ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

মোঃ সাখাওয়াত হোসেন

নারী নির্যাতনের বৈশ্বিক চিত্র

প্রকাশিত: ০৬:১৮, ৬ জানুয়ারি ২০১৭

নারী নির্যাতনের বৈশ্বিক চিত্র

নারীর ক্ষমতায়নের বিষয়টি বিশ্ব নেতৃবৃন্দ যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিয়েছেন। তৃতীয় বিশ্বের নারীদের জীবনমান উন্নয়নের জন্য পদক্ষেপ গ্রহণে সহায়তার পাশাপাশি পলিসি প্রণয়নে ভূমিকা রেখে চলেছেন। সম্প্রতি আমাদের প্রধানমন্ত্রী নারীর ক্ষমতায়নে বিশেষ ভূমিকা রাখায় প্ল্যানেট ৫০-৫০ চ্যাম্পিয়ন, এজেন্ট অব চেঞ্জ এ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ। কিন্তু আমরা যদি সমগ্র বিশ্বের পরিসংখ্যান চিন্তা করি তাহলে দেখা যাবে, উন্নত রাষ্ট্রগুলোই নারী নির্যাতনকে চর্চা করছে প্রতিনিয়ত। যেখানে কথার স্ফুরণ বেরিয়ে আসে নারী নির্যাতনের বিপক্ষে সেখানে তারাই বা উন্নত রাষ্ট্রগুলো এহেন গর্হিত কর্মের সঙ্গে লিপ্ত হয়ে ইস্যুটাকে আরও ঘোলাটে করে তুলেছে। দক্ষিণ আফ্রিকায় শতকরা ৪০ ভাগ নারী ধর্ষণের শিকার হয়ে থাকে এবং সেখানে প্রতিবছর ৫ লাখ নারী ধর্ষণের শিকার হয় এবং নারী নির্যাতনের মাত্রায় দক্ষিণ আফ্রিকা শীর্ষস্থানে অবস্থান করছে। বিশ্বের অন্যতম সভ্য ও সুন্দর দেশ হিসেবে পরিচিত সুইডেন নারী নির্যাতনের ক্রমে ২য় অবস্থানে রয়েছে। অবাক করার মতো পরিসংখ্যান, প্রতি ৪ জন নারীর মধ্যে অন্তত ১ জন নির্যাতনের শিকার হয়ে থাকে। ধর্ষণ, শারীরিক নির্যাতন, মানসিক নির্যাতন, আর্থিক নির্যাতনসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে প্রতি ১ লাখের মধ্যে ৫৩ হাজার ২০০ জন নারী ক্ষতিগ্রস্ততার মুখোমুখি হয়। নারী নির্যাতনের ক্রমে যুক্তরাষ্ট্র তৃতীয় পর্যায়ে অবস্থান করছে। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যানে জানা যায়, প্রতি ৩ জন নারীর মাঝে ১ জন নারী নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। ব্যতিক্রম হিসেবে জানা যায়, শতকরা ২ ভাগ পুরুষও সেখানে বলাৎকারের শিকার হচ্ছেন। শতকরা ১৯ দশমিক ৩০ ভাগ নারী বিভিন্নভাবে নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন আমেরিকাতে। প্রতিবছর ইংল্যান্ড এবং ওয়েলসে ৭৩ হাজার নারী ধর্ষণের শিকার হয়। লোকচক্ষুর আড়ালে থেকে অনেক ঘটনাই থেকে যায় যা সংবাদ মাধ্যমে আসে না। হিসাব অনুয়ায়ী দেখা যায়, ১ দিনে ধর্ষণের শিকার হয় প্রায় ২৩০ জন। ভারতীয় সমাজ ব্যবস্থা নানা রকমের পৌরাণিক সংস্কৃতি ও সভ্যতার পরিচায়ক। এ সমাজে বিভিন্ন পর্যায়ে কুসংস্কার দেখা যায়। তা ছাড়া গরিব এবং দলিত পরিবারের মেয়ে এবং নারীরা তাদের আশ্রয়কৃত প্রভুদের দ্বারা নির্যাতনের শিকার হচ্ছে প্রতিনিয়ত। পাশাপাশি অঞ্চলভিত্তিক প্রথার কারণেও নারীরা ধৃত হচ্ছেন, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের রহিতকরণ সতীদাহ প্রথা এখনো ভারতের বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে বিদ্যমান রয়েছে যা নারী নির্যাতনের একটি কৌশল। আঁতকে ওঠার মতোই তথ্য, পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে প্রতি ২০ মিনিটে একজন নারী ধর্ষণের শিকার হয়, আবার লোকলজ্জার ভয়ে অনেকেই থানায় মামলা রুজু করতে চায় না কিংবা সংবাদ মাধ্যমের গোচরীভূত না হওয়ার কারণে জাতীয় পরিসংখ্যানে আসে না ধর্ষণের প্রকৃত তথ্য। ১৪ বছরের কম বয়সের মেয়েরা প্রতি ১০ জনে ১ জন ধর্ষণের শিকার হয় ভারতে। র‌্যাপ গ্যাংয়ের কয়েকটি উদাহরণ দেখা যায় নিউজিল্যান্ডে ২০১৩ সালের দিকে। মোট নারীর শতকরা ১৬.৪০ ভাগ ধর্ষণ, নির্যাতন ও বিভিন্ন রকমের অপমানের শিকার হয়। নারী নির্যাতনের ক্রমিক মাত্রায় কানাডা ৫ম স্থানে অবস্থান করেছে। কানাডাতে প্রতিবছর ৪ লাখ ৬০ হাজার নারী ধর্ষণ ও বিভিন্ন নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। কানাডায় প্রতি ৪ জনে ১ জন নারী জীবনের কোন না কোন সময় যে কোন ভাবেই হোক পুরুষ কর্তৃক ধৃত হচ্ছেন। পাশাপাশি কানাডায় শতকরা ৬৭ ভাগ নির্যাতনের রিপোর্ট পুলিশের কাছে রুজু হয় না। সুতরাং ভয়াবহতার মাত্রা কতটা বিরূপ পর্যায়ে চলে এসেছে যেখানে ভয়ের সংস্কৃতি কাজ করছে ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে। ২০১২ সালের এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, অস্ট্রেলিয়াতে ৫১ হাজার ২০০ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছে, যাদের বয়স ১৮ এর নিচে। সরকারী দফতরের প্রতিবেদনে জানা যায়, প্রতি ৬ জন নারীর মধ্যে ১ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয় অস্ট্রেলিয়ায়। দক্ষিণ আফ্রিকার দেশ জিম্বাবুইয়ে নারী নির্যাতনের ক্রমে নবম স্থানে অবস্থান করেছে। প্রতি ৯০ মিনিটে ১ জন নারী ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। পরিসংখ্যান ব্যুরো থেকে জানা যায়, প্রতিদিন ৫০০ এর মতো নারী অপমান ও নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন জিম্বাবুইয়েতে। ইউরোপে প্রতি ৩ জন নারীর মধ্যে ১ জন শারীরিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। ফিনল্যান্ডের শতকরা ৪৭ ভাগ, ডেনমার্কে শতকরা ৫২ ভাগ নারী নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। এসব পরিসংখ্যানিক চিত্র উন্নয়নশীল ও তৃতীয় বিশ্বের রাষ্ট্রের জন্য খুবই মারাত্মক আকার ধারণ করবে যদি না অচিরেই এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া সম্ভবপর না হয়। উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে অনুমান করা যায়, বিচারহীনতার সংস্কৃতি এবং আইনের শাসনের অভাবের কারণে এ রকম নির্যাতনের মাত্রা ও তীব্রতা দিনকে দিন বেড়েই চলছে। বিশ্বব্যাপী মুখরোচক বুলি না দিয়ে শাসকবৃন্দের নিজের দেশের অপরাধ, অপরাধের ধরন, আইন, বিচার ব্যবস্থা, শাস্তি, শাস্তির নিশ্চয়তাকরণ, সামাজিক মানুষ হিসেবে অপরাধীদের সমাজে পুনর্প্রতিষ্ঠা করা ইত্যাদি বিষয়ের ওপর নজর দেয়া উচিত।
×