ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

মিলু শামস

ছাপাখানার ভূত!

প্রকাশিত: ০৩:৫৬, ১৮ জানুয়ারি ২০১৭

ছাপাখানার ভূত!

এতকাল ছাপাখানার ভূতের কথা শুনেছি। যত সংশোধনই হোক ছাপাখানার ভূত একটা দুটো ভুল করবেই। এবার এলো এক ভয়ঙ্কর ভূতের খবর। সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণীর দুটো পাঠ্য বইয়ের পনেরো লাখ কপি ছাপা হওয়ার পর জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)-র কর্মকর্তাদের চোখে পড়ে একটি বিশেষ ধর্মভিত্তিক সংগঠনের দাবি অনুযায়ী আগের দুটো লেখা বাদ দিয়ে নতুন লেখা যুক্ত করা হয়নি। তাৎক্ষণিকভাবে চার কোটি টাকা খরচ করে ছাপানো পনেরো লাখ বইয়ের কপি গুদামে পাঠিয়ে বাকি বই ছাপার কাজ বন্ধ করে দেন তারা। যেন দাবি অমান্য করে গর্হিত কাজ করে ফেলেছেন। এরপর ওই লেখা দুটো যুক্ত করে নতুন বই ছাপানো হয়। বাদ দেয়া লেখা দুটোর একটি উপেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরীর ‘রামায়ণ-কাহিনী (আদিকা-)’ অন্যটি শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘লালু’। প্রথমটি অষ্টম শ্রেণী এবং দ্বিতীয়টি সপ্তম শ্রেণীর ‘আনন্দ পাঠ’ বইয়ের পাঠ্য ছিল। এছাড়া পঞ্চম শ্রেণীর বাংলা বই থেকে বাদ দেয়া হয়েছে হুমায়ূন আজাদের ‘বই’ কবিতাটি। যাহোক, এত কা- ঘটেছে অথচ কেউ জানে না কার নির্দেশে হয়েছে। যাদের জানার কথা সেই জাতীয় পাঠ্যক্রম সমন্বয় কমিটি ও (এনসিসি) দাবি করেছে তারা এ বিষয়ে পুরোপুরি অজ্ঞ। অথচ নিয়মানুযায়ী তাদের অবগত করা ছাড়া পাঠ্যক্রমের কোন লেখা বাদ দেয়া বা যুক্ত করা যায় না। অবগত করতে হয় বইয়ের সম্পাদককেও। এটা বাধ্যতামূলক। পনেরো লাখ ছাপা কপি গুদামে পাঠানো হলো, নতুন করে ছাপার কাজ চলল- এতবড় কর্মযজ্ঞ অথচ কেউ জানে না কোথা থেকে কেমন করে এসব হলো। বড়সড় ভৌতিক কাজ নিঃসন্দেহে। এ ভূত যে আগামী বছর বিশেকের মধ্যে দেশকে গভীর অন্ধকারে ডুবিয়ে দেবে তাতেও সন্দেহের অবকাশ নেই। আপাতত বিস্ময়ে বিমুগ্ধ হয়ে আমরা দেখছি বাংলাদেশ নামের ‘সেক্যুলার’ রাষ্ট্রের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার পাঠ্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে ‘হেফাজতে ইসলাম’ নামের মধ্যযুগীয় একটি ধর্মীয় সংগঠনের নির্দেশে। বাঙালী শিশুর শৈশবের মনোজগত গঠনে যে নামটি যুগযুগ ধরে অনিবার্য বলে বিবেচিত হয়ে আসছে সেই উপেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরী হিন্দু বীরদের কাহিনী বলার অপরাধে পাঠ্যক্রম থেকে বাদ পড়েছেন। শরৎচন্দ্র বাদ পড়েছেন ‘পাঁঠাবলী’র নিয়ম কানুন শেখানোর অপরাধে। এ সবই ওই বিজ্ঞ সংগঠনটির মহান ফিলোসফারদের অভিমত। গত বছর আট এপ্রিল তারা এক যৌথ বিবৃতিতে বলেছিলেন, ‘ বর্তমান স্কুল পাঠ্য পুস্তকে মুসলিম ছাত্র ছাত্রীদের নাস্তিক্যবাদ ও হিন্দুতত্ত্বের পাঠ দেয়া হয়ে থাকে। তাদের পড়ানো হয় গরুকে মায়ের সম্মান দিয়ে ভক্তি করার, পাঁঠাবলীর নিয়ম কানুন, হিন্দু বীরদের কাহিনী, দেব-দেবীর নামে প্রার্থনা এবং হিন্দুদের তীর্থস্থানে ভ্রমণ করার বিষয়’। তারা হুংকার দিয়ে বলেছিলেন ‘এসব চলবে না’। ব্যস আমাদের সেক্যুলার রাষ্ট্রের শিক্ষামন্ত্রী এবং কর্মকর্তারা এতেই কুপোকাত। হেফাজতে ইসলাম ঊনত্রিশটি বিষয় পাঠ্য বইয়ে সংযোজন-বিয়োজন করতে বলেছিলেন। এর মধ্যে সাতাশটি গ্রহণ-বর্জন করলেও উপেন্দ্র কিশোর ও