ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

শাশ্বত নিপ্পন

গল্প ॥ গোরখেকোর আজাব

প্রকাশিত: ০৬:১৬, ১০ মার্চ ২০১৭

গল্প ॥ গোরখেকোর আজাব

গোরস্থানকে আগের মতো আর ভয় পায় না গোবিন্দপুর গ্রামের খাদেম আলি। ছেলেবেলায় গোরস্থান তার কাছে ছিল সাংঘাতিক আতঙ্ক। সদ্য কবরের ঢিবিতে গেঁড়ে দেয়া খেজুরের ডালগুলোকে মনে হতো, ফাঁকা মরুভূমির বুকে জেগে থাকা বিষাক্ত কাঁটাগাছ। জীর্ণ যক্ষ্মা রোগীর পাঁজরের মতো জেগে থাকা বাঁশের পুরনো বেড়াগুলোকে খাদেমের মনে হতো জীবন্ত ভূতের শীর্ণ হাড়-হাড্ডি। ধসে যাওয়া কবরের অন্ধকার গহ্বরগুলো তার কাছে ছিল পিশাচের হাঁ-এর মতো। গোবিন্দপুর গ্রামের গোরস্থানের এককোণে কেয়াগাছে বর্ষায় যখন কলার মোচার মতো ফুল ফুটত; খাদেম সেই ফুলের সুগন্ধ কোনদিন পায়নি। গোরস্থানের কাছে গেলেই খাদেমের আগরবাতির গন্ধ ছাপিয়ে নাকে আসে মৃত মানুষের মাংসপচা গন্ধ, ভূত-প্রেতের নিঃশ্বাসের ভীতিকর গন্ধ, মৃত্যুর শীতল গন্ধ। গ্রামের জামে মসজিদের ইমাম সাহেব মোঃ আবদুল মালেক মুর্শিদাবাদী, যার পূর্বপুরুষ মুর্শিদাবাদের বাসিন্দা ছিলেন। তার বয়ানে বারংবার বলেছেন, ‘গোরস্থানে আল্লাহতা’লার ফেরেশতারা থাকেন সবসময়, গোরস্থানই আমাদের আসল ঠিকানা আর শীতল মাটি হলো আসল বিছানা।’ তারপরও খাদেম আলির আতঙ্ক কাটত না কিছুতেই। কিন্তু এখন গোরস্থানই তার জীবিকা নির্বাহের প্রধান ক্ষেত্র। যখন সন্ধ্যা নামেÑ গোবিন্দপুর গ্রামসহ আশপাশের পাঁচ গ্রামে, জেলেপাড়া গোয়ালঘরে মশা তাড়ানোর জন্য যখন সাঁজাল জ্বলে ওঠে, চাঁদ হামা দিয়ে মাঝ আকাশে পাড়ি জমায়, বাড়ির ক্লান্ত বউগুলো এক সানকি ভাত খেয়ে আলুথালু হাই তোলে; খাদেম তখন সাদা আলখাল্লাটা সযতেœ নিয়ে অতি সন্তর্পণে তার বাড়ি ছাড়ে। বাড়ি বলতে গোবিন্দপুর গ্রামের বাগানপাড়ার একধারে বাঁশের বেড়ার একটা মাটির ঘর। কাজে যেতে খাদেমকে কারও কাছে বিদায় নিতে হয় না। ঘর থেকে বেরোনোর পূর্বে যখন কুপির সলতেটা নেভায় তখন ঘরময় শুধু খাঁ খাঁ অন্ধকার দাপাদাপি করে। সংসার করা হয়নি তার। ‘কবর খোঁড়া’ দিয়েই খাদেম তার জীবিকা শুরু করে। পরবর্তীতে কবর খোঁড়া, তদন্তের প্রয়োজনে বাসি-পচা লাশ কবর থেকে তোলা, জংলায় পাওয়া পচা বেওয়ারিশ লাশ মাটিচাপা দেয়াÑ সব কাজই আস্তে-ধীরে তার কাঁধে চেপে বসে এবং এর জন্য খাদেমের অনুমতির তোয়াক্কা করে না কেউ। ‘গোরখুঁড়ে’দের যে সংসার হয় না এমন না। কিন্তু ওই যে লাশ তোলা, পচা লাশ! পচা লাশ গোসল দিয়ে কবরে শুইয়ে মাটিচাপা দেয়ার পর সারা শরীরে তার মানুষের মাংসপচা দুর্গন্ধ যেন লেপটে থাকে সারাক্ষণ। একটা গোটা গন্ধসাবান শরীরে ডলেও দুর্গন্ধ যায় না। সময়ে খাদেমের আয় রোজকার ভাল হয়। তবে প্রতিদিন নয়, মাসের বেশিরভাগ দিনই তার কোন কাজ থাকে না। অন্য কাজে তাকে কেউ খুব একটা ডাকেও না। পেটে পাথর বেঁধে সবদেল তার তেলচিটে বিছানায় শুয়ে পরিচিত সূর্যটার উদয়, অস্ত আর রাতে জোছনার ঝিলিক দেখে, একা। বউরা যেমন না খেয়ে থাকতে চায় না, ঠিক তেমনি স্বামীর শরীরে মিষ্টি গন্ধ তাকে রমণপ্রিয় করে তোলে। স্বামীর ঘাড়ে গর্দানে লেগে থাকবে তিব্বত পাউডারের সাদা আভা, মাথার কালো চুলে খাঁটি সরিষার তেলের ঝাঁঝালো গন্ধ অথবা কানের গোপন কুঠুুরিতে সস্তা আতরের নাক জ্বালানো কটু সুগন্ধ না থাকলে সে স্বামীর জন্য যেমন বউ পাওয়া কষ্টকর; তেমনি সে পুরুষের শাদি মোবারকের ইচ্ছাটাও ঘোড়ারোগের শামিল। এ নিয়ে খাদেমের খুব যে দুঃখবোধ আছে তা কিন্তু নাÑ সে জানে মহান আল্লাহপাকের দুনিয়াতে তার একটা ব্যবস্থা হবেই হবে। সারা শরীরে পচা মাংসের দুর্গন্ধ আর পেটময় ক্ষুধা নিয়ে এই বিশ্বাসকে শাণিত করে খাদেম। দীর্ঘ প্রতীক্ষা তাকে বোধহীন করে রাখে যেন। অতঃপর এক অন্ধকারে সে দেখা পায় গফুর ঘরামির বিধবা বউ জোসনার। কার্তিক মাসের হিমজড়ানো রাতে দেখা হয় দুই নিশাচরের। গফুর ঘরামি চৈত্র মাসের রোদে সারাদিন কাজ শেষ করে ঘরের দাওয়ায় বসে হাঁ করে শ্বাস নিতে নিতেই মারা যায়। তার কবরটাও খাদেমই খুঁড়েছিল নিজ হাতে। পাড়ার লোকেরা কচি বউটার কপালের কথা চিন্তা করেছিল ক’দিন। তারপর ভুলেও যায় তারা দ্রুত। গরিবের শোক দীর্ঘস্থায়ী হয় না। তারপর বর্ষা-খরা পার হয় গোবিন্দপুরের ওপর দিয়ে। আশপাশের কচুশাক আর মাঠে পড়ে থাকা ধানগুলো শেষ করার পর গফুর ঘরামির বিধবা স্ত্রী জোসনা পেটের খিদে মেটাতে নেমে আসে রাতের অন্ধকারে। অল্পতেই সে আবিষ্কার করে সূর্যের আলোর চেয়ে রাতের অন্ধকারে রোজগার বেশি। অভাব কাটতে থাকে তার। ইদানীং সে ভরা পেটে দুপুরে ঘুমায় কখনও কখনও। তারপরও জোসনা রাজি হয় না কিছুতেই। জোসনা বলে, ‘তুমি পথ ছাড়ো, আমি বাড়ি যাব।’ ‘তুই আমার সঙ্গে চল জোসনা।’ ‘ছিঃ, তুই তো....’ জোসনার এই ‘না রাজি’ বেশিদিন স্থায়ী হয় না। খাদেমের মধ্যে জোসনা নিজেকে খুঁজে পায়। খাদেম মৃত মানুষ বাছে না ভাতের জন্য, জোসনাও রাতের অন্ধকারে সব মানুষকে একাকার করে ফেলে বেঁচে থাকার তাগিদে; ওরা ঘনিষ্ঠ হয় দ্রুত। মিটে যায় খাদেমের সংসার করার তৃষ্ণা। আবার সে চিটচিটে বিছানায় শুয়ে চাঁদ-সূর্যের ওঠানামা দেখতে থাকে। খিদেয় তার মেরুদ- জ্বালা করে ওঠে। তারপর এই পাপময় জগতে শহর থেকে তার কাছে ভেসে আসে নতুন কাজের অফার। কাজটা কঠিন না, তবে পাপের। শুনতে ভয়াবহ। খাদেম দিনে কবর খোঁড়ে যখন প্রয়োজন হয়, আর রাতে ভিন্ন গ্রামের কবর থেকে কঙ্কাল চুরি করে। পার্টি রেডি থাকে। মোটা দামে কিনে নিয়ে যায় তারা। পিস প্রতি খাদেম পায় আট শ’ থেকে বারো শ’ টাকা। প্রথম প্রথম ভয় ছিল, দ্বিধা ছিল, মনে পাপও ছিল। ক্রমেই এসব সমস্যা খিদে আর লোভের কাছে পরাজিত হয়। নিশুতি রাতের অন্ধকারে খাদেম একসময় নিজের খোঁড়া কবরের মধ্যে শরীর গলিয়ে দেয়। ছেঁড়া কাফন ছাড়িয়ে কঙ্কাল তুলে আনে। দুধ-সাদা কঙ্কাল রাতের আঁধারে ঝিলিক দিয়ে ওঠে। কখনও কখনও সাদা হাড়ের সঙ্গে লেগে থাকে দুর্গন্ধযুক্ত পচা মাংস। নতুন কবরের পাড় ভাঙলে পাঁচ গ্রামে গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ে। আসল ঘটনা ছাপিয়ে নানা ঘটনার জন্ম হয়। বেশিরভাগ মানুষ না দেখে মন মতো কাহিনী সাজায়। মুখরোচক হয় সে কাহিনী। লোকে বলে, ‘কব্বরে লাশ নেই, গায়েব!’ ‘তাই নাকি! ইয়া মাবুদ! এ তো আজাব!’ ‘আজাবের শব্দে কব্বরের গায়ে ফাটল দেখা দিয়িছে; মাটি কাঁপছে।’ ‘ইয়া আল্লা...’ ‘কব্বরের ভেতর দিয়ে আগুনের শিখা দেখা যাচ্ছে; সাপের হিস হিস শব্দ ইত্যাদি।’ এসব কথা খাদেমও শোনে। চুপ থাকে সে। অন্যদের মতো বিস্মিত হতে পারে না সে। আলোচনা প্রসারিত হয়ে এগ্রাম ওগ্রাম গ্রাস করে। যে গ্রামেই এই গুঞ্জন প্রবেশ করে, সে গ্রামে পরবর্তী জুম্মাবারে মসজিদে মুসল্লিদের সমাগম বাড়ে। ইমাম সাহেবরা দরদি গলায় কবরের আজাব বর্ণনা করেন, মুসল্লিদের চোখ ভিজে ওঠে বারবার। ইমাম সাহেব বলেন, ‘মহান আল্লাহপাক মানুষকে নানা মুসিবতে ফেলে ইমানি পরীক্ষা নেন, জগতের যে কোন যন্ত্রণার চেয়ে কবরের আজাব লক্ষগুণ কঠিন।’ খাদেম নির্জন ঘরে শুয়ে কথাগুলো শোনে। তার মনে কথাগুলো দাগ কাটে না। তার কাছে খিদের আজাবই বড়। তার হাই ওঠে। রাতের ধকল তাকে ক্লান্ত করে তুলেছে। খাদেমের বয়ান শুনতে যাওয়া হয়ে ওঠে না। আজ নিয়ে সাতদিন সে প্রায় না খাওয়া। হাতে কোন পার্টি নেই এখন। রাতের ডাক আপাতত নেই বেশ ক’দিন। তারপরও সে সবকিছু ঠিক করে রেখেছে। আজকালই বেরোতে হবে তাকে। ক্ষুধাকাতর শরীরের সর্বত্র আলস্য ছড়িয়ে পড়ে। শরীর মাথা ঝিমঝিম করতে থাকে। এরমধ্যে একখ- তন্দ্রা এসে ভারি করে খাদেমের চোখের পাতা। ক্ষুধার তন্দ্রা গভীর হয় না। তন্দ্রার মাঝে খাদেম ক্ষীণ কণ্ঠের ডাক শোনে। চারদিক অন্ধকার, পচা মাংসের সঙ্গে ভুষভুষে মাটির গুমোট গন্ধমেশা বাতাস তার চোখে-মুখে আছড়ে পড়ে। সাদা কাপড়ের ফাঁক গলে কণ্ঠটি বলে, ‘ও বাপ, আমার শরীলডা ফেরত দে বাপ; শরীলডা অনেকদিন আগলে রেখেছি, মায়া কাটে না। কত ভালবাসা ওই শরীলে, ফেরত দে বাপ...’ তন্দ্রা ছুটে যায় খাদেমের। সারা শরীর ঘামে ভিজে গেছে। স্বরটা এত জীবন্ত যে, দুপুরের একঘেয়ে মাইকিংয়ের মতো কানে আটকে থাকে। কিন্তু খাদেমের মনে কোন অপরাধবোধ দানা বাঁধে না। সে বিড়বিড় করে বলে, ‘শরীল বাঁচাতি শরীল চুরি। এক শরীল খাচ্চি অন্য শরীলে। সাপ যেমনি খাচ্চি ব্যাঙকে, ঠিক তেমন।’ চারদিকে ঝিঁঝি পোকার দামামা বাজিয়ে সন্ধ্যা নামে। দ্রুত অন্ধকার গাঢ় থেকে আরও গাঢ় হতে শুরু করে। খাদেম ক্লান্তি আর অবসাদ দূরে ঠেলে টলমল পায়ে উঠে দাঁড়ায়। আজ সে বেরোবে। আস্তে ধীরে সাদা আলখাল্লাটা বের করে। এলাকায় কবর চুরি বেড়েছে। আর সে কারণেই মানুষ যেমন হঠাৎ হয়ে উঠেছে অতিমাত্রায় ধর্মপ্রবণ, তেমনি মানুষের মধ্যে বেড়েছে আতঙ্ক। কী বৈপরীত্য! গ্রামের ইমাম সাহেবের বয়ান, মসজিদে উপচেপড়া মুসল্লিদের জিকির-আজকার অতি সাধারণ মানুষের মন থেকে ভয় তাড়াতে সক্ষম হয়নি এখনও। আর তাই, এই সাদা পোশাকটার গুরুত্ব বেড়েছে। সম্ভাবনা কম থাকলেও মধ্যরাতে গোরস্থানে সাদা কিছু দেখলেই লোকে ভয় পাবে! চোখ বন্ধ করবে অজান্তেই। জ্ঞানও হারাতে পারে আতঙ্কে। তবে, গোরস্থান আগের মতো নিরাপদ নয় এখন। রাতের মানুষদের কাছে গোরস্থান