেবে নিয়োগ দেবো। ওটাই তো এখন সবচেয়ে ঐশ্বর্যশালী রাজ্য। আর শুনেছি ওখানকার মেয়েগুলো নাকি অনেক কোমল আর লম্বা চুলের সেই রকম সুন্দরী? আমুদে গলায় হাসলেন মুরাদ। বুলন্দ শ্লেষের হাসি দিয়ে মনে মনে গজরাতে থাকে - ‘আহাম্মকের বাচ্চা আর কাকে বলে? সারাদিন তো থাকিস নেশার জগতে আর ঘুমাস বাঁদীদের পাছার তলায়! তুই কি করে বুঝবি আওরঙ্গজেব-দারা’র বুদ্ধি আর শক্তি। খামোখা তোর পিছনে জীবন নষ্ট করলাম।’ বুলন্দের দৃঢ় বিশ্বাৃস, ভাষার গঠনেই বলে দিচ্ছে এই চিঠি অবশ্যই নকল করা এবং এটা আওরঙ্গজেবের কাজ। তিনি ছাড়া এত সূক্ষ্ম জালিয়াতি কারো পক্ষে করা সম্ভব নয়। পরদিন সকালে মুরাদ তাঁর একান্ত সভাসদদের খাস কামরায় ডেকে পাঠালেন। পাশে যথারীতি মেহজাবীন ঘুমাচ্ছিলেন। মুরাদ তাঁর মনোকামনা মিটিয়ে মেহজাবীনের গায়ে ঠিকমত কাপড় জড়াতে দেন নি। এভাবে অর্ধনগ্ন করে রাখতেই মুরাদের বিশেষ আনন্দ। কক্ষে ঢুকেই সভাসদরা বিব্রত বোধ করলেন। গুজরাটের প্রধান উজির ইমাম-উল-মুলক ইমতিয়াজ বেগের বয়স ঊনআশি বছর। মুরাদের মূল পরিকল্পনা ও দিল্লি দখলের বাসনা শুনে বিজ্ঞ ইমতিয়াজ বেগ শুরু হতেই অস্বস্তি বোধ করছিলেন। সেই মুহূর্তে এই খোলামেলা বাঈজীর সামনে আরো লজ্জিত হয়ে পড়লেন। শাহজাদা মুরাদের ভ্রুক্ষেপ নেই কোন। - আমাদের করণীয় কি জনাব? সাহস করে চোখ নামিয়ে ইমতিয়াজ বেগ আলোচনার সূত্রপাত করলেন। তিনিও প্রয়াত অর্থমন্ত্রী আলী নকীর মতো বাদশাহ শাহজাহানের একান্ত গুণগ্রাহী। - কেন বুলন্দ কি আপনাদের এখানে আসার আগে সব কিছু বিশদভাবে বলেনি? পাল্টা জানতে চাইলেন মুরাদ। - জী, মহামান্য শাহজাদা। শুনেছি আপনি দিল্লি অভিমুখে সশস্ত্র অভিযানের ইচ্ছে পোষণ করেছেন। তা আপনি করতেই পারেন। সেক্ষেত্রে যদি আমাদের বাদশাহের মৃত্যু সংবাদটা সহী হতো তবেই তা আমার বিবেচনায় সঠিক হতো। কিন্তু আমরা তো জেনেছি বাদশাহ আলমপনা ক্রমে আরোগ্যের পথে। তিনি জীবিত থাকা অবস্থায় শুধুমাত্র শাহজাদা দারা’কে হটাতে দিল্লি অভিমুখে তাঁর অনুমতি ব্যতীত যাত্রা করা রীতিমত বিদ্রোহের শামিল। তাই না? মাথা নীচু করে ঋজুকণ্ঠে বললেন প্রবীণ ইমতিয়াজ বেগ। হাতটা তলোয়ারের বাঁটের দিকে প্রায় চলে যাচ্ছিল মুরাদের। তা সভয়ে লক্ষ্য করছিলেন সেনাপতি বক্স খান, অমাত্য পীর মোহাম্মদ, গোলন্দাজ বাহিনীর প্রধান বুঘারা খান ও ঘোড়সওয়ার