শরৎচন্দ্রর লেখা দুটো ‘ভুল বশত’ ছাপা হয়ে যায়। যে জন্যে নাকে খত দিয়ে দ্রুত তা সংশোধন করা হয় । হায় শিক্ষা! হায় ধর্মনিরপেক্ষতা! ইউরোপ গ্রীক ও রোমান পুরাণ নিয়ে গর্ব বোধ করতে কোন ধর্মের পরিচয় বাধা হয় দাঁড়ায় না। সাহিত্যের পাশাপাশি শিল্পের বিভিন্ন শাখায় এনিয়ে কাজ হয়েছে। লুভঁ মিউজিয়ামের একটি ইউনিট সাজানো হয়েছে গ্রীক ও রোমান পুরাণের দেবদেবীদের ভাস্কর্য দিয়ে। বার্লিনের মিউজিয়াম আইল্যান্ডের একটি মিউজিয়ামের পুরোটাই এ দেব দেবীদের ভাস্কর্যে ভরা। নানাভাবে নানা ভঙ্গিতে উপস্থাপন করছে। দেখলেই মনে হয় যেন ওরা বলছে দ্যাখো, কত সমৃদ্ধ আমাদের পুরাণ। স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা শিক্ষকের নেতৃত্বে এসব মিউজিয়াম দেখতে আসে। আর আমাদের এখানে ধর্মীয় অনুভূতির তীব্রতার কাছে হার মানে আমাদের সমৃদ্ধ পুরাণ কাহিনী। বাংলা সাহিত্যের ভিত্তি তৈরি করেছেন যেসব অমর সাহিত্যিক, তারা। তবে ইতিহাসের দিকে তাকালে মনে হয় এমন পরিণতিই নির্ধারিত ছিল। নইলে ধর্মের ভিত্তিতে ভারত দু’টুকরো হবে কেন। আর স্বাধীন বাংলাদেশে মাদ্রাসা শিক্ষাকে এত গুরুত্ব দেয়া হবে কেন। এদেশে শিক্ষামন্ত্রী হিসেবে এক সময় আমদানি হয়েছিলেন মজিদ খান। শিক্ষামন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ পেয়ে প্রথমেই তিনি ধর্মশিক্ষা ও আরবী ভাষা স্কুল পাঠ্যক্রমে বাধ্যতামূলক করার ঘোষণা দিয়েছিলেন। তারও আগে যার মন্ত্রিসভার শিক্ষামন্ত্রীর পদটি তিনি অলঙ্কৃত করেছিলেন সেই জেনারেল শাসক জিয়া ক্ষমতায় বসেই সৌদি প্রবাসী বাঙালী প-িতদের নিয়ে ইসলামী শিক্ষা সম্মেলন করেছিলেন। সেখান থেকেও সুপারিশ এসেছিল শিক্ষার সর্বস্তরে আরবী ভাষা বাধ্যতামূলক করার। জেনারেল জিয়ার হঠাৎ করে কেন এত ধর্মপ্রীতি জেগেছিল? ধর্মকর্মের জন্য তার তেমন সুখ্যাতির কথা আগে কেউ শোনেনি। তার শিক্ষামন্ত্রীর কথা শোনা গেছে আরও কম। মাধ্যমিক স্তরে পড়াশোনা করার পর তিনি দেশেই ছিলেন না। শিক্ষা ও কর্মজীবন তার কেটেছে মূলত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। সেখানে ধার্মিক হিসেবে তার সুখ্যাতির কোন রেকর্ড নেই। লাল সালুর মজিদকে যে কারণে ধার্মিক হতে হয়েছিল, তাদেরও সে জন্য ধর্মের মুখোশ পরতে হয়েছে। সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে সমাজে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলো একজোট হচ্ছেÑ এসব আলামত শুভ নয় শাসকদের জন্য। একে দমন করার মোক্ষম দাওয়াই জনগণের ধর্মীয় আবেগকে আলোড়িত করা। একবার তা করতে পারলে শাসকের বিরুদ্ধে তাদের ক্ষোভ ওই আবেগের বন্যায় ভেসে যাবে। রাজনৈতিক চেতনা ভেঙ্গে খান খান হবে। সুতরাং সামন্ত মজিদের ভূত তথাকথিত বুর্জোয়া মজিদ ও তার প্রভুদের ঘাড়ে চেপে একেবারে রাষ্ট্রপরিচালনার মূলনীতি খামচে ধরেছিল এবং বাংলাদেশের জনগণের দুর্ভাগ্য ওই চেপে বসা ভূত আর নামেনি। পরের স্বৈর ও গণতান্ত্রিক শাসকরা একে আরও নিপুণভাবে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করেছেন। বাংলাদেশকে একটি সেক্যুলার রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার অঙ্গীকারের প্রতি আস্থাশীল থেকে প্রথম থেকেই মাদ্রাসা শিক্ষা তুলে দিয়ে সবার জন্য একক সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার বদলে রাষ্ট্র পরিচালকরা মাদ্রাসা শিক্ষার প্রতি সব সময় জোর দিয়ে