ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

সড়ক নির্মাণে নারী শ্রমিক

প্রকাশিত: ০৫:৪২, ৩ মার্চ ২০১৭

সড়ক নির্মাণে নারী শ্রমিক

অবকাঠামোগত সমৃদ্ধিতে প্রতিনিয়তই নির্মাণ শ্রমিকদের মূল্যবান শ্রমবিনিয়োগ দেশের জন্য এক প্রয়োজনীয় সম্পদ। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে এই উন্নয়ন শ্রমের সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ত করে। রাস্তাঘাট নির্মাণে যোগাযোগ ব্যবস্থার যে আধুনিকায়ন সেখানে শ্রমিকদের হাড়ভাঙ্গা খাটুনি উন্নয়নের এই ধারাকে নিরন্তর করে তা বলাই বাহুল্য। সমাজের অর্ধাংশ নারীরা যেমন প্রবৃদ্ধির গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়গুলোতে সক্রিয় ভূমিকা রাখছে সেভাবে নির্মাণ কাজেও তাদের অবদান উল্লেখ করার মতো সড়ক তৈরিতেও নারী শ্রমিক তাদের শ্রম শক্তি বিনিয়োগ করে যায়। সকাল ৮ থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত তাদের কর্মদিবস। রাস্তা নির্মাণের আনুষঙ্গিক উপকরণের মধ্যে ইট, ইটের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভাঙ্গা টুকরো এবং বালির স্তূপ রাস্তা তৈরির প্রাথমিক পর্যায়। রাস্তা তৈরির এসব সূচনা কাজেও নারীরা পুরুষের সমপরিমাণ শ্রমই দিয়ে থাকে। শারীরিকভাবে দুর্বল, সে হিসেবে কোন ধরনের সুযোগ তারা কখনই নেয় না। এর পর থাকে ঝুড়িভর্তি করে বালি আর ইটের বোঝা বহন করে যথাস্থানে রেখে আসা। সেটাও নারীরা যথাযর্থভাবে পালন করতে সক্ষম। আর এসব অবকাঠামোগত প্রকল্পে নারীদের সার্বিক অংশগ্রহণ দেশের উন্নত সড়ক পরিবহন ব্যবস্থায় এক যুগান্তকারী ভূমিকা রাখতে গুরুত্বপূর্ণ শক্তি রূপে কাজ করে। রাস্তাঘাট তৈরিতে বিভিন্ন স্থানে নারী শ্রমিকরা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে কাঠাফাটা রোদে তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালনে ব্যস্ত থাকে। মাথায় হাল্কা পাতলা কাপড়ের বিড়ার ওপর বালি কিংবা ইটের ক্ষুদ্র টুকরো বোঝাই করা ঝুড়ি বহন করে এক জায়গা থেকে অন্য স্থানে নিয়ে যায়। যে পরিমাণ শারীরিক পরিশ্রম হয় তাতে ক্লান্ত হলেও বিশ্রাম নেয়ার সুযোগ একেবারেই থাকে না। তার ওপর সকালবেলায় পরিবারের সমস্ত কাজকর্ম সেরে কর্মস্থানে আসতে হয়। রান্নাবান্না থেকে শুরু করে সন্তানের লালন পালন, স্বামীর পরিচর্যা সবই এক হাতে সামলাতে হয়। নিজেকেও সকাল বেলায় নাস্তা খেয়ে আসতে হয়। দুপুরের খাবার সঙ্গে বেঁধে নিতে হয়। দিন-রাত খাটা খাটনির পরে হাতে আসে পারিশ্রমিক হিসেবে মাত্র ৩০০ টাকা যা দিয়ে পরিবারের পুরোটা না হলেও অনেক চাহিদা মেটাতে হয়। সেখানে আহ্লাদের কোন ব্যাপার থাকে না। যেখানে ন্যূনতম সাংসারিক প্রয়োজন মেটাতেই হিমশিম খেতে হয় সেখানে অন্যান্য বাড়তি আকাক্সক্ষা অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়ে যায়। সামনে আন্তর্জাতিক নারী দিবস। নারী শ্রমিকদের শ্রমঘণ্টা ১২ থেকে কমিয়ে ৮ ঘণ্টার করার দাবিসহ অন্যান্য মানবিক আচরণ সুষ্ঠু পরিবেশ এবং ন্যায্য মজুরি আদায়ের