বাহিনীর প্রধান শাহবাজ খান। নিজেকে সামলে অট্টহাসি দিলেন মুরাদ। - কেন, আপনার কি স্মরণ নেই কিভাবে আমার দাদা-পরদাদা’রা এক ভাই আরেক ভাইকে হত্যা করেছিলেন? ছেলে বাপকে হটিয়ে সিংহাসন দখল করেছিলেন? এর আগেও তৈমুর বংশে এই ধারা চলে এসেছে। যে শক্তিমান সেই টিকে থাকবে। এটা তো বাচ্চার হাতের লাড্ডু নয়, চাইলেই কেউ আপনাকে দিয়ে দেবেন? জনাব ইমতিয়াজ বেগ! আপনি আজ নীতি কথার বুলি ছাড়ছেন। আপনার কি মনে নেই আমাদের পিতাজান খোদ তাঁর পিতা জাহাঙ্গীরের অবাধ্য হয়েছিলেন ও ক্ষমতায় বসার জন্য কাশ্মীর হতে আগ্রা ফেরার আগেই সব ভাইদের ঠাণ্ডা মাথায় হত্যা করেছিলেন? কোথায় ছিল তখন আপনার এই সত্য বচন? - যথাযথ বলেছেন মহামান্য শাহজাদা। কিন্তু এই শেষ বয়সে এই রকম অভিযানের ধকল আমার পক্ষে নেয়া সম্ভব নয়। আপনি অনুমতি দিলে আমি খুশ দিলে আমার দায়িত্ব হতে অব্যাহতি চাচ্ছি। নিজ অবস্থানে অনড় থাকলেন বৃদ্ধ ইমতিয়াজ বেগ। মুরাদ আবারো সবাইকে অবাক করে দিয়ে চরম ধৈর্য দেখিয়ে রাগ দমন করে দাঁতে দাঁত চেপে বললেন, - ঠিক আছে মন্ত্রীজী। দেখতেই পাচ্ছি বুড়ো হাড়ে আপনার ঘাস জন্মেছে। আবেদন মঞ্জুর করা হলো। আপনি এখন যেতে পারেন। আলোচনার ফাঁকে এক প্রহরী নিঃশব্দে একপ্রস্থ মসলিন এনে দিলেন মেহজাবীনকে। তা বুকে জড়িয়ে প্রাসাদের ভেতর সেই অবস্থাতেই মুরাদের অনুমতি না নিয়েই দৌড় দিলেন মেহজাবীন। বাকী সভাসদরা একদৃষ্টে সেই অপলক সুন্দর দৃশ্যের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। যথাশীঘ্র মাত্র প্রতি বারো মাইল অন্তর দূরত্বের মধ্যে ডাক-চিঠি’র ঘাঁটি স্থাপন করা হলো আওরঙ্গজেব ও মুরাদের মধ্যে যোগাযোগ সুস্থাপনের জন্য। দুই ভাইয়ের মতের আদান- প্রদানের সুবিধার্থেই এই ব্যবস্থা। কিন্তু মুরাদের যুদ্ধ যাত্রার আগাম সংবাদটি আওরঙ্গজেব ভালোভাবে নিলেন না। “নিষ্কর্মা বেত্তমিজটাকে নিয়ে আর পারা গেল না। আমার মতামতের অপেক্ষা না করেই তোড়জোড় শুরু করে দিল? চূড়ান্ত আঘাত হানার আগে অনেক জরুরী কাজ বাকী ...।” মুরাদের পাঠানো চিঠিটা মাটিতে ছুঁড়ে উষ্মা প্রকাশ করলেন আওরঙ্গজেব। তিনি অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন বাানারস হতে কি খবর আসে তার জন্য। সব কিছু ঠিকমতো এগুলে সেখানে কিছুদিনের মধ্যে মুখোমুখি হবে সুলায়মান ও সুজার সৈন্যদল। (চলবে)
×