ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

আবুল মাল আবদুল মুহিত

সুদীর্ঘ ষাট বছরের বিচিত্র কর্মজীবন

প্রকাশিত: ০৪:২০, ২৩ ডিসেম্বর ২০১৬

সুদীর্ঘ ষাট বছরের বিচিত্র কর্মজীবন

কর্মজীবনের প্রথম অধ্যায় : দ্বিতীয় খণ্ড সপ্তম অধ্যায় পশ্চিম পাকিস্তানে পাঁচ বছরের প্রথম পর্ব- ১৯৬৪ থেকে ১৯৬৮ (বুধবারের পর) নবেম্বর ১৯৬৪ সালে আমার পদায়ন হয় পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারে করাচীতে এবং সেখানে প্রায় ২০ মাস অবস্থানের পর আমি রাওয়ালপিন্ডিতে চলে যাই। প্রায় পাঁচ বছর করাচী ও পিন্ডিতে চাকরি করার পর ১৯৬৯ সালের জুলাই মাসে আমি ওয়াশিংটনে পাকিস্তান দূতাবাসে অর্থনৈতিক কাউন্সিলর হিসেবে পদায়িত হই। ১৯৬৪-এর নবেম্বর মাস থেকে ১৯৬৬-এর জুলাই পর্যন্ত আমি করাচীতে পদায়িত ছিলাম। প্রথমেই যে বিষয়টি আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করল সেটা হলো, পশ্চিম পাকিস্তানে শুধু কেন্দ্রীয় সরকারে নয় প্রাদেশিক সরকারেও কাজকর্ম অনেক সুসংগঠিত ছিল। সচিবালয়ে সহায়ক যেসব কর্মচারী কাজ করতেন তারা অনেক বেশি দক্ষ ছিলেন এবং নিয়মানুবর্তিতা অনেক বেশি প্রতিপালিত হতো। সেখানকার নথিপত্র অনেক ভালভাবে সংরক্ষিত হতো এবং অনেক সময়ই এসব কর্মচারীরা দিল্লী সচিবালয়ের দক্ষতা নিয়ে বড়াই করত। তারা বলেন, দিল্লীতে মুসলমান উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা খুব কম ছিলেন। কিন্তু যারা সেখানে পদস্থ হতেন তাদের সকলের যোগ্যতা ছিল অত্যন্ত উচ্চমানের এবং দিল্লীর কেরানিকুলে যেসব মুসলমানরা নিযুক্ত ছিলেন তারাও তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি দক্ষ ও কার্যক্ষম ছিলেন। আমার মনে হলো, তাদের এই গর্ববোধ বাস্তবেই যথাযথ। আমার কার্য উপলক্ষে প্রায় প্রতি ৩ মাসে আমাকে অন্তত একবার লাহোর এবং প্রায় দু’বার ঢাকায় নিয়মিতভাবে যেতে হতো। ঢাকা এবং লাহোর সচিবালয়ের মধ্যে তফাৎটি খুব লক্ষ্য করার বিষয় ছিল। ঢাকায় অনেক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা অনেক সুদক্ষ এবং উদ্ভাবনশীল ছিলেন। কিন্তু দফতর পরিচালনায় সেটা ততটা প্রতিফলিত হতো না। অন্যদিকে পশ্চিম পাকিস্তানে দফতর পরিচালনাটা এতই ভাল ছিল যে, একান্তই আসলে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা বেশ ভালভাবেই তার কাজ সমাধা করতে পারতেন। নথিপত্র সংরক্ষণের কাজটাও অনেক বেশি উন্নত এবং নিয়মানুবর্তী ছিল। এই পাঁচটি বছরই ছিল অর্থনৈতিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তান সরকারের দৃঢ় অবস্থান এবং সমনাধিকার নিশ্চিত করার জন্য বিভিন্ন উদ্যোগের সময়। এই রাজনৈতিক দাবির কারণে কেন্দ্রীয় সরকারের বাঙালী কর্মচারীদের বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ নেয়ার অনেক সুযোগ হয়। আমি যখন পরিকল্পনা কমিশনের প্রোগ্রামিং বিভাগে কাজ করতে শুরু করলাম তখনই আমার সুযোগ হলো যে, আমি বৈষম্যের অজুহাত দিয়ে উন্নয়ন বাজেটের চরিত্রটি বদলাতে শুরু করলাম। আমার মনে পড়ে, আমি প্রথম বছরের ’৬৫-৬৬ সালের যে উন্নয়ন বাজেটের বরাদ্দ ঠিক করলাম সেটা ছিল পূর্ব পাকিস্তানের জন্য ২৩০ কোটি, পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য ১৯০ কোটি এবং কেন্দ্রীয় সরকারের জন্য ৮০ কোটি রুপি। এতে কেন্দ্রীয় সরকার এবং পশ্চিম পাকিস্তান সরকার খুবই প্রতিবাদ করতে থাকলেন যে, এত আকস্মিকভাবে তাদের বরাদ্দ খুব কমে গেল। একইসঙ্গে পরিকল্পনা কমিশনের বিভিন্ন খাতের প্রধানরা হৈচৈ শুরু করলেন। সেখানে অবশ্য আমি দু’জন পশ্চিম পাকিস্তানী সহকর্মীর শক্ত সমর্থন পেলাম। বরাদ্দের বিষয়ে পরিকল্পনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান সাঈদ হাসান একটি কমিটি নিযুক্ত