ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মারুফ রসূল

গণজাগরণের চার বছর ॥ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির রাজনীতি

প্রকাশিত: ০৫:৩৩, ৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

গণজাগরণের চার বছর ॥ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির রাজনীতি

আগামীকাল ৫ ফেব্রুয়ারি গণজাগরণ মঞ্চের চার বছর পূর্তি। চার বছর আগে, ২০১৩ সালের এই দিনে সকল যুদ্ধাপরাধীর সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে এক ঐক্যবদ্ধ গণ-আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল শাহবাগের প্রজš§ চত্বরে। ১৯৭১ সালের মহাকাব্যিক মুক্তিযুদ্ধে যে হিংস্র হায়েনারা বর্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে গণহত্যা, নারী নির্যাতন আর লুটপাটে ধ্বংস করে দিতে চেয়েছিল বাঙালী জাতিকে, তাদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে এক ঐক্যবদ্ধ দ্রোহী বাংলাদেশ জেগে উঠেছিল সেদিন। যে দাবি নিয়ে ১৯৭২ সালে মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের পরিবার সোচ্চার হয়েছিল, যে দাবিতে আন্দোলনের সূচনা করেছিলেন মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ১৯৭৯ সালে। ১৯৮৮ সালে ডা. এম এ হাসানের নেতৃত্বে যে দাবিতে গঠিত হয়েছিল শহীদ লেফটেন্যান্ট সেলিম মঞ্চ, ১৯৯২ সালের ১৯ জানুয়ারি শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গঠিত ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি যে দাবিতে সারাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করেছিলেনÑ তারই ধারাবাহিকতার সূর্যমুখী উদ্বোধন ২০১৩ সালের পাঁচই ফেব্রুয়ারি গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন। আন্দোলনের এই ধারাবহিকতা বিশ্লেষণ করলেই বোঝা যায়, প্রতিটি আন্দোলন কীভাবে একেকটি প্রজš§কে তৈরি করেছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাংলাদেশ বিনির্মাণে। সে-ই অর্থে গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনও একটি প্রজšে§র মাঝে সঞ্চারিত করেছে মুক্তিযুদ্ধের ঐশ্বর্যমণ্ডিত চেতনা, তাদের সামনে মেলে ধরেছে স্বজাতির ইতিহাসের দার্ঢ্য আকাশ। এই প্রজš§ কোথায় কীভাবে তৈরি হচ্ছে সে খবর আমাদের কাছে নেই, যেমন শহীদ জননীর কাছেও ছিল না আমাদের বেড়ে ওঠার পথে তাঁর অনন্য অবদানের খতিয়ান; কিন্তু জাতির প্রয়োজনে, ইতিহাসের দায় শোধ করতে, ন্যায্যতার দাবিতে আমাদের প্রজš§ রাস্তায় নেমেছে। এ কারণেই শাহবাগ থেকে এই সত্য বারবার উচ্চারিত হয়েছেÑ আমরা শহীদ জননীর সন্তান। ২০১৩ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি গণজাগরণ মঞ্চের পক্ষ থেকে মহান জাতীয় সংসদের তৎকালীন স্পীকার আব্দুল হামিদের কাছে সুনির্দিষ্ট ছয় দফা সংবলিত যে স্মারকলিপি প্রদান করা হয়েছিল, সেখানেই স্পষ্ট উল্লেখ করা হয়েছিল শাহবাগ আন্দোলনের স্পষ্ট গতিপথ। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল যুদ্ধাপরাধীদের বিচার। এখানে বলে রাখা প্রয়োজন, নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়লাভের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট এমন একটি বাংলাদেশে সরকার গঠন করেছিল, যা কেবল যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করতে না পারার ক্ষতেই রক্তাক্ত ছিল না, বরং সেই ক্ষত আরও বেদনাদায়ক হয়েছিল অষ্টম জাতীয় সংসদে যুদ্ধাপরাধীদের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হবার মধ্য দিয়ে। সুতরাং গণ-মানুষের রাজনৈতিক দল হিসেবে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার প্রলম্বিত হতে বাধ্য। কারণ, বিষয়টি কেবলই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, তা বিস্তৃত ধর্মের নামে তাদের অপরাজনৈতিক কৌশল মোকাবেলাতেও। পঁচাত্তরের কলঙ্কজনক অধ্যায়ের পর বাংলাদেশ পেছন দিকে হাঁটতে শুরু করে। পঁচাত্তর পরবর্তী প্রতিটি সামরিক সরকার তাদের পাকিস্তানী ভাবাদর্শ বাস্তবায়নের জন্য যুদ্ধাপরাধীদের রাজনীতি করার সুযোগ দেয়, তাদের রাজনৈতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করে। ১৯৯১ সালে তথাকথিত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথা বলা হলেও আদতে গণতন্ত্রের মোড়কে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল জামায়াততন্ত্র। আর সেই জামায়াততন্ত্র বিএনপির হাত ধরে ২০০১ সালের পর প্রবেশ করে সংসদে। অপবিত্র হয় আমাদের দীর্ঘ সংগ্রামের ইতিহাস। পঁচাত্তরপরবর্তী রাজনৈতিক মেরুদণ্ডহীনতার সুযোগে যুদ্ধাপরাধীরা অর্থনৈতিকভাবে ফুলে-ফেঁপে উঠে। সাপের বংশধর বাড়তে থাকে। ২০০১ সালের পর একটি সময় এসেছিল বাংলাদেশে, যখন হতাশা ও ধোঁয়া ছাড়া আর কোন দৃশ্যকল্প ছিল না; বিলাপ ও আর্তনাদ ছাড়া কোন উচ্চারণ ছিল না। যুদ্ধাপরাধীদের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠা আমাদের উৎখাত করতে চেয়েছিল পূর্ব-পুরুষের রক্তে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশ থেকে। ॥ দুই ॥ গণজাগরণ মঞ্চের ছয় দফা দাবি পঁচাত্তরপরবর্তী বিপর্যস্ত বাংলাদেশের মানচিত্রকে সামনে রেখে তৈরি করা হয়েছিল। কেবল সকল যুদ্ধাপরাধীর সর্বোচ্চ শাস্তিই নয়, জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধকরণ ও তাদের অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবিও ছিল সুস্পষ্ট। গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন থেকে বারবার যে কথা বলা হয়েছিলÑ বাংলাদেশের রাজনীতি হবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষের শক্তির রাজনীতি। স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের যে সূর্যমুখী ঐতিহাসিক সত্য, তার বেদীমূলে দাঁড়িয়েই রাজনীতি করতে হবে। রাজনৈতিক আদর্শের ভিন্নতা থাকতে পারে, রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে ভিন্নতা থাকবেই, রাজনৈতিক দলগুলোর অর্থনৈতিক পরিকল্পনাও হতে পারে ভিন্ন, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর প্রশ্নে সকল রাজনৈতিক দলকে ইতিহাসের সত্যে দাঁড়াতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে অস্বীকার করে বাংলাদেশে রাজনীতি করা যাবে নাÑ এই বাক্য বারবার গণজাগরণ মঞ্চ থেকে উচ্চারিত হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী অপশক্তি স্বাধীন বাংলাদেশে রাজনীতি করে যাবে, তাদের পাকিস্তানী অপদর্শন একের পর এক বাস্তবায়ন করে যাবেÑ এই বাংলাদেশের জন্য ত্রিশ লক্ষাধিক শহীদ রক্ত দেননি। পৃথিবীর আর কোন রাষ্ট্র মায়ের ভাষার জন্য, স্বাধীনতার জন্য, একটি জাতীয় পতাকার জন্য এত রক্ত দিয়েছে? সেই স্বাধীনতার শির উন্নত রাখার দায়িত্ব আমাদের। রাজনীতি কখনও রাষ্ট্র বা রাষ্ট্রের নাগরিক বিযুক্ত কোন বিষয় নয়। উনিশ শ’ একাত্তর বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের প্রারম্ভিকা। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন থেকে অসাম্প্রদায়িক চেতনার যে ভ্রƒণ তৈরি হয়েছিল, তারই পরিণত বিকাশ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। একাত্তর আমাদের জš§দাগ। তাকে অস্বীকার করা মানে জাতিরাষ্ট্রের জন্মটাকেই অস্বীকার করা। এই ধ্রুব সত্যকে পাশ কাটিয়ে বাংলাদেশে অনেক রাজনৈতিক দলের উত্থান আমরা দেখেছি। ইতিহাসের হিসাব মিলিয়ে দেখলে বোঝা যায়, এই অপআদর্শের রাজনৈতিক দলগুলো মুখে যা-ই বলুক না কেন তাদের উৎস এক ও অভিন্ন। মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তি জামায়াত-মুসলিম লীগ, পঁচাত্তরের পর রাজনীতিতে তাদের পুনঃপ্রতিষ্ঠা হয় স্বৈরশাসক জিয়াউর রহমানের হাতে, মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে ভূ-লুণ্ঠিত করে আরেক স্বৈরাচার এরশাদ এবং সবশেষ যুদ্ধাপরাধীদের গাড়িতে জাতীয় পতাকা তুলে দিয়ে সমগ্র ইতিহাসকে অপমান করে জিয়াউর রহমানের প্রতিষ্ঠিত দল বিএনপি এবং তার স্ত্রী খালেদা জিয়া। অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশে ধর্মীয় উগ্রতাকে রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় বাঁচিয়ে রাখে বিএনপি, তাদেরই মদদে ছড়ানো হয় সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস। সব রসুনের গোড়া এক। ॥ তিন ॥ স্বাধীনতাবিরোধীদের এই রাজনৈতিক লেখচিত্রের দিকে আঙুল তুলেই গণজাগরণ মঞ্চ বারবার বলেছে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির রাজনীতির কথা। পৃথিবীর কোন সভ্য রাষ্ট্রে স্বাধীনতার স্থপতিকে অপমান করে কেউ রাজনীতি করতে পারে না। পৃথিবীর কোথাও যুদ্ধাপরাধীদের রাজনীতি করার অধিকার নেই। স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করে রাজনৈতিক ক্ষমতায় আসার নজির সম্ভবত বাংলাদেশেই একমাত্র। এই চক্রব্যূহ ভাঙতে হবে। আর রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগকেই সে দায়িত্বটি পালন করতে হবে একাত্তরের মতো। গণজাগরণ মঞ্চের চার বছরের মাথায় এ সত্যও আমাদের কাছে স্পষ্ট যে, কাজটি এত সহজ নয়। কারণ, বিগত তিন বছরে আমরা প্রত্যক্ষ করেছি কীভাবে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মহলে নানাবিধ মিথ্যাচার করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকে বাধাগ্রস্ত করার অপচেষ্টা করা হয়েছে। বাংলাদেশে জঙ্গীবাদের ভয়ানক উত্থানের পেছনে পাকিস্তানী মদদের ভূমিকা হাতেনাতে প্রমাণিত হয়েছে। সবচেয়ে বড় যে বিষয়টি, এই স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি হিংস্র সাপের মতো ভিড়ে যাচ্ছে আওয়ামী লীগেই। সারাদেশের নানা প্রান্তের খবর পড়লে বোঝা যায়, কীভাবে আওয়ামী লীগের ভেতর থেকেই তারা সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস ছড়াচ্ছে। কিন্তু আওয়ামী লীগ তো আদর্শের রাজনৈতিক দল। মুক্তিযুদ্ধের পারাবারপ্রতিম আদর্শকে নিয়েই তার রাজনীতি। অর্থাৎ ক্ষমতায় থাকলেও ষড়যন্ত্রের শিকার হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী এই রাজনৈতিক দলটি। এই ষড়যন্ত্র কেবল আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধেই নয়, গোটা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে। তাকে প্রতিহত করার দায়িত্বও আমাদের সকলের। গণজাগরণ মঞ্চের চার বছরপূর্তিতে লড়াইয়ের এই প্রত্যয়টুকুও আমাদের আপ্তবাক্য, আমাদের চলমান আন্দোলনের বীজমন্ত্র। লেখক : গণজাগরণ মঞ্চের কর্মী
×