ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০৮ মে ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪৩১

প্রাথমিক শিক্ষায় তালগোল

প্রকাশিত: ০৪:০৮, ১৮ এপ্রিল ২০১৭

প্রাথমিক শিক্ষায় তালগোল

জাতীয় শিক্ষানীতিতে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষার কথা বলা হলেও তা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে তালগোল পাকিয়ে ফেলেছে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়। গোল বেঁধেছে পঞ্চম শ্রেণী ও ৮ম শ্রেণীতে গত কয়েক বছর ধরে অনুষ্ঠিত সমাপনী পরীক্ষা নিয়েও। ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত প্রাথমিক স্তর হলে ৫ম শ্রেণীর পরীক্ষা অপ্রয়োজনীয় ও অগ্রহণযোগ্য অথচ এ নিয়েও কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না মন্ত্রণালয়। ফলে রীতিমতো দুশ্চিন্তা ও টানাপোড়েনে রয়েছে প্রায় আড়াই কোটি শিক্ষার্থী ও অভিভাবক। তদুপরি রয়েছে ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়নের সমস্যা। অধিকাংশ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়ার অবকাঠামো ও শিক্ষক নেই। এই মুহূর্তে ৪৮ হাজার সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ১৫ হাজার প্রধান শিক্ষক এবং ৪৮ হাজার সহকারী শিক্ষকের পদ শূন্য রয়েছে। এ নিয়ে কোন হেলদোল নেই শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও প্রাথমিক গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে। এ দুয়ের মধ্যে সমন্বয় পর্যন্ত নেই। চলতি বছর থেকে প্রাথমিক শিক্ষা ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত উন্নীত হওয়ার প্রেক্ষাপটে প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছিলেন, এবার থেকে ৫ম শ্রেণীর সমাপনী পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে না। এ নিয়ে প্রায় আড়াই কোটি প্রাথমিক-এবতেদায়ী শিক্ষার্থী ও অভিভাবক কিছুটা হলেও আশ্বস্ত হয়েছিলেন। যা হোক অন্তত কচিকাঁচা শিশুগুলোকে নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও টানাপোড়েন বন্ধ হবে। কিন্তু হা হতোস্মি! অচিরেই জানা গেল যে, এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে মন্ত্রিপরিষদ। সেখানে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তটি টেকেনি। যুক্তি হিসেবে বলা হয়েছে যে, জাতীয় শিক্ষানীতির আলোকে প্রাথমিক শিক্ষা ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত বাস্তবায়ন করতে হলে সময় প্রয়োজন। কেননা, এর জন্য লাগবে অর্থ, প্রয়োজনীয় অবকাঠামো, উপযুক্ত শিক্ষক ও প্রশিক্ষণ, তাদের মর্যাদা সর্বোপরি যথাযথ পাঠ্যপুস্তক ও কারিকুলাম। এ পর্যন্ত ঠিকই আছে। তাহলে এত আগেই কোন প্রস্তুতি ছাড়াই ঘোষণা করার দরকার কী ছিল? সরকার ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে এটা তো বুঝতে হবে যে, প্রাথমিক শিক্ষা ও বইপুস্তক অবৈতনিক হলেও সমাপনী পরীক্ষার নামে শিশুদের কোচিং ও সৃজনশীল প্রশ্নের নামে গাইড বইয়ের জন্য গুচ্ছের খরচ হয়ে থাকে অভিভাবকদের। এর ওপর পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসসহ কেন্দ্র পরিবর্তনের দুশ্চিন্তা ও দৌড়ঝাঁপ তো আছেই। এই অসহায়ত্ব থেকে শিশু ও অভিভাবকদের মুক্তি দেবে কে? তদুপরি কবে থেকে তারা এই অহেতুক বিড়ম্বনা ও ভোগান্তি থেকে মুক্তি পাবেন। তা বলতে পারছে না কেউÑ না প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়, না শিক্ষা মন্ত্রণালয়। বর্তমানে প্রাথমিক শিক্ষাই চলছে কয়েক স্তরে। একদিকে প্রাথমিক শিক্ষা, অন্যদিকে এবতেদায়ী শিক্ষা ও কওমী মাদ্রাসা। কিন্ডারগার্টেনসহ ইংরেজী মাধ্যমের স্কুলও চলছে। কোনটির সঙ্গে কোনটির সমন্বয় নেই। পাঠ্যপুস্তকসহ সিলেবাসও আলাদা। স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উন্নত ও সমৃদ্ধ একমুখী শিক্ষাব্যবস্থা বাস্তবায়নসহ পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নেও সমস্যা বিরাজমান। প্রাথমিক শিক্ষার সঙ্গে মাদ্রাসা ও কিন্ডারগার্টেন শিক্ষার সমন্বয় সাধন এবং আধুনিকীকরণ অত্যাবশ্যক ও জরুরী। শিশুদের জন্য একাধিক শিক্ষা ব্যবস্থা প্রচলিত থাকলে, শুরুতেই তা হোঁচট খেতে বাধ্য। সে অবস্থায় ড. কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশনের আলোকে উদ্যোগ নিতে হবে। এর পাশাপাশি ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষা স্তর বাস্তবায়নের সমস্যাগুলো দূর করতে হবে ধাপে ধাপে। অবকাঠামো বিনির্মাণসহ শিক্ষকদের নিবিড় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। তদনুযায়ী পাঠ্যপুস্তক, যা হবে আধুনিক ও যুগোপযোগী। একাধিক মন্ত্রণালয় ও অধিদফতরের পরিবর্তে সমগ্র শিক্ষাব্যবস্থা আনতে হবে একক মন্ত্রণালয়ের অধীনে। বর্তমানে জাতীয় বাজেটে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ আশানুরূপ নয়। নানামুখী ও একমুখী শিক্ষা প্রবর্তনে আমলাতন্ত্রও প্রতিবন্ধক। পাঠ্যপুস্তকের প্রকাশক গোষ্ঠী এবং কোচিং ও গাইড বই ব্যবসায়ীরাও কম অন্তরায় নয়। দীর্ঘদিন থেকে একটি স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী এর পেছনে কাজ করছে। শিক্ষার মান উন্নয়নসহ যথাযথ শিক্ষানীতি বাস্তবায়নে এ সবই দূর করতে হবে।
×