ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

অভিনেত্রী থেকে নেত্রী

প্রকাশিত: ০৩:৫৯, ১৫ ডিসেম্বর ২০১৬

অভিনেত্রী থেকে নেত্রী

১৯৪৮ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন মাইসোর রাজ্যের মান্ড জেলায় এক তামিল আয়েঙ্গার ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্ম জয়ললিতার। তাঁর ঠাকুরদা ছিলেন মহীশূর রাজপরিবাদের চিকিৎসক। আর তাঁর দাদু ছিলেন হিন্দুস্থান এ্যারোনটিক্যালসের ইঞ্জিনিয়ার। জয়ার বাবা জয়রাম ছিলেন ধনী আইনজীবী। কিন্তু বিপুল পৈতৃক সম্পত্তির অধিকাংশই উড়িয়ে দিয়ে তিনি যখন মারা যান জয়ার বয়স তখন মাত্র দুই বছর। ছেলে জয়কুমার ও মেয়ে জয়ললিতাকে নিয়ে মা বেদবল্লী এসে ওঠেন বাপের বাড়ি। পঞ্চাশের দশকেই বেদবল্লী ছেলে-মেয়েকে নিয়ে চলে আসেন মাদ্রাজ। সে সময় দক্ষিণী সিনেমার পীঠস্থানে অভিনেত্রী হিসেবে নিজের জায়গাও করে নেন বেদবল্লী। পর্দায় তার নাম হয় সন্ধ্যা। জয়া তখন পড়াশোনায় মগ্ন। বাবার অবিমৃষ্যকারিতায় যে সামাজিক অবস্থান তাঁকে খোয়াতে হয়েছিল শৈশবে, আজীবন তা পুনরুদ্ধার করার চেষ্টা চালিয়েছিলেন জয়া। দশম শ্রেণীর পরীক্ষায় সারা রাজ্যের মধ্যে প্রথম হওয়ায় রাজ্য সরকারের স্বর্ণপদক জিতে নেন তিনি। স্কলারশিপ নিয়ে স্টেলা মরিস কলেজে ভর্তি হওয়ার পরপরই ফের ধাক্কা খান জয়া। পরিবারের আর্থিক দুরবস্থা সামাল দিতে মা তাকে জোর করেই নিয়ে যান পরিচালক সি ভি শ্রীধরের ছবির সেটে। ১৫ বছরের কিশোরী জয়াকে দাঁড়াতে হলো ক্যামেরার সামনে। তার ক্যারিয়ারের প্রথম ছবি বড়পর্দায় দেখতে পাননি জয়া। কারণ প্রাপ্তবয়স্কদের সেই ছবিতে প্রবেশাধিকার ছিল না সেদিনের কিশোরী জয়ার। রুপালি পর্দার চোখ ধাঁধানো নায়িকা জয়া ওই প্রথম ছবির গ্লানি ভুলতে পারেননি কখনও। ঝলমলে গ্ল্যামার, নাচ গানের প্রতিভা আর তীক্ষè বুদ্ধির দৌলতে দক্ষিণী সিনেমার তারকা হয়ে উঠতে সময় লাগেনি জয়ার। ১৯৬৪ সালে কন্নড় ছবি ‘চিন্নাড়া গোম্বে’-তে প্রথম মুখ্যচরিত্রে তার আত্মপ্রকাশ ঘটে। ১৯৬৫ সালে তামিল ছবি ‘ভেন্নিরা আদাই’-তে অভিনয় করেন। একই বছরে দক্ষিণের সুপারস্টার এমজি রামচন্দ্রনের সঙ্গে অভিনয় শুরু করেন। তাঁর সঙ্গে জয়া ২৮টি ছবিতে অভিনয় করেন। বাংলার উত্তম সুচিত্রা জুটির মতোই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে জয়া-এমজিআরের যুগলবন্দী। ১৯৬১ থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত তিনি মোট ১৪০টি ছবিতে অভিনয় করেন। বলাবাহুল্য, তামিল সিনেমার অন্যতম কিংবদন্তি অভিনেত্রী ছিলেন তিনি। তামিল