ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

আবুল মাল আবদুল মুহিত

সুদীর্ঘ ষাট বছরের বিচিত্র কর্মজীবন

প্রকাশিত: ০৩:৪৮, ১১ ডিসেম্বর ২০১৬

সুদীর্ঘ ষাট বছরের বিচিত্র কর্মজীবন

পঞ্চম অধ্যায় পাকিস্তানের সামরিক শাসক জেনারেল আইয়ুবের সাংবিধানিক একনায়কত্ব এবং আমার আমেরিকায় প্রথম ভ্রমণ (গতকালের পর) আমরা শহরটিতে ঘোরাফেরা করার পরে মনে হলো যে, এখানের ফল এবং ফুল অনেকটা আমাদের দেশের মত। কিছু কিছু ফল অবশ্যি আমাদের নিকটস্থ এলাকা দার্জিলিং অথবা শিলং-এ হয়ে থাকে। (বিজ্ঞানের কল্যাণে অবশ্যি বর্তমানে সেইসব ফল আমাদের দেশে প্রচুর উৎপন্ন হয়, যেমন- নাসপাতি এবং কমলা)। হনুলুলু ছাড়ার সময় একটি নির্দেশনা পেয়ে খুব আশ্চর্য হয়ে গেলাম। আমাদের বলা হলো যে, আমরা কোন কাঁচা সবজি বা ফল সঙ্গে নিয়ে যেতে পারবো না। হাওয়াই তো আমেরিকারই একটি রাজ্য। সেখানে এই নিষেধাজ্ঞা কেন? অনেকদিন পরে জানলাম যে, আমেরিকার নিকটস্থ দ্বীপগুলোতে উৎপন্ন ফল-ফসলে নানা ধরনের জীবাণু থাকে। যেটা আমেরিকার কৃষিখাতের জন্য বিপজ্জনক এবং সেজন্য তারা এই বিষয়ে খুবই সাবধানতা অবলম্বন করে। বোস্টনে যখন পৌঁছলাম তখন রাত প্রায় ৮টা। আমাদের ধারণা ছিল যে, চার্লস উইলিয়ামস্্ নামে একজন ব্যক্তি আমাদের খোঁজ-খবর করবেন। আমরা তাকেই আমাদের ভ্রমণসূচি প্রদান করেছিলাম। কিন্তু সেখানে পৌঁছে তাঁর কোন পাত্তাই পেলাম না। আমাকে বলা হয়েছিল, কেম্ব্রিজে একটি ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্টস্্ হাউস আছে এবং সেখানে তারা নবাগত ছাত্রদের সাহায্য করে। তাই আমি সব মালপত্র নিয়ে ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্ট হাউসে গিয়ে দেখি বিরাট জটলা। কোনমতে এক জায়গায় মালপত্র রেখে স্ত্রী-কন্যাকে বসিয়ে আমি অবশেষে অভ্যর্থনা ডেস্কে হাজিরা দিলাম। তারা অত্যন্ত সংবেদনশীল এবং সহানুভূতিপূর্ণ ব্যবহার করলো। তারা চার্লস উইলিয়ামসকে খুঁজে বের করলো। কিন্তু তিনি কোন সাহায্য করতে প্রস্তুত ছিলেন না। তিনি বললেন যে, আমরা কোন এক হোটেলে রাত্রিযাপন করে পরের দিন যেন তার সাথে যোগাযোগ করি। অভ্যর্থনা ডেস্কের মেয়েটি বললো, ‘আমরা আপনাদের সাহায্য করতে পারি। আমাদের একটি তালিকায় এমনসব বহু পরিবারের নাম-ঠিকানা আছে যারা বিদেশীদের সেবা করতে পছন্দ করে।’ তারা কোলনবার্গ নামের একটি পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করলো। মিসেস কোলনবার্গ আমার সঙ্গে কথা বলতে চাইলেন। তিনি বললেন যে, তিনি তক্ষণই ইন্টারন্যাশনাল হাউসে আসছেন এবং তিনি আমাদের তার বাড়িতে নিয়ে যাবেন। আমরা রাত্রিযাপন করে তারপর অন্য ব্যবস্থা করতে পারি। অতি অল্প সময়েই মিসেস কোলনবার্গ এসে হাজির হলেন। এবং তিনি নিজেই আমাদের মালপত্র তার মোটা গাড়িতে উঠাতে লাগলেন। আমার মনে হয় রাত ১০টার মধ্যেই তার বাড়িতে আমরা আশ্রয় পেলাম। তিনি কিছু হালকা খাবারের ব্যবস্থা করলেন। তার একটি ৭/৮ বছরের মেয়ে ট্রেসি তার