ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

মীম নোশিন নাওয়াল খান

মাছের ডাঙা দেখা

প্রকাশিত: ০৬:০৪, ১৪ জানুয়ারি ২০১৭

মাছের ডাঙা দেখা

কই মাছটার সঙ্গে প্রতিদিন তার বাবা-মায়ের ঝগড়া লেগে যাচ্ছে। বাবা-মা তার কোন কথা শুনতে চায় না। অথচ তাকে তার বাবা-মায়ের সব কথা শুনতে হয়। কেন? কই মাছের খুব রাগ হয়। কই মাছের খুব ইচ্ছে সে ডাঙায় যাবে। প্রতিদিন পানির উপরের দিকে সাঁতার কাটার সময় সে ডাঙা দেখতে পায়। ডাঙা কী সুন্দর! সেখানে সবুজ সবুজ ঘাস আছে, রঙিন ফুল আছে, প্রজাপতি আছে। ডাঙায় সে গরু চরতে দেখে, ভেড়ার ছানাকে দৌড়ে বেড়াতে দেখে। কতগুলো মানুষের শিশুও খেলাধুলা করে। ওদের না জানি কত্ত মজা! এইজন্য কই মাছ প্রতিদিন তার বাবা-মাকে বলে, তাকে যেন ডাঙায় নিয়ে যাওয়া হয়। অথচ বাবা-মা তার কথা শুনতেই চায় না। উল্টো তাকে বকা দিয়ে বলে, ডাঙায় নাকি মাছ থাকতে পারে না। সেখানে খুব কষ্ট। সেখানে গেলে মাছেরা মরে যায়। বাবা-মা নিশ্চয়ই তাকে ভুলভাল বোঝায়। সে দেখেছে, প্রতিদিন ডাঙা থেকে মানুষেরা জাল ফেলে মাছদের ডাঙায় নিয়ে যায়। যেই মাছেরা ডাঙায় যায়, তারা আর কখনও পানিতে ফিরে আসে না। নিশ্চয়ই ডাঙার জীবনটা অনেক সুন্দর। সেখানে অনেক আনন্দ। এজন্য কেউ সেখানে গেলে আর পানিতে ফিরে আসতে চায় না। কই মাছেরও তাই খুব শখ, সে ডাঙায় যাবে। সকালে কই মাছ বাবা-মা আর বন্ধুদের সঙ্গে সাঁতার কাটতে বেরিয়েছিল। খেলতে খেলতে সবার কাছ থেকে একটু দূরে চলে এলো সে। এমন সময় হঠাৎ তার উপরে কী যেন একটা এসে জড়িয়ে গেল। কই মাছ মাথা তুলে দেখল, একটা জাল! কই মাছের খুব আনন্দ হলো। সে জালে উঠেছে! এখন সে ডাঙায় যেতে পারবে। আনন্দে তার নাচতে ইচ্ছে হলো। কিন্তু নাচতে গিয়ে সে দেখল, জালটা তার গায়ে জড়িয়ে গেছে। সে লাফাতে পারছে না, নাচতেও পারছে না। সে যতই লাফানোর চেষ্টা করল, জালটা তার গায়ে ততই জড়িয়ে যেতে লাগল। তার খুব কষ্ট হতে লাগল। কই মাছকে তার বাবা-মা কখনও জালের কাছে যেতে দেয়নি। কিন্তু দূর থেকে সে দেখেছে, জালে ওঠার পর মাছরা সবাই লাফালাফি করে। এত যদি কষ্ট হবে, তাহলে ওরা লাফায় কেন? কই মাছের মনে হলো, নিশ্চয়ই সে বাচ্চা বলে তার কষ্ট হচ্ছে। কই মাছের আশপাশে আরও অনেক মাছ জালে উঠেছে। তারা চিৎকার করছে, লাফালাফি করছে। কই মাছ বুঝতে পারল না ওরা কেন চেঁচাচ্ছে। ডাঙায় যেতে পারা তো খুব আনন্দের কথা। এখানে চিৎকারের কী হলো? আচ্ছা, কষ্ট হচ্ছে বলে কী ওরা চেঁচাচ্ছে? আরে! ডাঙায় যেতে হলে এইটুকু কষ্ট তো মেনে নিতেই হবে! তাই কষ্টটুকুও সহ্য করে নিল সে। একটু পরে কই মাছের মনে হলো তাকে কে যেন টানাটানি করছে। তারপর সে খেয়াল করল, জালটা ধীরে ধীরে উপরে উঠছে। তার মানে ওরা তাকে ডাঙায় নিয়ে