ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

নারী উপাচার্যের ৩ বছরে অন্যরূপে জাহাঙ্গীরনগর

প্রকাশিত: ০৬:৫২, ১৭ মার্চ ২০১৭

নারী উপাচার্যের ৩ বছরে অন্যরূপে জাহাঙ্গীরনগর

দেশের পাবলিক বিশ^বদ্যালয়ের ইতিহাসে প্রথম নারী উপাচার্য আপনি। জীবনের এ পর্যায়ে আসতে আপনি যেসব অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছেন, সেই কথা জানতে চাই। আমি প্রথমে জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয়ের উপাচার্য পাশাপাশি বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে প্রথম নারী উপাচার্য। ২০১৪ সালের ২ মার্চ মহামান্য আচার্য আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে আমি উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পাই। এরপর থেকে দেশে-বিদেশে আলোড়ন সৃষ্টি হয় দেশের প্রথম নারী উপাচার্য কে হলেন, কিভাবে হলেন। কিন্তু উপাচার্য হওয়ার চেয়েও বড় বিষয় হলো আমি সব সময় নিজেকে শিক্ষক হিসেবেই পরিচয় দিই। নিজেকে সব সময় উৎকৃষ্ট গবেষক ও একাডেমিশিয়ান হিসেবে দেখতে চেয়েছি। তাই একজন গবেষক ও শিক্ষক হিসেবে উপাচার্য হওয়া আমার কাছে বড় পাওয়া। জীবনের এ পর্যায়ে আসতে বিভিন্ন অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছি। ছোটবেলা থেকেই আমি চাইতাম এমন কোন পেশায় যাব যেখানে জনগণের সেবা করা যায়। তখনই ভাবতাম শিক্ষকতার কথা। আমি ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগ থেকে রেকর্ড মার্ক নিয়ে অনার্স ও মাস্টার্স পাস করি। তখন আমি নিশ্চিত হয়েছিলাম যে আমি শিক্ষক হচ্ছি এবং ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষক। কিন্তু নারীদের সক্ষমতা কম এমন অজুহাতে এবং রাজনৈতিক কারণে আমাকে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে দেয়া হয়নি। পরে আমি ১৯৮২ সালে চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্ব বিভাগের প্রভাষক হিসেবে শিক্ষকতা শুরু করি। এরপর ১৯৮৬ সালের ১৪ অক্টোবর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগ দিই। তবে শিক্ষকতা শুরুর সময় ভাবিনি কখনও উপাচার্য হব, তাও আবার দেশের প্রথম নারী উপাচার্য। নারী উপাচার্য হিসেবে আপনার সফলতা কি কি? আমি উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পর আমার অনেক নারী সহকর্মী আমাকে বলেছেন, ম্যাডাম আপনি এই পদে এসেছেন, আমরাও আসতে চাই। নারী সহকর্মীরা আমাকে দেখে যে অনুপ্রেরণা বা আস্থা পান, এটা নারী উপাচার্য হিসেবে আমার সফলতা। বিশ^বিদ্যালয়ের মেয়েরা যেখানে পুরুষ উপাচার্যের কাছে সব বিষয় নিয়ে অবাধে যেতে পারত না সেখানে নারী উপাচার্য হিসেবে আমার কাছে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আসছে। আমার কাছে মেয়েরা একটি ভরসার জায়গা খুঁজে পেয়েছে। এটা নারী উপাচার্য হিসেবে সফলতা। বিশ^বিদ্যালয় পরিচালনার ক্ষেত্রে কোন্ কোন্ সফলতাকে বিশেষ অগ্রাধিকার দেবেন? কোন অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ছাড়াই ৩ বছর পার করা সবচেয়ে বড় সফলতা বলে আমি মনে করি। বিশ^বিদ্যালয়ের একটি সঙ্কটময় মুহূর্তে আমাকে নিয়োগ দেয়া হয়। এরপর সকলের সহযোগিতায় আমরা শিক্ষার একটি সুষ্ঠু পরিবেশ তৈরি করতে সক্ষম