ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

টি ইসলাম তারিক

শেষ মিশনে ‘মি. ১০০ পারসেন্ট’

প্রকাশিত: ০৪:৫৭, ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

শেষ মিশনে ‘মি. ১০০ পারসেন্ট’

বয়স যে খুব বেশি তা নয়, মাত্র ৩৩ বছর। যে পারফর্মেন্স তাতে হয়ত ২০১৮ রাশিয়া বিশ্বকাপও খেলতে পারতেন। কিন্তু নিজেকে কি দুর্দান্তভাবেই না নিয়ন্ত্রণ করেছেন ফিলিপ লাম! ২০১৪ সালে জার্মানিকে দুই যুগ পর বিশ্বকাপ জেতানো এই অধিনায়ক ওই বছরের জুলাই মাসে আন্তর্জাতিক ফুটবল থেকে অবসর নেন। অনেকটা আচমকাই জাতীয় দল থেকে নিজেকে সরিয়ে নেন তারকা এই ফুলব্যাক। তখন বলেছিলেন চালিয়ে যাবেন ক্লাব ফুটবল। কথা অনুযায়ী এতদিন প্রাণের ক্লাব বেয়ার্ন মিউনিখের হয়ে খেলা চালিয়ে গেছেন। তবে এবার ক্লাবের মায়াও ছিন্ন করছেন জার্মান তারকা। জাতীয় দল থেকে অবসরের তিন বছর পর এবার সব ধরনের ফুটবল থেকে অবসরের ঘোষণা দিয়েছেন লাম। চলতি মৌসুমই তার শেষ মিশন। অর্থাৎ আগামী জুনেই ফুটবলের বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ার শেষ হয়ে যাচ্ছে বিশ্বের অন্যতম সেরা এই ডিফেন্ডারের। তার আগে বেয়ার্নের টানা পঞ্চম জার্মান লীগ শিরোপা জিততে মুখিয়ে আছেন তিনি। বিদায়বেলায় ক্যারিয়ারে বিশ্বকাপ শিরোপাকে এখনও সেরার আসনে আসীন করে রেখেছেন লাম। ২০১৪ সালে তার নেতৃত্বে বিশ্বকাপের শিরোপা জয় করে জার্মানরা। পুরো ক্যারিয়ারে অবশ্য লাম খুব একটা সহজ পথ পাড়ি দিতে পারেননি। প্রায় সময়ই তাকে ইনজুরির সঙ্গে লড়াই করতে হয়েছে। তবে পেশাদার ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই বেয়ার্ন মিউনিখের সঙ্গে সম্পর্ক অটুট রেখে শেষটাও এখান থেকেই করতে যাচ্ছেন। এই ক্লাবের হয়ে মঙ্গলবার তিনি ৫০১তম ম্যাচ খেলেছেন। মাঝে অবশ্য দুই মৌসুমের জন্য ধারে স্টুটগার্টে খেলেছেন। বেয়ার্নের সাবেক কোচ পেপ গার্ডিওলা লাম সম্পর্কে এক সময় বলেছিলেন, আমার দেখা মতে বিশ্বের অন্যতম চৌকষ ফুটবলার সে। মাঝে মাঝেই তাকে রাইট ব্যাক থেকে মধ্যমাঠে নিয়ে আসতেন গার্ডিওলা। সে কারণেই তার সম্পর্কে বলেছিলেন, লাম যে কোন জায়গায় খেলতে পারে। আমি যদি বলি তবে সে আমার দলের স্ট্রাইকার হতেও রাজি আছে। ২০০৪ সালে জাতীয় দলে অভিষেক হওয়ার পর জার্মানির হয়ে লাম খেলেছেন ১১৩ মাচ। ১৯৯৫ সালে মাত্র ১১ বছর বয়সে তিনি বেয়ার্নে যোগ দেন। ওই সময় নিজেকে এ্যাটাকিং মিডফিল্ডার