ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

এম নজরুল ইসলাম

মুজিবনগরে স্বাধীন বাংলা সরকার গঠন

প্রকাশিত: ০৩:৪২, ১৭ এপ্রিল ২০১৭

মুজিবনগরে স্বাধীন বাংলা সরকার গঠন

১৯৭০-এ পাকিস্তানের ইতিহাসে প্রথম সরাসরি সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। কিন্তু বাঙালীদের পাকিস্তানের শীর্ষ ক্ষমতায় যেতে দিতে পাঞ্জাবি শাসকরা রাজি ছিল না। ষড়যন্ত্র শুরু হলো। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সঙ্গে আলোচনার জন্য ১৫ মার্চ (১৯৭১) জেনারেল ইয়াহিয়া খান এবং ২১ মার্চ (১৯৭১) জুলফিকার আলী ভুট্টো ঢাকা আসেন। তারা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বৈঠক করেন। আরও আলোচনা হবে এই মর্মে বঙ্গবন্ধুকে জানানো হয়েছিল। ২৫ মার্চ (১৯৭১) বঙ্গবন্ধু তাঁর বাসভবনে অপেক্ষায় ছিলেন। কিন্তু জেনারেল ইয়াহিয়া ‘অপারেশন সার্চলাইট’ বাস্তবায়ন করার নির্দেশ দিয়ে কাউকে কিছু না জানিয়ে রাত ১০টার (২৫ মার্চ, ১৯৭১) আগেই করাচীর উদ্দেশে উড়ে গেলেন। প্রকৃতপক্ষে বঙ্গবন্ধুকে আলোচনায় ব্যস্ত রেখে ইয়াহিয়া-ভুট্টো তাদের জেনারেলদের দিয়ে ‘অপারেশন সার্চলাইট’ বাস্তবায়নের ব্যবস্থা করেন। যতদূর জানা যায়, ২৫ মার্চ (১৯৭১) রাত ১০টার আগে বঙ্গবন্ধু গোপন সূত্রে খবর পান পাকিস্তানী সামরিক বাহিনী বাংলাদেশের স্বাধীনতার দাবিকে নস্যাত করে দেয়ার জন্য সামরিক আক্রমণ শুরু করবে। এরপর তিনি টিএ্যান্ডটি/ইপিআর-এর কাছে ইতোপূর্বে পাঠানো স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচার করার নির্দেশ দেন। বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘২৫ মার্চ (১৯৭১) রাত ১১টায় সব সহকর্মী, আওয়ামী লীগ নেতাদের হুকুম দিলাম, বের হয়ে যাও। যেখানে পার, এদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ কর। খবরদার স্বাধীনতা না আসা পর্যন্ত সংগ্রাম চালিয়ে যেও।’ (৬-দফা বার্ষিকী উপলক্ষে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, ৭ জুন ১৯৭২) ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী বঙ্গবন্ধুকে তাঁর ধানম-ির ৩২ নম্বর বাসভবন থেকে গ্রেফতার করে। তাজউদ্দীন আহমদ কলকাতা চলে যান। সঙ্গে ছিলেন ব্যারিস্টার আমির-উল-ইসলাম। ওখানে গিয়ে তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে অচিরেই দেখা করার ব্যাপারে মনস্থির করেন। কিন্তু একজন সরকারপ্রধান হিসেবে ইন্দিরা গান্ধীর পক্ষে তাজউদ্দীনকে ব্যক্তিগত সাক্ষাত দেয়ার কোন যুক্তিসঙ্গত কারণ ছিল না। ইতোমধ্যে ৩১ মার্চ (১৯৭১) ভারতীয় পার্লামেন্টে গৃহীত এক প্রস্তাবে পূর্ব বাংলার সাড়ে সাত কোটি জনসাধারণের ঐতিহাসিক অভ্যুত্থান সফল হবে বলে আশা প্রকাশ করা হয়। মিসেস গান্ধী নিজে এই প্রস্তাব উত্থাপন করে বলেন, পূর্ব বাংলার জনগণের প্রতি ভারতীয় জনগণের পূর্ণ সমর্থন রয়েছে এবং তারা সর্ব প্রকারে সাহায্য করার জন্য প্রস্তুত। (‘দি টাইমস’ লন্ডন, ১ এপ্রিল ১৯৭১) ৩ এপ্রিল (১৯৭১) তাজউদ্দীন আহমদ তার উপস্থিত বুদ্ধিমত্তায় এই অস্ত্রটি কাজে লাগালেন। তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে জানালেন, ২৫-২৬ মার্চেই শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপ্রধান করে একটি সরকার গঠিত হয়েছে এবং আওয়ামী লীগ হাইকমান্ডের সবাই এই মন্ত্রিসভায় আছেন এবং তাজউদ্দীন আহমদ নিজে এই সরকারের প্রধানমন্ত্রী বলে উল্লেখ করেন। তাজউদ্দীন আহমদের এই উপস্থিত ও বৈপ্লবিক সিদ্ধান্ত বাংলদেশের মুক্তিযুদ্ধে অনন্য সাধারণ ভূমিকা রেখেছিল। কারণ এতে কাজ হয়েছিল এবং এ বৈঠকের পরপরই বাংলদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারত সরকারের সাহায্য ও সহযোগিতা দ্রুত গতিতে প্রসার লাভ করেছিল। ১০ এপ্রিল (১৯৭১) প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার এক অধ্যাদেশ জারি করে আইনগত দিক থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করে। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের সার-সংক্ষেপ ‘যেহেতু একটি সংবিধান প্রণয়নের উদ্দেশ্যে প্রতিনিধি নির্বাচনের জন্য ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর থেকে ১৯৭১ সালের ১৭ জানুয়ারি পর্যন্ত বাংলাদেশে অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং যেহেতু এই নির্বাচনে বাংলাদেশের জনগণ ১৬৯ জন প্রতিনিধির মধ্যে আওয়ামী লীগ দলীয় ১৬৭ জনকে নির্বাচিত করেন এবং যেহেতু সংবিধান প্রণয়নের উদ্দেশ্যে জেনারেল ইয়াহিয়া খান জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিগণকে ১৯৭১ সালের ৩ মার্চে মিলিত হওয়ার জন্য আহ্বান করেন, এবং যেহেতু এই আহূত পরিষদসভা স্বেচ্ছাচারী ও বেআইনীভাবে অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করা হয় এবং যেহেতু পাকিস্তানী কর্তৃপক্ষ তাদের প্রতিশ্রুতি রক্ষার পরিবর্তে এবং বাংলাদেশের প্রতিনিধিগণের সঙ্গে আলোচনা অব্যাহত থাকা অবস্থায় একটি অন্যায় ও বিশ্বাসঘাতকতামূলক যুদ্ধ ঘোষণা করে এবং যেহেতু এরূপ বিশ্বাসঘাতকতামূলক আচরণের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণের আইনানুগ অধিকার প্রতিষ্ঠার পক্ষে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ ঢাকায় যথাযথভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা প্রদান করেন এবং বাংলাদেশের মর্যাদা ও অখ-তা রক্ষার জন্য বাংলাদেশের জনগণের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানান এবং... আমরা বাংলাদেশের নির্বাচিত প্রতিনিধিগণ... নিজেদের সমন্বয়ে যথাযথভাবে একটি গণপরিষদ গঠন করলাম, এবং পারস্পরিক আলোচনা করে এবং বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার নিশ্চিত করণার্থে, সাবভৌম গণপ্রজাতন্ত্র রূপে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা ঘোষণা করলাম এবং এতদ্বারা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক ইতোপূর্বে ঘোষিত স্বাধীনতা দৃঢ়ভাবে সমর্থন ও অনুমোদন করলাম এবং এতদ্বারা দৃঢ়ভাবে ঘোষণা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করছি যে, সংবিধান প্রণীত না হওয়া পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপতি থাকবেন এবং সৈয়দ নজরুল ইসলাম প্রজাতন্ত্রের উপ-রাষ্ট্রপতি থাকিবেন এবং রাষ্ট্রপতি প্রজাতন্ত্রের সকল সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক হবেন, একজন প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ এবং তাঁর বিবেচনায় প্রয়োজনীয় অন্যান্য মন্ত্রী নিয়োগ ক্ষমতার অধিকারী হবেন, ... আমরা আরও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করছি যে, স্বাধীনতার এই ঘোষণাপত্র ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ কার্যকর হয়েছে বলে গণ্য হবে।’ ১১ এপ্রিল (১৯৭১) স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে তাজউদ্দীন আহমদ একটি বেতার ভাষণ দেন। এই ভাষণে তিনি দেশব্যাপী পরিচালিত প্রতিরোধ যুদ্ধের বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধরেন। ১১ এপ্রিল (১৯৭১) তাজউদ্দীন আহমদ আগরতলায় মন্ত্রিসভা চূড়ান্ত করেন। ১৭ এপ্রিল (১৯৭১) ‘মুজিবনগরে’ নবগঠিত বাংলাদেশ সরকারের শপথ অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করা হয়। স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের এই শপথ অনুষ্ঠান ছিল এক অনন্যসাধারণ ঘটনা। শপথ অনুষ্ঠানের বিবরণ দিয়েছেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এভাবে- ‘গাড়িগুলো শেষ পর্যন্ত এসে থামল একটি বিশাল আম বাগানের মধ্যে। এই গ্রামটির নাম বৈদ্যনাথতলা, জেলা কুষ্টিয়া, মহকুমা মেহেরপুর। কিছু লোক সেখানে দৌড়াদৌড়ি করে চেয়ার সাজাচ্ছে, অধিকাংশই হাতল ভাঙা চেয়ার, কাছাকাছি গ্রামের বাড়িগুলো থেকে জোগাড় করে আনা হয়। জায়গাটিকে ঘিরে রাইফেল-এলএমজি হাতে পজিশন নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বিশ-পঁচিশজন সৈন্য, তাদের ঠিক মুক্তিবাহিনীর ছেলে বলে মনে হয় না, খুব সম্ভবত প্রাক্তন ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলের একটি বিদ্রোহী বাহিনী। ‘আশপাশের গ্রাম থেকে ধেয়ে এসেছে বিপুল জনতা। অস্ত্রধারী সেনাদের বৃত্ত ভেদ করে তারা হুড়মুড় করে ভেতরে ঢুকে পড়তে পারছে না বলে অনেকেই আম গাছগুলোতে চড়তে শুরু করেছে।’ ‘অনুষ্ঠান শুরু হলো এগারোটার পর। সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ সবাই এসে গেছেন। তবে যার উপস্থিতি সবচেয়ে বেশি প্রয়োজনীয় ছিল তিনি নেই, তিনি আসবেন না। শেখ মুজিব যে কোথায় আছেন তা এখনও জানা যায়নি। তবু অনুপস্থিত শেখ মুজিবুর রহমানের নাম ঘোষণা করা হলো রাষ্ট্রপতি হিসেবে। সৈয়দ নজরুল ইসলাম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ। মন্ত্রিসভার অন্য তিনজন সদস্য হলেনÑ খোন্দকার মোশতাক আহমদ, এইচএম কামারুজ্জামান এবং এম মনসুর আলী। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কমান্ডার ইন চীফ নিযুক্ত হলেন রিটায়ার্ড কর্নেল ওসমানী। ‘এর সাতদিন আগেই কলকাতার থিয়েটার রোডের অস্থায়ী ‘মুজিবনগর’ সরকার থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সনদ ঘোষণা করা হয়েছিল। আজ ১৭ এপ্রিল (১৯৭১) বাংলাদেশের অভ্যন্তরে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হলো স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার। ঐতিহাসিক দলিলটি পাঠ করলেন চীফ হুইপ ইউসুফ আলী।’ (সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘পূর্ব-পশ্চিম’। পৃষ্ঠা ৮৫-৮৭) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব নির্দেশিত পথেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয়। এই সত্যকে অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। বার বার বলতে হবে, এই স্বাধীনতা অর্জনের পেছনে কাজ করেছে দীর্ঘ আন্দোলন ও ত্যাগ। প্রতিটি আন্দোলনের সম্মিলিত সুফলই হলো স্বাধীনতা। এই স্বাধীনতা কোন মেজর কর্তৃক তেলের ড্রামের ওপর দাঁড়িয়ে ঘোষণা কিংবা কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধুর ঘোষণার পুনরাবৃত্তির মাধ্যমে অর্জিত হয়নি। ১৯৪৮ সাল থেকে ধাপে ধাপে এগিয়ে গেছে স্বাধীনতা আন্দোলন। তারই চূড়ান্ত পরিণতি হলো বাংলাদেশ। লেখক : অস্ট্রিয়া প্রবাসী মানবাধিকারকর্মী ও সাংবাদিক
×