এসেছেন। ধর্মীয় শিক্ষার জন্য মাদ্রাসার প্রয়োজন হয় না। সেজন্য স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে আলাদা বিভাগ খোলাই যথেষ্ট। কিন্তু উদ্দেশ্য যেখানে অসৎ সেখানে ছলের অভাব হয় না। শামসুল হক শিক্ষা কমিশন মাদ্রাসা শিক্ষাকে জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থার অবিচ্ছেদ্য অংশ ঘোষণা করে বলেছিল, ‘মাদ্রাসা শিক্ষার মূল লক্ষ্য হলো শিক্ষার্থীর দৈহিক, মানসিক, সামাজিক, আধ্যাত্মিক, নৈতিক ও মানবিক বিষয়ে সর্বাঙ্গীণ বিকাশ ও উন্নয়ন সাধন করা। শিক্ষার্থীর মনে সর্বশক্তিমান আল্লাহতায়ালা ও তাঁর রাসুল (সা) এর প্রতি অটল বিশ্বাস গড়ে তোলা, যেন এই বিশ্বাস তার সমগ্র চিন্তা ও কর্মে অনুপ্রেরণার উৎস হিসেবে কাজ করে’...‘মাদ্রাসা শিক্ষার উদ্দেশ্য হলো ইসলামের যথার্থ সেবক ও রক্ষকরূপে শিক্ষার্থীদের তৈরি করা। তাদের এমনভাবে তৈরি করতে হবে যেন তারা ইসলামের আদর্শ ও মূলনীতিকে ভাল করে জানে, সে অনুসারে সুদৃঢ় নির্ভরযোগ্য চরিত্রের অধিকারী হয় এবং জীবনের সর্বক্ষেত্রে সেই আদর্শ ও মূলনীতির প্রতিফলন ও তার উন্নয়ন বিধানে উদ্যোগী হয়।’ বলার অপেক্ষা রাখে না এই ‘নির্ভরযোগ্য ও সুদৃঢ় চরিত্রের অধিকারী হওয়ার জন্য শিক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান বা সদস্যদের কোন সন্তান মাদ্রাসায় শিক্ষা নেয়নি। সমাজের ওপরতলার ধনবান মানুষদের সন্তানরাও চরিত্র গঠন বা ‘ইসলামের রক্ষক’ হওয়ার জন্য মাদ্রাসায় শিক্ষা নেয় না। মাদ্রাসা শিক্ষাকে এক সময় মহীয়ান করা হয়েছে। এখন মাদ্রাসার প্রয়োজন নেই। সাধারণ শিক্ষাই মাদ্রাসার উদ্দেশ্য পূরণ করতে পারবে। এ শিক্ষা আসলে নিচুতলার মানুষদের সন্তানদের জন্য। জনগণের এক বড় অংশের ধর্মীয় পশ্চাৎপদতাকে ব্যবহার করে এ বৈষম্য সৃষ্টি করা হয়েছে এবং প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দল নিজেদের স্বার্থে এদের ব্যবহার করেছে। এই পাল্টাপাল্টি ব্যবহারে আগাছার মতো বেড়েছে মাদ্রাসা ও মাদ্রাসার ছাত্রসংখ্যা। এখন এর সংখ্যা দেখে আমাদের চোখ কপালে উঠলেও এ বাস্তবতা এদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিরই সৃষ্টিÑ এ আত্মসমালোচনা প্রত্যেক রাজনৈতিক দলকেই করতে হবে। শিক্ষা সমাজ বিচ্ছিন্ন কিছু নয়। সমাজের লক্ষ্যের সঙ্গে এর লক্ষ্য জড়িত। সামন্তবাদী সমাজে শিক্ষার যে প্রয়োজন, পুঁজিবাদী সমাজের প্রয়োজন তা থেকে আলাদা। সামন্ততান্ত্রিক সমাজের চাহিদা মেনে এক সময় অক্সফোর্ড ও কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্ম হয়েছিল ধর্মচর্চার কেন্দ্র হিসেবে। কিন্তু যখনই সমাজে বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষার চাহিদা সৃষ্টি হয়েছে, সমাজ বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে সেক্যুলার মননচর্চার পরিসর তৈরি হয়েছে, ওই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ধর্মচর্চার কেন্দ্র হিসেবে নিজেদের পরিচয় ঘুচিয়ে সেক্যুলার মননচর্চার কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। আজকের দিনে কারও পক্ষে কি কল্পনা করা সম্ভব অক্সফোর্ড, কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্ম হয়েছিল নির্ভেজাল ধর্মচর্চার জন্য? অথচ এ দেশের কওমী মাদ্রাসাগুলো সামন্ততান্ত্রিক সমাজে যেমন ছিল আজও তেমনই আছে এবং সাধারণ শিক্ষাও ক্রমশ সেদিকে যাচ্ছে।
×