ছাড়াও তেলেগু কন্নড় সিনেমাতে তার ছিল আকাশছোঁয়া জনপ্রিয়তা। নৃত্য, ধ্রুপদি সঙ্গীত, পিয়ানো বাজানোতেও পারদর্শী ছিলেন জয়া। তবে হিন্দী সিনেমায় তাকে তেমন দেখা যায়নি, ‘ইজ্জত’ নামে একটি ছবিতে অভিনয় করেছেন ১৯৬৮ সালে। নায়ক ছিলেন ধর্মেন্দ্র। সেই সময় নায়িকাদের মধ্যে গোটা দেশে সব থেকে বেশি টাকা পেতেন তিনি। তাঁর ১৪০ ছবির মধ্যে ১২০টিই দুর্দান্ত হিট। অভিনেত্রী হিসেবে শিবাজি গণেশের বিপরীতে তাঁর ছবি ‘পাট্টিকাড়া পাট্টানামা’ জাতীয় পুরস্কার পায়। এই ছবির জন্য পান ফিল্মফেয়ার শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর পুরস্কার। পর্দার সাফল্যেই থমকে যায়নি জয়া ও এমজিআরের যাত্রা। ১৯৭৭ সালে দেশজোড়া কংগ্রেসবিরোধী হাওয়ায় ভর করে তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী হন এমজিআর। তাঁর সঙ্গেই রাজনীতির অচেনা পথে হাঁটা শুরু হয় জয়ার। ১৯৮৩ সালে এমজিআর তাঁকে নিজের জনসংযোগ সচিবের দায়িত্ব দেন। কুশলী এমজিআর পরের বছরই রাজ্যসভার সাংসদ হিসেবে দিল্লীতে পাঠান জয়াকে। ইংরেজীতে সাবলীল জয়াই হয়ে ওঠেন রাজধানীতে এমজিআরের মুখ। কিছুকাল রোগভোগের পর এনজিআর যখন শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন, জয়ললিতাকে তিনি নিজের উত্তরসূরি করে যাননি। অনেক লাঞ্ছনা, বঞ্চনা, বিরোধিতা, বিদ্বেষ ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করে প্রথমে তিনি দলের নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে নিয়েছিলেন। তারপর হয়েছিলেন দলের মুখ্যমন্ত্রী। তবে তার আগে তিনি বিধানসভার বিরোধী দলনেত্রীও ছিলেন। তাঁর রাজনৈতিক জীবন ছিল সংগ্রামময়। প্রায় বারো বছর আগে বিবিসিকে দেয়া এক সাক্ষাতকারে জয়ললিতা বলেছিলেন- ‘এ দেশের রাজনীতি চিরকালই পুরুষশাসিত। ইন্দিরা গান্ধী প্রথম সেই দুর্গে ঘা মেরেছিলেন। কিন্তু এটা ভুললে চলবে না, ইন্দিরার একটা রাজনৈতিক অতীত ছিল। সেই রাজনৈতিক পরিবারের শিক্ষা ও সাহায্য তিনি উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছেন। আমি যা কিছু হয়েছি নিজের চেষ্টায়। আমাকে আজ পর্যন্ত হাতে করে কেউ কিছু তুলে দেননি। আমি নিজেই নিজেকে তৈরি করেছি।’ দেয়নি বলেই তিনি নিজের জগতটা নিজের মতো করেই গড়ে নিয়েছেন, কয়েকবার হয়েছেন মুখ্যমন্ত্রীও। ব্যক্তি জীবনে তিনি ছিলেন চিরকুমারী। তাই গর্ভজাত সন্তানের মা হওয়ার সৌভাগ্য তার হয়নি। কিন্তু তাতে কী? জয়ললিতা এক বিপুল জনরাশির হৃদয়ে রানী, আম্মা হয়ে বেঁচে থাকার ছাড়পত্র আদায় করে নিয়েছেন। এই বা-কম কীসের?
×