ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

২ মাসে পাইকারিতে দাম বেড়েছে বস্তা প্রতি ১৫০ থেকে ৬০০ টাকা

ভরা মৌসুমে চালের বাজার অস্থির

প্রকাশিত: ০৩:৫৩, ২৯ জানুয়ারি ২০১৭

ভরা মৌসুমে চালের বাজার অস্থির

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ আমনের ভরা মৌসুমে প্রতিদিনই বাজারে আসছে নতুন ধান-চাল। এরই মাঝে হঠাৎ করে বাড়তে শুরু করেছে চালের দাম। ২ মাসের ব্যবধানে পাইকারিতে চাল ভেদে বস্তা প্রতি ১৫০ থেকে ৬০০ টাকা পর্যন্ত দাম বেড়েছে। আর খুচরা বাজারে প্রতি কেজিতে দাম বেড়েছে ৪ থেকে ৬ টাকা। দীর্ঘদিন স্থিতিশীল থাকার পর আমনের ভরা মৌসুমে দাম বাড়ার কারণে হিসেবে পাইদের মজুদকরণকেই দায়ী করছেন অনেকেই। খুচরা ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, পাইকারির কাছ থেকে বেশি দামে কেনার কারণে খুচরা বাজারে বেশি দামে চাল বিক্রি করতে হচ্ছে। এমন অভিযোগকে ভিত্তিহীন বলে দাবি করছেন চট্টগ্রামের পাইকারি ব্যবসায়ীরা। তাদের মতে, দেশী চালের প্রধান উৎস উত্তরবঙ্গের মিল মালিক এবং সেখানকার ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের কারণে চালের দাম ব্যাপক হারে বাড়ছে। উর্ধমুখী চালের বাজারে আরেক দফায় বেড়েছে মিনিকেট ও আটাশ চালের দাম। মোজাম্মেল মিনিকেট বিক্রি হচ্ছে ৫২ টাকায়। নাজিরশাইল বিক্রি হচ্ছে ৫০-৫৫ টাকায়, হবি আঠাশ বিক্রি হচ্ছে ৪২ টাকায়। স্বর্ণা বিক্রি হচ্ছে ৪০ টাকায়, পাইজাম বিক্রি হচ্ছে ৪২ টাকায়, আঠাশ বিক্রি হচ্ছে ৪৫ টাকা কেজিতে। অতিরিক্ত পরিবহন খরচ ও মিল মালিকদের অধিক মুনাফার মানসিকতার কারণে দাম বেড়েছে বলে মনে করেন ব্যবসায়ীরা। পাইকার ও খুচরা ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন সূত্রকে দায়ী করে পার পেলেও চালের দাম বাড়ার জন্য ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন ভোক্তারা। গত কয়েকদিনে চট্টগ্রামের পাহাড়তলী ও খাতুনগঞ্জ বাজার এলাকায় দেখা গেছে, ৫০ কেজি ওজনের প্রতি বস্তা জিরা সিদ্ধা চাল বিক্রি হচ্ছে ২৪০০ টাকায়; যা গত নবেম্বরে ২০০০ টাকায় বিক্রি হয়েছিল। অর্থাৎ দুই মাসের ব্যবধানে এ চালের দাম ৪০০ টাকা বেড়েছে। এছাড়া পাইজাম সিদ্ধ ২৫০ টাকা বেড়ে ১৮০০ থেকে ১৮৫০ টাকা; স্বর্ণা ১৫০ টাকা বেড়ে ১৭৫০ টাকা; সিদ্ধ মোটা চাল ১০০ টাকা বেড়ে ১৬৫০ টাকা; মিনিকেট আতপ ৩০০ টাকা বেড়ে ২২০০ টাকা এবং বেতি চাল ৩৫০ টাকা বেড়ে ১৯৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আর কাটারিভোগ মান ভেদে ২৪০০ থেকে ২৯০০ টাকা; চিনিগুঁড়া আতপ চাল ৪৬০০ থেকে ৪৯০০ টাকা এবং নাজিরশাইল চাল ১৮০০ থেকে ২৪২৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। অন্যদিকে পাইকারি বাজারের তুলনায় খুচরা বাজারে প্রতি কেজি চালের দাম ৫ টাকা করে বেশি রাখা হচ্ছে। খুচরা বাজারে মিনিকেট ২৮ নম্বর চাল ১৯৫০ টাকা; মিনিকেট ২৯ নম্বর চাল ১৬৬০ টাকা; কাটারি পাইজাম চাল ২৩৫০ টাকা এবং বালাম সিদ্ধ চাল ১৬৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। পাহাড়তলী বাজারের চাল ব্যবসায়ী নজরুল ইসলাম বলেন, উত্তরবঙ্গের চাল ব্যবসায়ী ও মিল মালিকরা সিন্ডিকেটের মাধ্যমে চালের দাম বাড়াচ্ছে। আর পাইকারি বাজার থেকে চাল কেনার পর পরিবহন ব্যয়ের খরচও আমাদের দিতে হয়। ফলে আগের দামের চেয়ে বেশি দামেই বিক্রি করতে হচ্ছে সব ধরনের চাল। তবে এখন বাজারে চালের কোন কৃত্রিম সঙ্কট নেই। তিনি আরও বলেন, গত বছরের শেষ দিকে চালের বাজার অনেকটা স্থিতিশীল ছিল। কিন্তু নতুন বছরে হঠাৎ সব ধরনের চালের দাম বেড়েছে। আমন ধান পুরোদমে বাজারে আসলে সব ধরনের চালের দাম আবারও কমে যাবে। আগ্রাবাদের গোসাইলডাঙ্গার খুচরা চাল ব্যবসায়ী তিলক দত্ত জানান, বাজারে চালের কোন সংকট নেই। তবু আমাদের বেশি দামে চাল কিনতে হচ্ছে। কারসাজির মাধ্যমেই প্রতি সপ্তাহে চালের দাম বাড়ানো হচ্ছে। কনজ্যুমার্স এ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট এস.