ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

সুরঞ্জিত প্রয়াণ ॥ একটি অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি

প্রকাশিত: ০৩:৫০, ৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

সুরঞ্জিত প্রয়াণ ॥ একটি অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি

সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত আর নেই। চিরতরে নিভে গেল ভাটির এই ঔজ্জ্বল্যময় পিদিম। আঁধারে আবৃত্ত এখন ভাটি হৃদয়। শাশ্বত সত্যের অপ্রিয় বার্তা করেছে মনোভঙ্গ, আজন্ম ধার দিয়েছে কষ্টক্রন্দন। জীবন জয় অতঃপর পরাজয়ের চিরায়ত রীতি সেনপ্রিয় সকলকে করেছে নিঃস্ব। রাজনীতিতে নবীন যাত্রীবেশী পথিকদ্বয় যেন আচমকা দিকভ্রান্ত। ৫ ফেব্রুয়ারির রৌদ্র চকচকে সকালটা আশীর্বাদ হয়ে আসেনি। হিম সকালের বিয়োগান্তক খবর ভাটিবাংলাকে করেছে চিরশীতল। শান্ত প্রকৃতি যেন আজ শোকে মুহ্যমান। সেদিনের নোনাফোঁটা শিশিরকণায় মিশে স্থান করিয়েছে তৃণভূমি। থেমে গেছে বেদনাবিধূর কালনীর বহমান গতি, থেমে গেছে সুরমার ছলছল আওয়াজ, থেমে গেছে বাউলের সেতারি সুর। নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে আছে হাওরের শোকাতুর হিজল-করচ। তরুলতা বৃক্ষপাতা পক্ষীকণ্ঠে যেন হারানোর সুর। ভাটির চিরসবুজ মাঠবক্ষে স্বজনশূন্য আর্তনাদ। বিবর্ণ প্রান্তরে হাহাকার, অতৃপ্তিছটা। পল্লীপথ ঘরবাড়ি উঠোনে নীরব পতন। কুচকুচে কালো ফিঙে সর্বত্র ছড়িয়েছে শোকানল। চারপাশে ব্যথিত প্রাণের মুমূর্ষু কল্লোল। হারিয়ে গেছে প্রকৃতির প্রকৃত স্বাচ্ছন্দ্যবোধ। এ যেন আপনজন চলে যাওয়ার চিরবিদায়ী ক্ষত কেতন। প্রিয় সুরঞ্জিতের সুনামগঞ্জে জন্ম নেওয়া একজন যুবাবয়সী কলমসৈনিক হিসেবে নিজেকে খুব অসহায় মনে হচ্ছে। ভাবতে হচ্ছে বার বারÑ কি হারালাম! বঙ্গভাটির প্রাণপুরুষ-প্রিয় স্বজন, মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, শ্রুতিমধুর বক্তা, রাজনীতির বরপুত্র, অন্যতম সংবিধান প্রণেতা, বর্ষীয়ান ও বিচক্ষণ রাজনীতিক, উপমহাদেশের বিশিষ্ট পার্লামেন্টারিয়ান সর্বজন শ্রদ্ধেয় সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের মৃত্যু ভাটির জনপদ তথা বাংলাদেশকে করেছে দুঃখভারাক্রান্ত। হাওরাঞ্চল খ্যাত ভাটির প্রত্যন্ত অঞ্চলে জন্ম নেওয়া এই সিংহপুরুষের বিয়োগ ব্যথা সহ্য করা সত্যিই অসম্ভব। এ প্রস্থান মেনে নেওয়া কঠিন। রাজনীতির আঁতুড়ঘরে তিনি ছিলেন বলিষ্ঠ সন্তান। সুনামগঞ্জের আওয়ামী রাজনীতিতে অভিভাবকতুল্য এ নেতার চিরবিদায়ে থমকে গেছে সবকিছু। রাজনীতির মাঠে জাঁদরেল খেলোয়াড় সুরঞ্জিত খেলা দেখিয়েছেন সেই তরুণ বয়সেই। পেয়েছেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ¯েœহাস্পদ সাহচর্য। বুক পেতে মাথা উঁচিয়ে লড়েছেন মুক্তিযুদ্ধের মহান যুদ্ধ ময়দানে। সাহস, প্রজ্ঞা, মেধা-মননে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন অনন্য উচ্চতায়। জায়গা করে নিয়েছেন মানুষের শ্রদ্ধাশীল হৃদয়ে। কারও দাদা, কারও কাকু, কারও জেঠু আবার কারও অভিভাবকরূপে আগলে রেখেছেন ভরসাকারী সকলকে। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত একটি নাম, একটি ইতিহাস, একটি রঙিন নিশান। তাঁর বর্ণাঢ্য জীবনের বাঁকে বাঁকে রয়েছে অনুসরণীয় অনেক অনুষঙ্গ। তিনি দেশকে যা দিলেন, তা নিঃসন্দেহে স্মরণযোগ্য। রাজনীতির রণতরীর গুণ ধরা একজন সফল পথ প্রদর্শক। জনপ্রিয় জননেতার আসনে বসা সুরঞ্জিত সাধারণ মানুষকে কাছে টানতেন চুম্বকের মতো। তাঁর বক্তব্যের সুস্পষ্ট শব্দ চয়ন, সুমধুর বচন প্রয়োগ এবং দৃষ্টিনন্দন বাচনভঙ্গি, সবকিছু ছিল প্রাণবন্ত। প্রাণসঞ্চারী নিদর্শন। তিনি আজ নেই আমাদের মাঝে। কিন্তু তিনি আছেন। তিনি আছেন বাংলাদেশ সংবিধানের পাতায় পাতায়, আছেন আন্দোলন-সংগ্রাম, জেল-জুলুম, প্রতিবাদ-প্রতিরোধের অতীত ময়দানে। আছেন ভাটি-বাংলার মাটি-মানুষ ও বিস্মৃত অঙ্গনজুড়ে। তিনি থাকবেন মানুষের মুখে মুখে প্রিয় সেনবাবু হয়ে। তাঁর দৈহিক অস্তিত্ব হয়তো আমাদের মাঝে নেই। তবে তিনি থাকবেন হাস্যরসে পূর্ণ এক চিরঞ্জীব আত্মারূপে। সংবাদপত্রের পাতায় উঠে এসেছে খ্যাতিমান এই রাজনীতিকের জীবন শুরু ও শেষের ঘটনাবহুল ইতিহাস। পাঁচ দশকের বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনে সুরঞ্জিত সেন পেয়েছেন সম্মান, খ্যাতি, মর্যাদা। সত্তরের প্রাদেশিক পরিষদে তিনি ছিলেন অন্যতম কনিষ্ঠ সদস্য। ছাত্রাবস্থায় রাজনৈতিক জীবন শুরু করেন এই প্রবীণ নেতা। স্বাধীন দেশের প্রথম সংসদ সদস্যসহ ৭ বার জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন তিনি। পালন করেছেন অবিস্মরণীয় দায়িত্ব। ষাটের দশকে বাম রাজনীতির মাধ্যমে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের সক্রিয় রাজনীতির শুরু। ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতির মাধ্যমে পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে রাজপথ কাঁপিয়েছেন। এগারো দফা, ছয় দফা আন্দোলন, সত্তরে ন্যাশনাল আসেম্বলির সদস্য, সাব-সেক্টর কমান্ডার হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন তিনি। ছাত্র ইউনিয়ন থেকে ন্যাপের কেন্দ্রীয় কমিটি, এরপর একতা পার্টি, গণতন্ত্রী পার্টি হয়ে পরে নব্বইয়ের দশকে আওয়ামী লীগ। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মওলানা ভাসানীর রাজনৈতিক প্রভাব ছিল তার মধ্যে। মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ছিলেন একজন সক্রিয় যোদ্ধা। তিনি ৫ নম্বর সেক্টরের সাব-সেক্টর কমান্ডারের দায়িত্ব পালনসহ মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবেও গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে ছিলেন। নবম জাতীয় সংসদের দ্বাদশ অধিবেশনে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী কমিটিরও কো- চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। ১৯৪৫ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি সুনামগঞ্জ জেলার দিরাই উপজেলাধীন আনোয়ারপুর গ্রামের একটি সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। তাঁর পিতা ডা. দেবেন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত ও মাতা সুমতি বালা সেনগুপ্ত। তিনি দিরাই উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি এবং সিলেট এমসি কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাস বিভাগে বিএ (সম্মান) এবং এম এ ডিগ্রী লাভ করেন। এরপর তিনি ঢাকা সেন্ট্রাল ‘ল’ কলেজ থেকে এলএলবি ডিগ্রী অর্জন করেন। তিনি ১৯৭০ সালের নির্বাচনে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন এবং পরবর্তীতে ১৯৭৯, ১৯৮৬, ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১ এবং ২০০৯ সালে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি মহাজোট সরকারের মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের আগে আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের সহধর্মিণী ড. জয়া সেনগুপ্ত একটি বেসরকারী সংস্থায় দায়িত্বশীল পদে কর্মরত আছেন। একমাত্র পুত্র সৌমেন সেনগুপ্ত একজন আইটি প্রকৌশলী। বর্তমানে একটি বেসরকারী কোম্পানিতে কর্মরত। ৫৬ বছরের রাজনৈতিক জীবনে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রথম সারির রাজনীতিকের আসনে বসলেও ২০১১ সালের ২৮ নবেম্বর প্রথমবারের মতো রেলমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন সুরঞ্জিত। ২০১২ সালের ৯ এপ্রিল তাঁর এপিএসের গাড়িতে বিপুল পরিমাণ অর্থ উদ্ধারের ঘটনায় এপিএসের দায় নিজের কাঁধে নিয়ে অবশেষে পদত্যাগ করে দেশের ইতিহাসে নজির সৃষ্টি করেন তিনি। বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের অধিকারী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ৫ ফেব্রুয়ারি রোববার ভোররাত ৪টা ২৪ মিনিটে ৭২ বছর বয়সে সবাইকে ছেড়ে চলে গেলেন লোকচক্ষুর অন্তরালে। পুবের বঙ্গকাশে সূর্য ওঠার সম্মুখ প্রভাতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন হাওরপারের সূর্যসন্তান সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। মৃত্যু নামক চিরন্তন বাস্তবতা তাকে কেড়ে নেয় আমাদের মাঝ থেকে। পাহাড়সম বিষাদময় অতৃপ্ত মনে বলতে ইচ্ছে করছে, মৃত্যু তুমি কঠিন স্বার্থপর। তোমার একতরফা নীতির কাছে সমগ্র প্রাণীকুল পরাস্ত। বিশ্বজয়ী বিশাল কর্মের অধিকারী কোন কীর্তিমান মানুষের বৃহৎ কীর্তিও তোমাকে তোমার নিজস্ব সিদ্ধান্ত থেকে সরাতে পারে না। এ কেমন রীতি তোমার, হে মৃত্যুমহাজন! যদি দয়া করতে, একটু নিঃস্বার্থ চিন্তা করতে তাহলে হয়ত সুরঞ্জিত সেনের মতো কৃতিত্বের পরিচায়ক মানুষগুলোকে হারাতে হতো না। কি আর করা, দোষতো আর তোমার নয়। বিধির বেঁধে দেওয়া বিধান খ-নের ক্ষমতা কারও নেই। স্রষ্টার সৃষ্টি ও বিনাশের অমোঘ রীতি অনুযায়ী সবাইকে একদিন চলে যেতে হয়। সেই হৃদয়বিদারক ধারা থেকে নিজেকে আর জীবন মাঝে আটকাতে পারেননি বর্ষীয়ান এই রাজনীতিক। তিনি চলে গেছেন না ফেরার দেশে। তার আত্মার শান্তি কামনা করছি এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি জানাচ্ছি গভীর সমবেদনা। জন্ম হলে মৃত্যু অবশ্যাম্ভাবী। কিছু কিছু মৃত্যু আছে সকলকে ভাবিয়ে তুলে। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত এমনই একজন মানুষ। তাঁর মৃত্যুতে শূন্যতা তৈরি হয়েছে সমগ্র রাজনৈতিক অঙ্গনে। এ শূন্য জায়গা সহজে পূরণ হবে না। এটা শুধু কথার কথা নয়। সুরঞ্জিত সেনের মতো প্রজ্ঞাবান মেধাবী পরীক্ষিত রাজনীতিক বর্তমান বাস্তবতায় সত্যিই দুর্লভ। আর সৃষ্টিও হবে না চলমান রাজনীতির সংকুচিত মাঠে। রাজনৈতিক আদর্শ ও বিচক্ষণ নেতৃত্বের মহাবীর ভাটিবন্ধুর চলে যাওয়াটা নিশ্চয়ই অপূরণীয় ক্ষতি। চলতে ফিরতে সবাই অনুভব করবে এর মাত্রা কতটা যন্ত্রণাদায়ক। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে দৃষ্টি রাখলে বোঝা যায় সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে হারানোর যন্ত্রণা কতটা তীব্র। আবার বিরোধী চিন্তা চেতনার ঘৃণ্য মানুষগুলো এই মৃত্যুযাত্রী মানুষটাকে নিয়ে ফেসবুকে নানা কুৎসা, অপবাদ, অপপ্রচারে মত্ত রয়েছে। এদের প্রতি রইল সংশোধিত হওয়ার তাগিদ। কারণ, মৃত্যুর কাছে সকলকেই মাথা নত করতে হবে। তাই পরলোকের কথা চিন্তা করে ভাল বলাটাই শ্রেয়। লেখক : সাংবাদিক
×