ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মলয় বিকাশ দেবনাথ

সৈয়দ হকের ত্রয়ী মিথস্ক্রিয়ায় বহ্নি বিসর্জন ব-দ্বীপ

প্রকাশিত: ০৬:৩৫, ৬ এপ্রিল ২০১৭

সৈয়দ হকের ত্রয়ী মিথস্ক্রিয়ায় বহ্নি বিসর্জন ব-দ্বীপ

গত ২৯ ও ৩০ মার্চ বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির পরীক্ষণ থিয়েটার হলে মঞ্চস্থ হয়েছে ‘বহ্নি বিসর্জন ব-দ্বীপ’। সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হকের ‘নূরলদীনের সারাজীবন’, ‘নিষিদ্ধ লোবান’ ও ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’ অবলম্বনে আখ্যান সংযোজনা করেছেন শাহমান নৈশান এবং নির্দেশনা দিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের থিয়েটার ও পারফরমেন্স স্টাডিজ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আহমেদুল কবির। নাটকটির আলোক পরিকল্পনায় ছিলেন আশিকুর রহমান লিয়ন ও অভিনয় করেছেন বিভাগের ৩য় বর্ষের ষষ্ঠ সেমিস্টারের ছাত্রছাত্রীরা। চমৎকার অভিনয়শৈলী আর বাঁশের লাঠির বহুমাত্রিক ব্যবহার দর্শককে নাটকের সঙ্গে একাত্ম করে দিয়েছিল। নাটকটির ১ম এপিসোডে ফুটে উঠেছে নূরলদীনের সারাজীবন। বাংলা ১১৮৯ সালে ইংরেজ ঔপনিবেশক শাসকগোষ্ঠী ও এই ভূমির রক্তচোষা চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে সৃষ্ট ইংরেজদের এদেশীয় দোসর জমিদারদের নিপীড়নের বিরুদ্ধে উত্তরবঙ্গের কৃষক বিদ্রোহের নেতা নূরলদীন প্রতিবাদের ডাক দিয়েছিলেন ‘জাগো বাহে কোনটে সবায়।’ সেই ডাকে সারা দিয়েছিল তৎকালীন নিপীড়িত কৃষক সমাজ। নাটকে নিপীড়িত লড়াকু সত্তার প্রতীকরূপে কৃষকেরা চিত্রিত হয়েছে ‘লাল কোরাস’ নামে আর ইরেজ শাসকগোষ্ঠী ও তাদের দোষর জমিদাররা রূপায়িত হয়েছেন ‘নীল কোরাস’ নামে। নূরলদীনের সেদিনের সেই ডাক এ জাতির মনে স্বাধীনতার বীজ রূপিত হয়েছিল। সংগ্রামী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়েছিল এ জাতি। অন্যদিকে নূরলদীনের স্ত্রীর অপেক্ষা, ভীতি, শঙ্কা এ জাতিকে আরেকটি বার্তা দেয়। কত মমতাময়ী নারী তাদের স্বামী, সন্তান হারিয়ে বাঁচার লড়াই করে গেছেন, ধরেছেন সংসারের হাল। নাটকটির ২য় এপিসোড সাজানো হয়েছে ১৯৭১ এর প্রেক্ষাপটের ওপর রচিত উপন্যাস নিষিদ্ধ লোবানের ওপর। গল্পের বিলকিস যেন একাত্তরের সম্ভ্রম হারানো সাহসিকা সব নারীর বিক্ষুব্ধ প্রতীক। বিলকিস ছিলেন একজন সাংবাদিকের স্ত্রী। তার স্বামীসহ অনেক বুদ্ধিজীবীকে লাইন ধরে চোখ বেঁধে গুলি করে হত্যা করেছে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী সেই চিত্রও এ নাটকে উঠে এসেছে। মুক্তির স্বাদ পেতে এ জাতি যে সেই ১৭৯৩ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত নিরন্তর সংগ্রাম করে গেছে তার যথাযথ প্রস্ফুটন এ দুই এপিসোডে পরিলক্ষিত হয়েছে। এ ছাড়া তৎকালীন প্রতিটি গ্রামের সচিত্র রূপ কাহিনীর জলেম্বরী নামক গ্রামটি দ্বারা রূপান্তরিত করা হয়েছে। এই নাট্যের ৩য় ও শেষ অঙ্ক নির্মিত হয়েছে সব্যসাচী লেখক সৈয়দ হকের কাব্যনাটক ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’-এর অবলম্বনে। দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ আর লাখো প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার প্রাক্কালে যখন হানাদার বাহিনী পিছু হটতে শুরু করেছে তখন বীর যোদ্ধাদের পায়ের আওয়াজ শুনতে পায় জনগণ। রাজাকার মাতবর পাকিস্তানী হায়েনাদের হাত থেকে তার নিজের মেয়েকেও বাঁচাতে পারেনি- এ অংশে তা-ই দেখানো হয়েছে। মাতবরের মেয়েও গ্রামবাসীর সম্মুখে তার পিতার মুখোশ উন্মোচন করে দিয়েছে। নির্দেশক এই নাটকের সংলাপে বর্ণনাত্মক রীতি এনে নাটকটির ভিন্ন মাত্রা যোগ করেছে। সেই সঙ্গে বাঁশ যে বাঙালী সংস্কৃতিতে হাজার বছর ধরে ব্যবহৃত হচ্ছে। এ নাটকে বাঁশের যথাযথ প্রয়োগ নাটকটিকে দেশজ নাট্যরূপেও সমৃদ্ধ করেছে। অন্যদিকে নাটকটিতে ব্রেখটিয় রীতিরও অনুপ্রবেশ ঘটেছে। প্রতিটি অঙ্কের শেষে নাটকটিকে থামিয়ে দিয়ে দর্শককে চিন্তা করার সুযোগ রাখা হয়েছে। এভাবেই আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য, স্বাধীনতার চেতনায় উদ্বুদ্ধ জাতির বিদ্রোহের আগুন বিসর্জনের বেদনা ও একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের জন্ম নিয়ে মঞ্চায়িত হয়েছে বহ্নি বিসর্জন ব-দ্বীপ।
×