ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

চিনিকলে লোকসান কেন

প্রকাশিত: ০৫:৫৫, ২১ জানুয়ারি ২০১৭

চিনিকলে লোকসান কেন

দেশীয় চিনিকলগুলো ক্রমাগত লোকসান দিতে দিতে প্রায় দেউলিয়া হওয়ার উপক্রম, অথচ অভ্যন্তরীণ বাজারে চিনির দাম বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। গত বছর রোজার ঈদের আগে থেকেই চিনির বাজারে বিরাজ করছে প্রবল অস্থিরতা। বর্তমানে অবশ্য প্রতিকেজি চিনির দাম রয়েছে স্থিতিশীল পর্যায়ে, ৭০-৭৫ টাকা। দেশীয় চিনি প্রতিকেজি ৬৫ টাকা। দেশী চিনির মিষ্টতাও বেশি। তবু স্থানীয় চিনিকলগুলো চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ করতে না পারায় ইতোমধ্যে বাজার দখল করে নিয়েছে বিদেশী চিনি। আর এর প্রায় অবাধ সুযোগ নিচ্ছে কয়েকটি ব্যবসায়ী গোষ্ঠী। এরা আন্তর্জাতিক বাজার থেকে প্রতিযোগিতামূলক দামে র-সুগার কিনে দেশে এনে পরিশোধিত করে বাজারজাত করে থাকে। আর সময় সময় বাজারে কৃত্রিম সঙ্কট তৈরি করে বাড়িয়ে থাকে চিনির দাম। গত কয়েক বছর ধরে এই ধারাই চলে আসছে। আর এদের সঙ্গে অসম প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে ক্রমাগত লোকসান গুনে গুনে প্রায় নিঃস্ব হয়ে গেছে দেশীয় চিনিকলগুলো। সরকার তথা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নীতিও কম দায়ী নয় কোন অংশে। আমলাতান্ত্রিক জটিলতা তো আছেই। আর এ কারণেই প্রধানত দর্শনার কেরু কোম্পানি বাদে অন্য চিনিকলগুলো লোকসান দিয়ে যাচ্ছে বছরের পর বছর ধরে। এক্ষেত্রে বেসরকারী খাতের সঙ্গে সরকারী খাতের অসম প্রতিযোগিতার বিষয়টিও উল্লেখের দাবি রাখে বৈকি! যেমন, অনেক মিলেই প্রতিবছর প্রচুর চিনি অবিক্রীত থাকে। অভ্যন্তরীণ বাজারে চিনির দাম যখন বাড়তে থাকে, তখন সরকার তথা বাণিজ্য মন্ত্রণালয় চিনি আমদানিকারক ও মিল মালিকদের শুল্ক রেয়াতসহ নানা সুবিধা দিয়ে থাকে। অথচ, চিনিকলগুলোতে অবিক্রীত চিনি বিক্রির উদ্যোগ প্রায় নেয়া হয় না। কখনও নিলেও তা খুব সীমিত পর্যায়ে। সত্যি বলতে কি, শুধু চিনি নয়, বরং চাল-ডাল, তেল-গুঁড়াদুধ-লবণসহ প্রায় সব ভোগ্যপণ্যেরই এই প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। দেশে বার্ষিক মোট চিনির চাহিদা ২২ লাখ টন। ১৫টি সরকারী মিলের উৎপাদন ক্ষমতা সাকল্যে ৮ লাখ টন। অবশিষ্ট ১৪ লাখ টন আমদানি করতে হয় বিদেশ থেকে। বিশাল এই ঘাটতি পূরণে দেশে আখ চাষের পরিমাণ বাড়াতে হবে। তদুপরি রসে চিনির পরিমাণ বেশি এমন উন্নতজাতের আখের আবাদ করতে হবে। তবে এক্ষেত্রে জটিলতা রয়েছে জমি অধিগ্রহণ নিয়ে, যা দৃশ্যমান হয়েছে গোবিন্দগঞ্জে সাঁওতাল অধ্যুষিত এলাকায়। চিনি একটি কৃষিজাত মৌসুমী শিল্পপণ্য। সারাবছর চিনিকলগুলো চালানো যায় না। সেক্ষেত্রে মিলগুলোকে লোকসান থেকে রক্ষা করতে হলে চিনি পাওয়ার পর উপজাত পণ্য মোলাসেস বা ঝোলাগুড় ব্যবহার করে রকমারি এ্যালকোহল উৎপাদন করা যেতে পারে। বিদেশে এর প্রচুর চাহিদা রয়েছে। এমনকি প্রতিবেশী দেশ ভারতেও। তদুপরি ইথানল একটি পরিবেশবান্ধব বায়োফুয়েল বা জৈব জ্বালানি। জ্বালানি হিসেবে এর ব্যবহার বিশ্বের অনেক দেশেই সমাদৃত এবং ব্যবহার বাধ্যতামূলক। তদুপরি আখের ছোবড়া থেকে উন্নতমানের কাগজ প্রস্তুত করা সম্ভব। আখ চাষের মৌসুম ব্যতিরেকে অন্য সময়ে পতিত জমিতে সুগার বিটচাষ করা যেতে পারে, যা থেকে চিনি আহরণ সম্ভব। মোটকথা সমন্বিত নীতি নির্ধারণসহ বহুমুখী উদ্যোগ নিলে দেশীয় চিনিকলগুলোর লোকসানে থাকার কোন কারণ থাকতে পারে না। আমদানিকারকদের কারসাজির কারণে চিনির দাম বাড়ছে। বেসরকারী মিল মালিকরা মূলত আমদানিকারক। তারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে র-সুগার এনে পরিশোধন করে বাজারজাত করে থাকে সরবরাহকারীদের মাধ্যমে। হাতেগোনা কয়েকজন মিলে গড়ে উঠেছে এই সিন্ডিকেট। মূলত এরাই চিনির বাজার নিয়ন্ত্রণ করে থাকে এবং ইচ্ছামতো উৎপাদন ও বাজারজাত করে চিনি। অন্যদিকে সরকারী মালিকানাধীন কয়েকটি চিনিকলে প্রচুর আখের চিনি অবিক্রীত থাকে প্রতিবছর। ফলে কারখানাগুলো লোকসান গুনে বছরের পর বছর ধরে। চলতি বছরের বাজেট ঘোষণার আগে পরে অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, লোকসানের অজুহাতে দেশীয় চিনিকলগুলো বন্ধ করে দেয়ার পরিকল্পনা সরকারের রয়েছে। সেটা সরকারী নীতি নির্ধারণের বিষয়। তবে স্বনির্ভরতা অর্জন করতে হলে দেশীয় চিনিকল রাখা অত্যাবশ্যক। পরিকল্পিত ও সমন্বিত উপায়ে চালাতে পারলে সরকারী হোক কী বেসরকারী, চিনিকলে লোকসান হওয়ার কথা নয়। তদুপরি অপরিশোধিত চিনির শুল্কহার বেশি হলে দেশীয় চিনিশিল্প কিছুটা সুবিধা পেতে পারে।
×