লক্ষ্যে ৮ মার্চ সারা বিশ্বে যে নারী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় তার তাৎপর্য আজকের এই নারী কর্মীদের জানাও নেই। অভাবের তাড়নায় সংসারের প্রয়োজন মেটাতে এসব অসহায় দুস্থ নারী নিজেদের মূল্যবান শ্রমকে উন্নয়নের গতিধারায় নিবেদন করে। মজুরি কিংবা শ্রমঘণ্টার নিরিখে কতটা বঞ্চনার শিকার হতে হয় তা তাদের হয়তবা জানাও নেই। আর্থ- সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক পরিম-লে সুসংহত পরিবারের সীমাবদ্ধ গ-িতে ঘুরপাক খাওয়া এসব সাধারণ নারী শ্রমিক তাদের অবস্থান, মর্যাদা এবং অধিকার নিয়ে ততটা সচেতনও নয়। তারা বোঝেও না তাদের স্বাধীনতা কতখানি, সম্মান আর অধিকার আদায়ে বিধিবিধানের একটা চলমান প্রক্রিয়া আছে সেটাও তাদের বোধের বাইরে। পোশাকশিল্পে নিয়োজিত শ্রমিকরা কিছুটা হলেও তাদের অধিকার এবং প্রাপ্ত পাওনা সম্পর্কে বোঝে। কারণ পোশাকশিল্পে কিংবা অন্যান্য কারখানায় জোটবদ্ধ ট্রেড ইউনিয়নের কর্মপ্রক্রিয়া গতিশীল থাকে। সেখানে তাদের পাওনা শত ভাগ না মিটলেও দাবি আদায়ের লক্ষ্যে আন্দোলন-সংগ্রাম করার একটা পরিবেশ থাকে। সরাসরি মালিক-শ্রমিকের একটা হিসেব-নিকেশ থাকে যাতে শ্রমিকরা তাদের বিধিসম্মত এবং যৌক্তিক পাওনাকে আদায় করার প্রক্রিয়ায় শামিল হতে পারে। কিন্তু পথেঘাটে এসব খ-কালীন নির্মাণ প্রকল্পে শুধু নারী শ্রমিকই নয়, পুরো ব্যবস্থাটাই অনিয়ম এবং দুর্নীতির শিকার। প্রথমত রাস্তাঘাট নির্মাণে আবশ্যকীয় উপকরণাদিতে যে দুর্নীতির আশ্রয় নেয়া হয় তা শুধু অনৈতিকই নয় মারাত্মক ক্ষতিকারকও বটে। ভেজাল এবং নিম্ন মানের উপকরণে প্রকল্পের মূল কাজটি শুরুতেই বিপর্যয়ের কবলে পড়ে। অর্থাৎ নির্মাণ কৌশলের ভিত্তিটাই হরেফ রকম সঙ্কটের আবর্তে পড়ে। আর শ্রমিকদের মজুরি প্রদানের ক্ষেত্রে বিভিন্ন রকম অনিয়মের আশ্রয় নেয়াটা তো অনেকটাই অলিখিত বিধি। যার পরিণতিতে শ্রমিকরা ন্যায্য মজুরি থেকে বঞ্চিত হয়। আর লিঙ্গ বৈষম্যের দুর্বিপাকে পড়ে নারী শ্রমিকরা হয় আরও মারাত্মক ক্ষতির মুখোমুখি। কারণ ন্যায্য মজুরির বঞ্চনার মধ্যে যদি আবার নারী-পুরুষের ফারাক করা হয় তাহলে নারী শ্রমিকের হাড়ভাঙ্গা শ্রমের যথার্থ মূল্য থাকে কোথায়? পথঘাটের এই নির্মাণ শ্রমিকরা মজুরির তুলনায় যে কতখানি শ্রম শক্তি বিনিয়োগ করছে সেটা নিজেদেরও জানা নেই। অশিক্ষা, জড়তা, অসচেতনতা প্রচলিত ধ্যান-ধারণাকে মেনে নেয়ার প্রবণতা সব মিলিয়ে এসব নারী কর্মী নিজেরাই তাদের ব্যাপারে উদাসীন। যত দিন শিক্ষার আলো সর্বত্র না ছড়াবে ততদিন এই ঘোর অন্ধকার কাটার কোন সম্ভাবনা নেই। আত্মশক্তি আর বোধে জাগতে না পারলে সচেতনতাই তৈরি হবে না। নিজের অধিকার আদায়ের লড়াই করার প্রয়োজনীয়তাও কখনও অনুভব করবে না। প্রতিদিনের জীবন প্রবাহের দারিদ্র্যতা, অর্থকষ্টসহ হরেক রকম সমস্যার ঘূর্ণিপাকে পড়া এই অসহায়, দুস্থ, নিঃস্ব নারীরা যেভাবে নিজেদের মহামূল্যবান শ্রম শক্তিকে অকাতরে, নামে মাত্র মজুরিতে বিলিয়ে দেয় তা যেমন অনৈতিক একইভাবে নিষ্পেশনেরও করুণ আখ্যান।
×