হয়েছি এবং দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে বিশ^বিদ্যালয়ে কোন বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়নি। বেশ কয়েকটি বিভাগে সেশনজট ছিল বর্তমানে তা নেই বললেই চলে। নির্মাণাধীন যেসব ভবন অসম্পূর্ণ ছিল সেগুলোর নির্মাণ কাজও প্রায় শেষ। বিশ^বিদ্যালয় প্রশাসনের শীর্ষ পর্যায়ে থেকে ৩ বছর সুষ্ঠুভাবে বিশ^বিদ্যালয় পরিচালনার ক্ষেত্রে নারী উপাচার্য হিসেবে কোন প্রতিবন্ধকতা এসেছে কি? নারী উপাচার্য হিসেবে আপনার সহকর্মীরা আপনাকে কিভাবে গ্রহণ করেছেন? কোন দায়িত্ব নেয়ার পর কাজ করতে গেলেই বোঝা যায় কাজ করা কত কঠিন। সব সময় সবার মনমতো কাজ করা সম্ভব হয় না, তখনই তৈরি হয় জটিলতা। এতদিন যাবত পুরুষ উপাচার্য কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ওপর যে কর্তৃত্ব করেছেন বা পুরুষ উপাচার্যের সঙ্গে তারা যেভাবে কাজ করে অভ্যস্ত সেখানে নারী হিসেবে আমি তাদের ওপর সেই কর্তৃত্ব করতে পারিনি। তাই নারী উপাচার্য হিসেবে আমি যখন কোন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে আদেশ করি তারা তা সঠিকভাবে পালনে গড়িমসি করেন। এটা এক রকম প্রতিবন্ধকতা। আবার সাম্প্রতিক আমি দানবীর কাদির মোল্লার দান করা অর্থে কনভেনশন সেন্টার নির্মাণের যে উদ্যোগ নিয়েছিলাম তাতে বাঁধা পেয়েছি। সেক্ষেত্রে নারী উপাচার্য না হয়ে অন্য কোন উপাচার্য হলে এই প্রতিবন্ধকতা আসত কিনা সে প্রশ্ন আমার মনে রয়ে গেছে। আবার শিক্ষকদের সুবিধার কথা বিবেচনা করে তাদের জন্য এসি বাস আনা হয়েছে। কিন্তু এখন শিক্ষকদের কাছ থেকে বাসের ভাড়া বাবদ নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা চাওয়া হলে তারা তা দিতে রাজি নন। এ রকমভাবে গত ৩ বছরে নানা প্রতিবন্ধকতা এসেছে। তবে আমাদের উপ-উপাচার্য ড. আবুল হোসেন ও প্রক্টর ড. তপন কুমার সাহা এ বিষয়ে আমাকে আন্তরিক সহযোগিতা করছেন। মূলত এসব প্রতিবন্ধকতার মাঝেও সকলের অনেক সহযোগিতা পেয়েছি, যার কারণে এখনও কোন বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়নি। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী, সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা, স্পীকারসহ গুরুত্বপূর্ণ অনেক পদে দায়িত্ব পালন করছেন নারীরা। উচ্চ পর্যায়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে নারীদের প্রতি আপনার পরামর্শ কি? নারী-পুরুষ উভয়ই এ দেশের সমান অংশীদার। অথচ অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিকসহ সব জায়গায় নারীরা পুরুষের তুলনায় বঞ্চিত। তবে বর্তমান সরকার নারীদের উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে এবং উচ্চ পর্যায়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে নারীদের যথেষ্ট আগ্রহও রয়েছে। শীর্ষ অবস্থানে পৌঁছাতে হলে প্রয়োজন কঠোর সাধনার। পরিশ্রম ছাড়া কেউ কখনও বড় হতে পারে না। নারীদের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। নারীদের কখনই নারী হিসেবে কোন সুবিধা নেয়া উচিত নয়। নিজের যোগ্যতা দিয়েই অবস্থান তৈরি করা উচিত। যোগ্যতার বলেই শীর্ষ পর্যায়ে যাওয়া উচিত। ব্যস্ততার মধ্যেও সময় দেয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ।
×