যাচ্ছে? কই মাছের খুব আনন্দ হলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই জালের ভেতরে বসে কই মাছ পানির উপরে উঠে এলো। এক মুহূর্তের জন্য বিস্ময় নিয়ে সে তাকিয়ে চারপাশটা দেখল। পানির উপরের পৃথিবী এত সুন্দর! তারপর হঠাৎ তার কেমন যেন শ্বাসকষ্ট শুরু হলো। সে ভাবল, হয়তো সে এই প্রথম পানির বাইরে এসেছে বলে তার কষ্ট হচ্ছে। একটু পরে ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু শ্বাসকষ্টটা ধীরে ধীরে বাড়তেই লাগল। প্রচণ্ড যন্ত্রণায় কই মাছ ছটফট করতে লাগল। এমন সময় একটা বাচ্চা মেয়ে এসে জাল থেকে তাকে ছাড়িয়ে নিল। কই মাছ তখন পানির জন্য ছটফট করছে। তার খুব কষ্ট হচ্ছে। বাচ্চা মেয়েটা একটা পানিভর্তি পাত্রে কই মাছকে রাখল। অনেকক্ষণ পর কই মাছ শান্তিতে নিশ্বাস নিল। এতক্ষণ তার মনে হচ্ছিল সে বুঝি মরেই যাবে। এবার সে ভাবল, হয়তো মানুষেরা মাছদের এনে এমন সুন্দর করে পানির মধ্যেই রাখে। আর এই পানিতে মনে হয় খুব আনন্দ, খুব মজা। এখান থেকে গাছ দেখা যায়, আকাশ দেখা যায়, কী সুন্দর সবকিছু! কই মাছকে একাই মেয়েটা পাত্রে রেখে গিয়েছে। একটু পর কই মাছ শুনতে পেল মেয়েটা বলছে, বাবা, এই মাছটা আমি রেখে দেব। এটাকে আমি পুষব। মেয়েটার বাবা হো হো করে হেসে উঠল। তারপর বলল, ধুর বোকা! কই মাছ কেউ পোষে নাকি? কই মাছ খেতে যা মজা! আর এটা তো বাচ্চা কই। ভাজলে দারুণ লাগবে। খেয়ে যা মজা পাবি! তোর মাকে বলব, এটা ভেজে তোকে দিতে। কই মাছের বুকটা ধ্বক করে উঠল। এগুলো কী বলছে ওরা? ওরা তাকে খেয়ে ফেলবে? কই মাছের কান্না পেয়ে গেল। সে চিৎকার করে বলল, আমাকে এখান থেকে ছেড়ে দাও। আমি বাবা-মায়ের কাছে যাব। কেউ তার কথা শুনল না। কই মাছ কাঁদতে শুরু করল। সে বুঝতে পারল, ডাঙা আসলে কোন ভাল জায়গা না। এখানে মাছরা মোটেও আনন্দে থাকে না। বাবা-মা ঠিকই বলেছিল। বাবা-মায়ের জন্য তার বুক ফেটে কান্না আসতে চাইল। কিন্তু এখন আর তার কিছুই করার নেই। ওরা তাকে খেয়ে ফেলবে। কই মাছ যখন কাঁদছে, সেই সময় বাচ্চা মেয়েটা আবার তার কাছে এলো। বড় বড় চোখে পানির ভেতরে থাকা কই মাছের দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি কী সুন্দর দেখতে, মাছ! আর তুমি তো বাচ্চা। তোমাকে আমি খেয়ে ফেলব? নাহ! আমার খুব কষ্ট হবে। তুমি চলে যাও মাছ, তুমি পানিতেই চলে যাও। তোমার বাবা-মায়ের কাছে চলে যাও, তোমার পরিবারের কাছে চলে যাও। মেয়ে পাত্রটা হাতে তুলে নিল। তারপর আস্তে করে নদীর পানিতে পাত্রটা উপুড় করে কই মাছকে ছেড়ে দিল। কই মাছ আর পিছু ফিরে তাকাল না। সে দ্রুত সাঁতার কেটে বাড়ির পথ ধরল। কতক্ষণ বাবা-মাকে দেখেনি সে! ভিকারুননিসা নুন স্কুল এ্যান্ড কলেজ ১০ম শ্রেণী (ইংরেজী ভার্সন) অলঙ্করণ : আইয়ুব আল আমিন
×