এম. নাজের হোসাইন জানান, চালের বাজারে কোন সংকট না থাকলেও নিয়মিত দাম বাড়াচ্ছে ব্যবসায়ীরা। দাম বাড়াতে বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যবসায়ী বিভিন্ন অজুহাত দেখাচ্ছে। তিনি বলেন, বর্তমানে দেশে উৎপাদিত চালেই দেশের চাহিদা পূরণ হচ্ছে। এ সময় চালের দাম বাড়ার কোন প্রশ্নই আসে না। তবে বাজার মনিটরিং না থাকায় চালের দাম বাড়াচ্ছে অসাধু ব্যবসায়ীরা। নিয়মিত মনিটরিং হলে চালসহ সব পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। ক্যাবের জরিপের বরাত দিয়ে এস.এম. নাজের হোসাইন জানান, চট্টগ্রামে গত আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে পাইজাম সিদ্ধ চালের প্রতি বস্তা ১৩০০ টাকায় বিক্রি হয়েছিল। আর বেতি আতপ চাল ১৪০০ টাকায় বিক্রি হয়েছিল। পাহাড়তলী বণিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক এস.এম. নিজাম উদ্দিন বলেন, গত বছরের জুলাই থেকে চালের দাম বাড়তে শুরু করে। আগস্ট মাসে খাদ্য বিভাগের ধান চাল সংগ্রহ কর্মসূচী শুরুর পর মোটা ও সিদ্ধ চালের দাম অনেক বেশি বাড়ে। ওই সময় আতপ চিকন ও মোটা চালের সঙ্গে সিদ্ধ চালের দামও বেড়েছিল। মূলত সিন্ডিকেটের কারণেই দাম বাড়ছে। এদিকে বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাজারে চালের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে উত্তরবঙ্গের চাল ব্যবসায়ীদের সব সিন্ডিকেট ভেঙ্গে দিতে হবে। বর্তমানে তারাই চালের কৃত্রিম সংকট তৈরি করে বাজারে দাম বাড়াচ্ছে। সরকারী পর্যায়ে বাজার মনিটরিং শুরু হলে চালসহ সব ধরনের পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। দেশের চালের বৃহত্তম বাজার কুষ্টিয়ায় অস্থির হয়ে উঠেছে চালের দাম। খুচরা বিক্রেতাদের অভিযোগ, মিল মালিকদের মজুদের কারণে চালের বাজারে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। তবে মিলারদের দাবি, চলতি মৌসুমে মোটা ধান কম চাষ করেছে কৃষকরা। গত এক সপ্তাহে কুষ্টিয়ার মোকামে প্রায় সব ধরনের চালের দাম বেড়েছে। বিশেষ করে পাইকারি বাজারে মোটা চালের দাম কেজিতে বেড়েছে ৮ থেকে ১০ টাকা। আর চিকন চালে বেড়েছে ৪ থেকে ৫ টাকা। খুচরা বাজারে এই হার আরও বেশি। পাইকারি বিক্রেতাদের দাবি, ধান সঙ্কটের অজুহাতে ইচ্ছা মতো দাম বাড়াচ্ছেন চাল কল মালিকরা। তবে চালকল মালিকরা বলছেন, চলতি মৌসুমে কৃষক মোটা ধান কম চাষ করায় বেশি টাকা দিয়ে ধান কিনতে হচ্ছে। একদিকে ধানের সংকট অন্যদিকে বেশি দামে ধান কিনতে হচ্ছে বলেই বেড়েছে চালের দাম। এদিকে, হঠাৎ করে চালের দাম বাড়ায় উদ্বিগ্ন সাধারণ মানুষ। এ অবস্থায় দ্রুত চালের দাম সহনশীল পর্যায়ে নিয়ে আনার দাবি তাদের। তবে বাংলাদেশ অটো মিল ওনার এ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আব্দুর রশীদের দাবি, দেশে পর্যাপ্ত খাদ্য মজুদ রয়েছে কাজেই বাজার অস্থিতিশীল হবে না। কুষ্টিয়ায় মোট ১৯টি অটো, ৫৩টি সেমি অটোসহ শুধু খাজানগর-আইলচারায় প্রায় ৮শ’ রাইস মিল গড়ে উঠেছে। অটো মিলে প্রতিদিন ৭শ’ মেট্রিক টন এবং সেমি অটো মিলে ৫০ মেট্রিক টন পর্যন্ত চাল উৎপাদন হয়।
×