হিসেবে পরিচিত করেছিলেন। যদিও ১৯৯০-২০০০ এর মধ্যে বেয়ার্নের তারকা মিডফিল্ডার মেহমেত স্কলের কারণে তার জায়গা ছেড়ে দিতে হয়েছে। কিন্তু তখনই ক্লাব সিদ্ধান্ত নেয় লামের সেরা পজিশন হচ্ছে ডিফেন্স। যদিও ইতালিয়ান পাওলো মালদিনি তখন দারুণ ফর্মে। তারপরও লাম নিজেকে সেরা প্রমাণে কঠোর পরিশ্রম করেছেন। মাঠে তার ওপর পুরো দলের আস্থা আনতে সক্ষম হয়েছেন। আর সে কারণেই জার্মান গণমাধ্যমে তাকে ‘মি: ১০০ পারসেন্ট’ নামে আখ্যায়িত করতেও ভুল করেনি। বিশেষ করে ২০১৪ সালে হার্থা বার্লিনের বিরুদ্ধে ৩-১ গোলের জয়ের ম্যাচটিতে লামের অসাধারণ নৈপুণ্য এখনও কেউ ভুলেনি। এই জয়ের ফলে ২০১৩-১৪ মৌসুমে জার্মান লীগের শিরোপা জয়ের রেকর্ড গড়ে বেয়ার্ন। ২০১৪ সালের বিশ্বকাপে গ্রুপ পর্বে মিডফিল্ডার হিসেবে লাম খেলা শুরু করেন। কিন্তু জার্মান কোচ জোয়াকিম লো দ্রুতই তাকে আবারও লেফট ব্যাক পজিশনে নিয়ে আসেন। জার্মানির হয়ে লাম পাঁচটি গোল করেছেন। কিন্তু ২০০৮ সালের ইউরোপীয়ান চ্যাম্পিয়নশিপে সেমিফাইনালে তুরস্কের বিপক্ষে ৯০ মিনিটে তার দেয়া গোলে জার্মানদের জয়টিকে এখনও সবচেয়ে স্মরণীয় ম্যাচ হিসেবে ধরে রেখেছেন লাম। বেয়ার্নের হয়ে লাম সাতটি বুন্দেসলীগা শিরোপা, ৬টি জার্মান কাপ, তিনটি জার্মান সুপার কাপ ও একটি চ্যাম্পিয়ন্স লীগ, ইউরোপীয়ান সুপার লীগ ও ক্লাব বিশ্বকাপের শিরোপা জিতেছেন। ২০১১ সালের জানুয়ারিতে ডাচ মিডফিল্ডার মার্ক ভ্যান বোমেলের কাছ থেকে তিনি বেয়ার্নের অধিনায়কত্ব লাভ করেন। যে বয়স তাতে আগামী বিশ্বকাপও হয়ত ইচ্ছা করলে খেলতে পারতেন লাম। কিন্তু সাফল্য সঙ্গী করেই বুটজোড়া তুলে রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তিনি। লাম আরও কয়েক বছর যে জার্মানির হয়ে খেলতে পারতেন এটা একপ্রকার নিশ্চিত ছিল। বড় দৃষ্টান্ত নিজ দলেই আছে। মিরোসøাভ ক্লোসা। তারকা এই স্ট্রাইকার এবার ব্রাজিল বিশ্বকাপে নিজের ক্যারিয়ারের ষোলকলা সাফল্য পূরণ করেছেন। বিশ্বকাপের ইতিহাসে ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ গোলের (১৬ গোল) অনন্য রেকর্ড গড়ার পাশাপাশি বিশ্বকাপ জয়ের স্বাদ পেয়েছেন। অনেকেই ভেবেছিলেন হয়ত বিশ্বকাপের বড় মঞ্চ থেকেই অবসরের ঘোষণা দেবেন ক্লোসা। বয়সটা ৩৪ হওয়ার কারণেই এমন ধারণা ছিল সবার। কিন্তু অবাক করা ব্যাপার, তখন অবসর নেননি ক্লোসা। অবশ্য মাসকয়েক পরই অবসরে যান তিনি। অবশ্য ২০১০ বিশ্বকাপজয়ী