হয়ে উঠেছে এক প্রশস্ত আশ্রয়কেন্দ্র। চোরাকারবারিরা কবরের গর্তে ফেলে রাখে ফেনসিডিলের পেটি; সেই পেটির খোঁজে আসে পুলিশ। নিরাপত্তার কারণে জোসনাও মাঝে মধ্যে তার নাগরদের সঙ্গে দেখা করে এই গোরস্থানেই। ওর নাকে গোরস্থানের গন্ধ সয়ে গেছে। কুড়িয়ে পাওয়া সোনার আংটি জোসনাকে দেয়ার পর খাদেমের শরীরের বদ গন্ধ জোসনার নাকে আর আগের মতো লাগে না। লাশ তুলতে গিয়ে খাদেম পেয়েছিল একটা সোনার আংটি। মাটি দিতে গিয়ে কারো আঙুল থেকে হয়ত খুলে পড়েছিল। জোসনাকে দিলে সে খুশি হয়, তারপরও বলে, ‘কার না কার সুনা...’ ‘আরে নে, রাখ; সুনা যার কাছে থাকে তার, বুঝলি?’ ‘হ্যাঁ, তা তো ঠিকই।’ ‘আমি তো আর চুরি করিনি, আল্লা দিইচে, তাই না?’ উদাস হয়ে যায় খাদেম। এই ফাঁকে জোসনা আরও গা ঘেঁষে আসে। বিড়বিড় করে খাদেম বলে, ‘হ্যাঁ, সুনা আর মেয়েমানুষÑ যার কাছে থাকে তখন তার।’ ‘কিছু বুলচ?’ ‘নাহ্, কিচু না, এমনি...’ নানা রকমের বাধার মধ্যেই খাদেম ভোমরদহ গ্রামের গোরস্থানে অপারেশন শেষ করে সফলভাবেই। সে গ্রামের রসুল বিষয়টা প্রথম দেখে ভোরের দিকে। সে তার আব্বার কবর জিয়ারত সেরে ফেরার পথে দেখতে পায় জীবন্ত জিনের মতো হাঁ হওয়া কবর! সাদা জীর্ণ কাফনটার কিছু অংশ পড়ে ছিল কবরের পাড়েই। ঢিল খাওয়া মৌমাছির মতো এই সংবাদ এক এলাকা থেকে অন্য এলাকা প্রদক্ষিণ করে চলে। খাদেমের গ্রামের রাহেলা জানায়, ‘অনেকেই নাকি সাদা কি একটা শনশন আওয়াজ করতে করতে কব্বর থেকে টাটকা লাশ মুখে নিয়ে উঠে যেতে দেখেছে।’ জোসনা যার কাছ শুনেছে সে বলছে, ‘সেই কব্বরের মাটি পোড়ামাটির মতো কালো হয়ে আছে, আর কব্বর থেকে ধোঁয়া ওঠা বন্ধ হচ্ছে না।’ কিন্তু হুজুর এসব কথায় কান দিলেন না। তিনি বললেন, ‘এই সব আখেরি দুনিয়ার আলামত, যারা মুর্দা তুলতে যায় তারা বাঁচতে পারে না। কারণ সেই মুর্দাকে পাহারা দেয়া হয়। সেই পাহারা ভাঙা তুচ্ছ মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। তারপরও যদি কেউ চেষ্টা করেÑ সে শয়তান।’ গ্রামের শান্ত রাত্রিগুলো সজাগ হয়ে উঠল ধর্মসভার আওয়াজে। খিচুড়ি গোমাংস আর গরম দুধ খেয়ে, দুলে দুলে ঘুম তাড়িয়ে মাদ্রাসার তালেবানবরা পবিত্র বাণী পাঠ করে চলল। যাতে এই বাণীর আশপাশে যেন শয়তান না ঘেঁষতে পারে। আর সর্বোপরি গ্রামের ধর্মপ্রাণ তরুণরা লাঠি আর মাথায় টুপি নিয়ে গোরস্থানের আশপাশে চৌকি দিতে শুরু করল সারা রাত। উদ্দেশ্য, শয়তানকে হাতে হাতে ধরা। আর এর মাঝেই খুব গোপনে শহর থেকে আসা জিনের বাদশারা খাদেমকে অর্ডার দিয়ে গেল একজোড়া কঙ্কালের। খুবই আর্জেন্ট। মূল্য তিন হাজার। এক হাজার টাকা অগ্রিম নিয়ে খাদেম মনে মনে সিদ্ধান্ত নিল, এই নিচ কাজ আর না, ঘুম হয় না তার। আর একটু ঘুমালেই সেই কণ্ঠটা আকুতি করে বলে, ‘আমার শরীলডা দে বাপ। আমার শরীলডা কত মায়া ভরা। দে বাপ...’ সমগ্র জীবন আর এই পেশার প্রতি ঘেন্না জন্মে গেছে খাদেমের। অন্য কোন পেশা তার এই গ্রামে না জুটলে গ্রাম ছেড়ে শহরে যাবে সে। প্রয়োজনে ভিক্ষে করবেÑ কিন্তু এই পেশাতে আর নয়। তাছাড়া হুজুর বলেছে, ‘যারা লাশ চুরি করে তারা শয়তান। আল্লাহতা’লা শয়তানের জন্যে রেখেছেন সাংঘাতিক আজাব।’ নিশিপাওয়া মানুষের মতো খাদেম যখন গোবিন্দপুর গ্রামের মাঝপাড়া অতিক্রম করল, তখন মধ্যরাত। চারদিকে মহা আয়োজন করে অন্ধকার জাঁকিয়ে বসেছে। এত প্রচার-প্রচারণার পরও গ্রামে সুনসান নীরবতা। একঘেয়ে ঝিঁঝির দলও হঠাৎ কী কারণে জানি থেমে গেছে। হঠাৎ মনটা বড় উচাটন হয়ে ওঠে খাদেমের। জোসনার জন্য হঠাৎই তার মন আকুল হয়ে ওঠে এই মধ্যরাতে। খাদেমের শরীর ও মনের এই ইচ্ছের শক্তি দশ হাতির শক্তিকেও হার মানায়। খাদেম জোসনার বাড়ির দিকে পা বাড়ায়। ছোট্ট একটু ডাক দিতেই ঝাঁপ খুলে বেরিয়ে আসে জোসনা। যেন সে এই ডাকের অপেক্ষাতেই ছিল, নির্ঘুম। বিষয়টা খাদেমকে অভিভূত করে। জীবনটা মুহূর্তে অর্থবহ হয়ে ওঠে তার কাছে। শরীরের সঙ্গে লেপটে থাকা পচা মাংসের গন্ধ ছাপিয়ে সদ্য কেয়াফুলের গন্ধ পায় খাদেম জীবনে প্রথম। ফিসফিসিয়ে জোসনা বলে, ‘এত রাইতে তুুমি কুতাই যাচু?’ ‘যাই আর কুতাই, তর কাছেই আলাম। মনডা ভাল না, ফজরে দাদির কবরডা...’ ‘গোরুস্থানে যাচু? তা ভাল। চোখ-কান খোলা রেখু, একটু তালাশ করবাÑ আর একটু সুনা পালিই আমি একডা দুল গড়াব। রাহেলা খালা বুল্লু, সুনার দাম নাকি বাড়তির দিকে; ভাল করি খুঁজবা এদিক-সেদিক হতে। একডা আলা থাকলি ভাল হোতুক, এখন আবার সাপের সুমায়!’ ‘সাপ’ শব্দ শুনে আঁৎকে ওঠে খাদেম। কিছুই বলে না সে। এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো শুধুই শুনে যায়। শরীরের পচা গন্ধটা আবার বাতাসে ভেসে আসে। ক্লান্তি আর অবসাদে খাদেমের হাই ওঠে পর পর দু’বার। খাদেম বলে, ‘তুই থাক রে, জোসছুন; আমি যাই।’ ‘ভেতরে আসবা না?’ ‘নাহ্, মন চাচি না।’ খাদেম আর দাঁড়ায় না। নিঃশব্দে সামনের দিকে এগুতে থাকে। চলতে চলতে জোসনার খিলখিল হাসি আর ঝাঁপ বন্ধ করার শব্দ শুনতে পায়। খাদেম বুঝতে পারে তার জোসনার ঘরে অন্য লোক আছে। দীর্ঘ পথ নিঃসঙ্গ পাড়ি দিয়ে খাদেম এসে দাঁড়ায় গোরস্থানের রেকি করে যাওয়া নির্দিষ্ট কবরটার পাড়ে। ২ পরদিন ফজরের আগেই গোবিন্দপুরসহ পাঁচ গ্রামে রটে যায়Ñ গোরস্থানের লাশ চোর ধরা পড়েছে। মানুষ না শয়তানের লাশ। হাজার হাজার মানুষ ছুটছে গোরস্থানের মাঠে। মেম্বার সাহেব পুলিশে খবর দিয়েছেন। চোর ধরা পড়েছে, তবে মৃত। অস্বাভাবিক মৃত্যু... উদ্বিগ্ন সবাই দেখল, সাদা পোশাকের একটা বিশাল লাশ। মুখটা তার কবরের গর্তে গোঁজা। অথচ শরীরটা অক্ষত। একটা হাঁ হওয়া পুরনো কবরের মুখে পড়ে আছে। ইমাম আবদুল মালেক মুর্শিদাবাদী দৃঢ়কণ্ঠে বলেন, ‘আল্লাহর সঙ্গে পাল্লা চলে না, তিনি একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত সবকিছু সহ্য করেন। কারণ তিনি দয়াবান ও ধৈর্যশীল।’ উৎসুক মানুষকে সামাল দিতে পুলিশকে হিমশিম খেতে হলো। গ্রামের মানুষ রাগে-ক্ষোভে-ঘৃণায় কেউই মৃতদেহের মুখ পর্যন্ত দেখল না। তবে, ইমাম সাহেব কিছুতেই এই লাশের জানাজা পড়াতে রাজি হলেন না। বললেন, ‘আমার জীবন শেষ হলেও কোন শয়তান কাফেরের জানাজায় শরিক হব না।’ সহজ সরল ধর্মপ্রাণ মানুষদের ধর্মানুভূতিতে আঘাত না দিয়ে বিরক্তমুখে পুলিশ লাশটিকে অজ্ঞাত দেখিয়ে গোলপাতার পাটিতে জড়িয়ে ভ্যানে তুলে ফেলল। পুলিশ জানেÑ হতদরিদ্র দেশে আর কিছু থাক আর না থাক, ধর্মানুভূতি আছে প্রবল মাত্রায়। সামান্যতেই এই অনুভূতি খানখান হয়ে যায়। উপস্থিত সকলে লাশের উদ্দেশে থুথু ছিটিয়ে কাফের নিধনের তৃপ্তি বোধ করে। দুপুর নাগাদ থানার গাড়ি চারদিকে ধুলোর বলয় তৈরি করে সদর উপজেলার দিকে রওনা হলো। ভীতি থাকলেও স্বস্তি ফিরে আসল গোবিন্দপুর গ্রামে। আর এতসব ব্যস্ততার মাঝে কেউই লক্ষ করল না, লাশের গলার বাম পাশে কালো হয়ে ফুলে ওঠা বিসর্গের মতো বিষাক্ত চিহ্নটিকে।
×