ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

নুরুল করিম নাসিম

নীল দূতাবাস (২) ॥ জার্নাল

প্রকাশিত: ০৬:২৩, ৬ জানুয়ারি ২০১৭

নীল দূতাবাস (২) ॥ জার্নাল

অনেক খোঁজাখুঁজির পর পুরানা পল্টনের ফুটপাথের পুরনো বইয়ের দোকানে চিত্রাদেবের ‘ঠাকুর বাড়ির অন্দর মহল’ এবং আরও দু’তিনটি প্রাসঙ্গিক বই পেয়ে গেলাম। অই যে একটা গান আছে না.. ‘চাঁদ দেখতে এসে আমি তোমায় দেখে ফেলেছি’, সেই রকম আর কি! রবীন্দ্রনাথের আত্মীয়-স্বজনের ওপর লেখা একটা দুলর্ভ বই, রবীন্দ্রনাথের জীবনে নারী বিষয়ে একটি বইও পেয়ে গেলাম। মিখায়ূভ আমার ভেতর রবীন্দ্র বিষয়ক আগ্রহ উশকে দিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথের গল্প, উপন্যাস-কবিতা অপার আগ্রহ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে পড়েছি, যদিও বাংলা সাহিত্য আমার বিষয় ছিল না। ইংরেজী সাহিত্যের বিনম্র নিবেদিতপ্রাণ ছাত্র হিসেবে পাঠ্যসূচীতে বাইরে অনেক ইউরোপিয়ান কবি আমার প্রিয়কবিদের তালিকায় সগর্বে জায়গা করে নিয়েছিলেন। যেমন অডেন, বারিস পাস্তারনাক, টেড হিউজেস, সিনভিয়া প্লাথ, ফরাসী কবি মালার্মে, জার্মান ওপন্যাসিক গুন্টারগ্রাস। পুরনো বইটি আমার সংগ্রহে রেখে বইয়ের র‌্যাক থেকে নতুন বইটি টেনে নিয়ে ব্যাগে ভরলাম। টেলিফোনে মিখায়ূভকে প্রথমবারেই পাওয়া গেল। তিনি গুলশানে যেতে আমন্ত্রণ জানালেন সেই তপ্ত ভরদুপুরে। কী এক আবেগে, রবীন্দ্রনাথকে ভালবেসে হয়তো বা, মিখায়ুভকে বইটি দেয়ার জন্য ছুটলাম গুলশানে। ভরদুপুরে কখনো কখনো খুব একটা ভিড় থাকে না। সেদিনও ছিল না। মিখায়ূভ অপেক্ষা করছিলেন। দূতাবাসে তার অপরিসর ঘরে বসে কথা হচ্ছিল। তিনি, কিছুক্ষণ পর একটা চমৎকার প্রস্তাব দিলেন। আমি যদি রাজি থাকি তাহলে দূতাবাসের ফার্স্ট সেক্রেটারির ইংরেজীতে লেখা চিঠিপত্রগুলো শুদ্ধ করে দিতে হবে, গ্রামার ঠিকঠাক করতে হবে। বিনিময়ে আমাকে ভালো সম্মানী (পারিশ্রমিক) দেয়া হবে। রুশ ফার্স্ট সেক্রেটারি ভদ্রলোকের সঙ্গে পরিচয় হলো। বেশ সুদর্শন। মাঝারি মাপের। মাথাভর্তি কালো চুল। ইংরেজী বলতে পারেন। তার স্ত্রীর সঙ্গে, এক ছেলে সন্তানের সঙ্গেও পরিচয় হলো। স্ত্রী এক অক্ষর ইংরেজীও বলতে পারেন না। তার কূটনীতিক স্বামী অনুবাদ করে দেন আমার কথাগুলো, তিনি ওভাবে কথা বলেন আমার সঙ্গে। চোখের ভাষায়, বডি ল্যাংগোয়েজে, হাত নেড়েচেড়ে। আমার বেশ মজা লাগে। বিস্মিত হই। ভাষার দেয়াল কত বিরাট প্রতিবন্ধকতা। মানুষটি দেখতে পাচ্ছি, অনুভব করছি, কণ্ঠ থেকে উৎসারিত শব্দ দিয়ে পৌঁছাতে পারছি না। এর চেয়ে বিষাদময় বিড়ম্বনা কী আছে এই পৃথিবীতে, এই জীবনে? ‘ঠাকুরবাড়ীর অন্দর মহলে’ বইটি পেয়ে মিখায়ুভ ভীষণ খুশী। আমি আনন্দিত রবীন্দ্রনাথের ওপর লেখা অন্য দুটো বই হাতে পেয়ে। সপ্তাহে দু’দিন দু’একঘণ্টা, আমার সুযোগ আর সুবিধামতো, যেতে হবে গুলশানে ফার্র্স্ট সেক্রেটারির ইংরেজীতে লেখা চিঠিপত্র শুদ্ধ করে লিখে দিতে। এসব কাজ আমি লিবিয়ার রাজধানী ত্রিপলীতে অধ্যাপনা জীবনেও করেছি। অফুরন্ত অবসর ছিল সেখানে তখন। সেখানে বাংলাদেশ দূতাবাসের ফার্র্স্ট সেক্রেটারি, নাম নাইবা বললাম, প্রতি সপ্তাহে বাইব্যাগের মাধ্যমে ঢাকা অফিসে পাঠানো রিপোর্ট ইংরেজীতে সম্পাদনা ও পুনর্লিখন করে দিতে হতো আমাকে। এসব আশি দশকের কথা। বুড়িগঙ্গা থেকে ইতোমধ্যে কত পানি গড়িয়ে গেছে। আমার জীবন এবং রাষ্ট্রের জীবনের এক জায়গায় থির হয়ে থাকেনি। কত ঘটনা ঘটে গেছে দেশের রাজনীতিতে। আশি থেকে দু’হাজার ষোলো Ñদীর্ঘ ৩০ বছরে কত পালাবদল, কত ঘটনা। সেসব আখ্যান লেখার জায়গা এটা নয়। আমার শুধু মনে পড়ে মিখায়ূভের কথা, সেই রুশ ফার্স্ট সেক্রেটারি, নাম নাইবা লিখলাম, তার লাবণ্যময়ী স্ত্রী, তার তের বছরের চঞ্চল ছেলেটি, এদের কথা খুব মনে পড়ে। আমি তাদের পারিবারিক বন্ধু হয়ে উঠেছিলাম। আজ কে কোথায় জানি না। আমি চাকরিসূত্রে ঢাকা ছেড়ে চলে গেলাম অন্যদেশে। ই-মেইল তখনও এতটা ব্যাপক ব্যবহৃত হতো না, আশি দশকে সেলফোনও ছিল না। কোনো কোনো অবসর মুহূর্তে, কোনো কোনো পূর্ণিমা রাতে, কোনো কোনো বর্ষণমুখর লং ড্রাইভে এসব হারিয়ে যাওয়া মানুষের মুখ মনের পর্দায় হঠাৎ হঠাৎ ভেসে ওঠে। তখন আমার অজান্তে মন উদাস হয়ে যায়।
×