জয়ী স্পেন অধিনায়ক ইকার ক্যাসিয়াসের দুর্দশা দেখে হয়ত সিদ্ধান্ত নিতে অনুপ্রাণিত হয়েছেন লাম। কেননা ২০১০ বিশ্বকাপে ক্যাসিয়াস স্পেনকে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ জেতালেও তার নেতৃত্বে ২০১৪ সালে প্রথম পর্বেই বিদায় নেয় লা রোজারা। কিছুটা অসময়ে হলেও লামের অবসরের ঘোষণাকে সাধুবাদ জানিয়েছেন ফুটবল সংশ্লিষ্টরা। জার্মানির হয়ে অনেক স্বর্ণসাফল্যের সাক্ষী ফিলিপ লাম। ২০০৪ সালে জার্মান জাতীয় দলে অভিষেক হওয়ার পর থেকে নিজেকে অপরিহার্য হিসেবে প্রমাণ করেন লাম। ফুলব্যাক হিসেবে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করেন। তবে দলের প্রয়োজনে গোটা মাঠেও বিচরণ করতে দেখা গেছে তাঁকে। এবারের বিশ্বকাপে রক্ষণভাগ ছেড়ে খেলেছেন মিডফিল্ডেও। ডিফেন্ডার থেকে মিডফিল্ডার সব জায়গাজুড়ে মাঠ দাপিয়ে বেড়ানো লাম বিভিন্ন ক্লাবের হয়ে খেলেছেন ৩৭৬টি ম্যাচ। যার মধ্যে বেয়ার্ন মিউনিখের হয়ে খেলেছেন ২৬০টি ম্যাচে। আর জাতীয় দলের হয়ে ১০ বছরে খেলেছেন ১১৩টি ম্যাচ। গোল করেছেন ৫টি। চৌকষ এই ফুটবলার একসঙ্গে জার্মানি জাতীয় দল ও বেয়ার্ন মিউনিখের অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেন। লামকে ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম সেরা ফুলব্যাক হিসেবে ধরা হয়ে থাকে। তিনি ২০০৬ ও ২০১০ বিশ্বকাপের অল-স্টার দলে জায়গা পেয়েছিলেন। ২০০৮ ও ২০১২ সালের ইউরোতেও তিনি সেরা দলে জায়গা পান। শুধু তাই নয় ২০০৬, ২০০৮ ও ২০১২ উয়েফা বর্ষসেরা দলেও জায়গা পান লাম। ২০১৪ বিশ্বকাপ জেতানা লাম জার্মানির চতুর্থ অধিনায়ক, যিনি বিশ্বকাপ এনে দিয়েছেন দেশকে। তার আগে ১৯৫৪ সালে তৎকালীন পশ্চিম জার্মানিকে বিশ্বকাপ এনে দেন ফ্রিটজ ওয়াটলার। এরপর ১৯৭৪ সালে ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ার ও ১৯৯০ সালে লোথার ম্যাথাউসের নেতৃত্বে বিশ্বকাপ জয় করে পশ্চিম জার্মানি। দুই জার্মানি একীভূত হওয়ার পর এই প্রথমবার বিশ্বকাপ জিতেছে জার্মানি। সেটি এসেছে লামের সুযোগ্য নেতৃত্বে। জার্মানির হয়ে সর্বোচ্চ ম্যাচ খেলার দিকে দিয়ে চতুর্থ স্থানে লাম। তিনি খেলেছেন ১১৩টি ম্যাচ। দেশটির হয়ে সর্বোচ্চ ১৫০টি ম্যাচ খেলেছেন লোথার ম্যাথাউস। দ্বিতীয় স্থানে থাকা মিরোসøাভ ক্লোসা এখন পর্যন্ত খেলেছেন ১৩৭টি ম্যাচ। আর তৃতীয় স্থানে থাকা মিডফিল্ডার লুকাস পোডলস্কি খেলেচেন ১১৬টি ম্যাচ।
×