ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

লক্ষ্যমাত্রা থেকে পিছিয়ে ১৯ প্রতিষ্ঠান

নয় মাসে এক টাকাও ঋণ দেয়নি দুই আর্থিক প্রতিষ্ঠান

প্রকাশিত: ০৪:৪০, ১৮ ডিসেম্বর ২০১৬

নয় মাসে এক টাকাও ঋণ দেয়নি দুই আর্থিক প্রতিষ্ঠান

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ ঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে দেয়া হলেও তা পূরণ করতে পারছে না নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো। এ তালিকার ৩৩টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ১৯ প্রতিষ্ঠান ঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা থেকে পিছিয়ে রয়েছে। অনেকে আবার এক টাকাও ঋণ বিতরণ করতে পারেনি গত ৯ মাসে। কারও কারও ঋণ বিতরণের পরিমাণ লক্ষ্যমাত্রার ২০ শতাংশের নিচে। এদিকে সেবা খাতে ১৫ শতাংশ, মেনুফ্যাকচারিং খাতে ৩০ শতাংশ এবং ব্যবসা খাতে ৫৫ শতাংশ কটেজ, মাইক্রো, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা (সিএমএসএমই) খাতে ঋণ বিতরণের নিয়ম থাকলেও তা মানছে না আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো। বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন বাংলাদেশ ব্যাংক। ঋণ বিতরণের নিয়ম ঠিকঠাকভাবে মেনে ঋণ বিতরণের নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সম্প্রতি সিএমএসএমই খাতে ঋণ বিতরণের চিত্র নিয়ে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে একটি সভা করে বাংলাদেশ ব্যাংকের এসএমই বিভাগ। সভায় আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণ বিতরণের এ চিত্র তুলে ধরা হয়। বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, ৩২টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ১৯টিই তাদের নির্ধারিত ঋণ বিতরণ লক্ষ্যমাত্রা থেকে অনেক দূরে রয়েছে। অনেকে আবার এক টাকাও ঋণ বিতরণ করতে পারেনি। কারও কারও ঋণ বিতরণের পরিমাণ লক্ষ্যমাত্রার ২০ শতাংশের নিচে। এ ধরনের প্রতিষ্ঠানকে ঋণ বিতরণ বৃদ্ধির জন্য তাগিদ দেয়া হয়েছে। এ সময় আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো কেন ঠিকঠাকভাবে ঋণ বিতরণ করতে পারেনি, তা জানতে চাওয়া হয় বৈঠকে। সূত্রে জানা গেছে, এ খাতে ঋণ বিতরণে সবচেয়ে পিছিয়ে রয়েছে সিএএমপি ভেনচার ক্যপিটাল, ন্যাশনাল ফাইন্যান্স, বিআইএফএফসি ও আইডিসিওএল। এর মধ্যে চলতি বছরের প্রথম ৯ মাসে (জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর) আইডিসিওএল এবং বিআইএফএফসি কোন প্রকার ঋণ বিতরণ করেনি। ন্যাশনাল ফাইন্যান্স ২৯ কোটি ৫০ লাখ টাকা বিতরণ লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে বিতরণ করতে পেরেছ মাত্র ২ কোটি ৩৫ লাখ টাকা, যা লক্ষ্যমাত্রার ৭ দশমিক ৯৭ শতাংশ। আর সিএএমপি ভেনচার ক্যাপিটাল চলতি বছরের ৯ মাসে ঋণ বিতরণ করেছে ৩ কোটি ১০ লাখ টাকা। এছাড়া ঋণ বিতরণে জিএসপি ফাইন্যান্স, বে-লিজিং, রিলায়েন্স ফাইন্যান্স, ন্যাশনাল হাউজিং ফাইন্যান্স, উত্তরা ফাইন্যান্স, প্রিমিয়ার লিজিং, বিআইএফসি, ফারইস্ট ফাইন্যান্স, ফার্স্ট লিজিং, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং, ইউনিয়ন ক্যাপিটাল, বিএফআইসি, লঙ্কা-বাংলা ফাইন্যান্স পিছিয়ে রয়েছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ফারইস্ট ফাইন্যান্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শান্তনু সাহা বলেন, ‘আমরা এ সময়টাতে হয়ত যথাযথ গ্রাহক কম পেয়েছি। সে কারণে অন্যদিকে ঋণ বিতরণ হলেও এখানে কিছুটা কম বিতরণ হয়েছে। এছাড়া আমাদের কিছু সমস্যাও রয়েছে। যেমন শাখার সংখ্যা অনেক কম। মাত্র বনানী ও চট্টগ্রামে দুটি শাখা খুলেছি। এজন্য ছোট ঋণ বিতরণ আমাদের জন্য একটু কষ্টকর। ফারইস্ট ফাইন্যান্স এ নয় মাসে প্রায় ৪০০ কোটি টাকার মতো বিতরণ করেছে। তবে এসএমইতে ঋণ বিতরণ করতে পেরেছে ৩৮ কোটি টাকা। যেখানে পুরো বছরের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে ৭৯ কোটি ৮৯ লাখ টাকা। অর্থাৎ লক্ষ্যমাত্রার ৪৭ দশমিক ৬২ শতাংশ ঋণ বিতরণ হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, চলতি বছরের প্রথম নয় মাসে সবচেয়ে বেশি ঋণ বিতরণ করেছে ইউনাইটেড লিজিং কোম্পানি। আর্থিক প্রতিষ্ঠানটি ১ হাজার ৬৩২ কোটি টাকা লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে ৯ মাসে বিতরণ করেছে ১ হাজার ৪১৯ কোটি টাকা, যা লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় প্রায় ৮৭ শতাংশ। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে আইডিএলসি ফাইন্যান্স লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটি প্রায় ১ হাজার ৪০০ কোটি টাকা লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে ১ হাজার ৩০৩ কোটি টাকা বিতরণ করেছে, যা লক্ষ্যমাত্রার ৯০.৫ শতাংশ। তৃতীয়, চতুর্থ ও ৫ম অবস্থানে রয়েছে লঙ্কা-বাংলা, মাইডাস এবং ইসলামিক ফাইন্যান্স লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানগুলো লক্ষ্যমাত্রার যথাক্রমে- ২৫৮, ২০৬ এবং ১৩৯ কোটি টাকা বিতরণ করতে পেরেছে। যেখানে ইসলামিক ফাইন্যান্স লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও বেশি ঋণ বিতরণ করেছে। প্রতিষ্ঠানটির ঋণ বিতরণের পরিমাণ লক্ষ্যমাত্রার ১৪৫ শতাংশ। জানা গেছে, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে তদারকি করতে তিনটি শ্রেণীতে বিভক্ত করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর মধ্যে যারা ভাল করছে তাদের গ্রীন জোনে, যারা মাঝারি মানের তাদের ইয়েলো জোনে এবং যাদের অবস্থা খারাপ তাদের রেড জোনে রাখা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর চাপ সামলানোর সক্ষমতা পরীক্ষা বা স্ট্রেস টেস্টিং রেটিংয়ে ১৫ প্রতিষ্ঠান ‘রেড জোনে’ ঢুকেছে। সব ধরনের সক্ষমতা বিবেচনায় নিয়ে এ রেটিং করা হয়। ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী, এ ছাড়া ‘ইয়েলো জোনে’ পড়েছে ১৩ আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও ‘গ্রীন জোনে’ ৫ প্রতিষ্ঠান। জানা গেছে, বিভিন্ন অনিয়মের কারণে পিপলস লিজিং এ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেড, বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি (বিআইএফসি) ও ফার্স্ট ফিন্যান্সে পর্যবেক্ষক নিয়োগ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মহাব্যবস্থাপক পর্যায়ের তিন কর্মকর্তা এসব প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদের সভা, অডিট সভায় উপস্থিত থেকে পর্যবেক্ষণ করছেন। এর মধ্যে পিপলস লিজিংয়ে নিযুক্ত পর্যবেক্ষক বেশ কিছু ঋণের বিষয়ে আপত্তি তোলায় তাকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেয়া হয়। ফলে এসব পর্যবেক্ষকও এখন সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করছেন না, যাতে বাড়ছে খেলাপী ঋণ। জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গবর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ জনকণ্ঠকে বলেন, সব আর্থিক প্রতিষ্ঠান খারাপ নয়। তবে যেগুলোর আর্থিক পরিস্থিতি খুবই খারাপ এবং দুর্নীতি ও লুটপাট বেশি হয়েছে, প্রয়োজনে সেগুলোর পরিচালনা পর্ষদ ভেঙ্গে দেয়া যেতে পারে। তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংককে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অনিয়ম-দুর্নীতি কঠোর হস্তে দমন করতে হবে। আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা বলছেন, তিনটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বড় ধরনের অনিয়ম হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের পরিচালকরাই নামে-বেনামে প্রতিষ্ঠান থেকে অর্থ বের করে নিয়েছেন। আবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগের কিছু কর্মকর্তা এসব প্রতিষ্ঠানের মালিকানা বদলে ভূমিকা রেখেছেন।
×