করেন। যেখানে আমার বোধ হয় ৭ জন সদস্য ছিলাম এবং তার আহ্বায়ক ছিলেন সহকর্মী পাকিস্তানের বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ ড. মাহবুবুল হক। এই কমিটিতে আমার বরাদ্দ দু’জন অবাঙালী সদস্য খুব জোরেশোরে সমর্থন করলেন। তারা ছিলেন মাহবুবুল হক এবং সাঈদ আহমদ নামে একজন সিএসপি কর্মকর্তা। তারা আমার যুক্তিকেই গ্রহণযোগ্য মনে করলেন। আমার যুক্তি ছিল, প্রথম থেকেই যদি আমরা বৈষম্য হ্রাসের লক্ষ্যে পূর্ব পাকিস্তানের পক্ষে ইতিবাচক পদক্ষেপ না নিই তাহলে বৈষম্য দূরীকরণ সম্ভব হবে না। আমার নিজের হিসেবে সেই সময় কেন্দ্রীয় সরকারের উন্নয়ন বাজেটের এক-চতুর্থাংশের বেশি বাংলাদেশে ব্যয় হতো না। যদিও হিসাব ও কাগজে-কলমে ছিল এক-তৃতীয়াংশ। সেজন্য আমার মনে হলো, আমার নির্দিষ্ট বরাদ্দগুলো তখনও দুই অঞ্চলের মধ্যে বরাদ্দের সমতা সৃষ্টি করতে সমর্থ হবে না। যাই হোক, অবশেষে আমার নির্দিষ্ট বরাদ্দই গৃহীত হলো। এবং প্রথমবারের মতো দুই অঞ্চলের বরাদ্দের মধ্যে প্রায় সমতা প্রতিষ্ঠিত হলো। কিন্তু সেখানেও এই সমতাটি ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। কারণ, এই বরাদ্দ আবার দুই ভাগে প্রদান করা হতো। কিছু কিছু ছিল অনুদান এবং কিছু কিছু ছিল কেন্দ্রীয় সরকার থেকে প্রদেশে ঋণ। পূর্ব পাকিস্তানের ভাগ্যে ঋণের বোঝাটা তখনও ছিল অনেক বেশি। আমি পরিকল্পনা কমিশনে থাকতে দুটি অর্থবছরের বাজেট চূড়ান্তকরণে অংশ নিই। আমার মনে হয় আমার দ্বিতীয় বছরেই কেন্দ্রীয় সরকার ও প্রাদেশিক সরকারের বরাদ্দ বিবেচনা করলে দেশে দুই অঞ্চলের জন্য বরাদ্দে শুধু সমতা সৃষ্টিই হয়নি বরং পূর্ব পাকিস্তানে বরাদ্দটি একটু বেড়ে যায়। দুই অঞ্চলের মধ্যে বৈষম্য নিরসনের জন্য অবশ্যি পশ্চিম পাকিস্তান এবং কেন্দ্রীয় সরকারের বরাদ্দকে আরও ব্যাপকভাবে সংকোচনের প্রয়োজন ছিল। কেন্দ্রীয় সরকারের বৈষম্য নীতি অবশ্য আরও নানাভাবে প্রতিফলিত হতো। যেমন- পূর্ব পাকিস্তানকে পশ্চিম পাকিস্তানের অনেক পণ্য চড়া দামে খরিদ করতে হতো। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, সিমেন্ট পূর্ব পাকিস্তানে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো এমনকি পোল্যান্ড থেকেও আমদানি করতে যত খরচ হতো সেটা পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সিমেন্ট আমদানি খরচের তুলনায় অনেক কম ছিল। অন্যদিকে কিন্তু পূর্ব পাকিস্তান থেকে যেসব পণ্য পশ্চিম পাকিস্তানে যেত সেগুলো সারাদেশে একদাম বহাল রাখার জন্য পূর্বাঞ্চল অনেক কম দাম পেত; যথা: কাগজ এবং নিউজপ্রিন্ট। আমার মনে হয় সেই পণ্য বিদেশে বিক্রি করলে পূর্ব পাকিস্তান আরও বেশি দাম পেত। আমি মন্ত্রিসভা সচিবালয়ে থাকতে পশ্চিমের সিমেন্টের জন্য পূর্বে যে বেশি দাম দিতে হয় সেই বিষয়টি নিয়ে কেন্দ্রীয় শিল্প সচিবের সঙ্গে আলোচনা করি। অত্যন্ত সুদক্ষ এই সচিব সাঈদ জাফরী সহজেই বিষয়টি আঁচ করলেন এবং সিমেন্টের দামও যাতে দুই অঞ্চলে সমান হয় তার জন্য তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিলেন। প্রতি টন সিমেন্টে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য কিছু ভর্তুকি দেয়ার ব্যবস্থা হলো। মন্ত্রিসভা বৈঠক প্রতি সপ্তাহে একটা নির্দিষ্ট সময়ে হতো এবং সচরাচর তা ছিল সকাল বেলা এবং সেটি নিয়মিতভাবে রাওয়ালপিন্ডি প্রেসিডেন্ট ভবনে অনুষ্ঠিত হতো। মাঝে মাঝে প্রেসিডেন্ট সফরে থাকলে ঢাকায় হতো। পাঁচ বছরে এক কি দু’বার লাহোরেও এই সভা হয়। একইভাবে জাতীয় অর্থনৈতিক কাউন্সিলের নির্বাহী কমিটির সভাও নিয়মিতভাবে মাসে একবার হতো এবং কোন কোন সময় হয়ত দু’বারও হতো। অর্থনৈতিক কাউন্সিলের নির্বাহী কমিটির সভা একটি নির্দিষ্ট চক্রে রাওয়ালপিন্ডি, লাহোর এবং ঢাকায় অনুষ্ঠিত হতো। চলবে...
×