বাড়িতে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল। বিদেশী অতিথিদের এবং বিশেষ করে একটি বাচ্চাকে সে দেখবেই দেখবে। সকাল বেলা নাস্তা খাবার সময়ই আমার মেয়ের জন্য তারা একজন ডাক্তারের ব্যবস্থা করবেন বলে জানালেন। মিসেস কোলনবার্গ আরও বললেন যে, আমাদের বাসস্থান খুঁজতে তিনিই সাহায্য করতে পারেন। তিনি আরও বললেন, এ ধরনের বাসস্থান পেতে ২/১ দিনই যথেষ্ট এবং আমরা এই ২/১ দিন তার বাড়িতেই থাকতে পারি। আমরা বাসস্থানের খোঁজে বেরিয়ে গেলাম এবং সম্ভবত পরের দিনই বিশ্ববিদ্যালয়ের খুবই কাছে একটি দালানের এক তলায় আমাদের উপযুক্ত একটি ফ্ল্যাট পেলাম। ফ্ল্যাটের অভ্যর্থনা কামরাটি ছিল বিরাট। শোবার ঘর যেমন-তেমন, একটি কিচেন এবং তার পাশে কিছু জায়গায় ছোট ডাইনিং টেবিলের জন্য খোলা জায়গা। একটি বড় বিছানা বাড়িটিতেই ছিল, একটি ছোট টেবিল এবং ৪টি চেয়ারও বাড়িতে ছিল। কিন্তু অভ্যর্থনা কামরার জন্য কোন আসবাবপত্র ছিল না। আমরা এই ফ্ল্যাটটিই ভাড়া নিলাম এবং ঠিক করলাম যে, অভ্যর্থনা কামরার জন্য আমরা কিছু আসবাবপত্র ভাড়া অথবা খরিদ করবো। আমরা তৃতীয় দিনে আমাদের ফ্ল্যাটে স্থানান্তরিত হলাম। অবশ্য সেদিনটিও সকাল এবং দুপুর মিসেস কোলনবার্গ আমাদের সঙ্গে অনেক সময় কাটালেন। তিনি আমাদের হার্ভাড কূপে নিয়ে গেলেন এবং আরও ২/১টি দোকানে নিয়ে গেলেন। আমরা প্রয়োজনীয় বিছানার চাদর, বালিশ, তোয়ালে, বাসন-কোসন, কিছু তৈজসপত্র ইত্যাদি খরিদ করলাম এবং অভ্যর্থনা কামরার জন্য কিছু আসবাবপত্র ভাড়া করলাম। আমাদের কেম্ব্রিজের জীবনের এই হলো সূচনা। নতুন একটা ফ্ল্যাট সাজিয়ে নিতে মোটেই সময় লাগলো না। আমরা সেদিনই আমাদের মেয়ের জন্য প্র্যামও (প্ররামবুলেটর) কিনে নিলাম। ইতোমধ্যে আমাদের মেয়েকে একজন ডাক্তার দেখলেন এবং জানালেন যে, তার ব্রঙ্কাইটিস নিউমোনিয়ায় রূপান্তরিত হয়েছে। ব্রাজেলটন নামের এই ডাক্তার পরবর্তীকালে প্রায় ১০ বছর পরে আমেরিকার সর্বশ্রেষ্ঠ শিশু চিকিৎসক হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন। নতুন ছাত্র হিসেবে আমার বেশ অসুবিধা হতে থাকল। আমার লেখালেখি করতে অনেক সময় লাগে, হাত যেন চলে না। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত গ্রন্থাগারে মাঝে মাঝে ঘুমিয়ে পড়ি। বিলেতে পড়াশোনার তিনটি টার্ম ছিল, এখানে দুটি। অর্থাৎ এক একটি কোর্স ৬ মাসের কিন্তু কিছু কোর্স দুই টার্মের জন্য নিতে হতো। আমি পরবর্তী ৯ মাস একজন অত্যন্ত আগ্রহী এবং ব্যস্ত ছাত্র হিসেবে দিন কাটাই। আমি লাইব্রেরিতে প্রায়ই রাত ১১টা পর্যন্ত কাজ করতে থাকি এবং নানা বিষয়ে পড়াশোনা চালাই। দুই সেমিস্টারে আমি কোর্স নিই ১১টি। আমার এমপিএ সনদের জন্য প্রয়োজনীয় ছিল ৮টি। আমার কোর্সগুলো ছিল নিম্নোক্ত : ১. শাসনতান্ত্রিক আইন, ২. অর্থনীতির জন্য অঙ্ক, ৩. উন্নয়নশীল দেশে জনপ্রশাসন, ৪. দুই টার্মের জন্য উন্নয়ন অর্থনীতি (উবাবষড়ঢ়সবহঃ ঊপড়হড়সরপং) : যেটি ছিল বাধ্যতামূলক বিষয় এবং এই কোর্সটি পড়াতেন বিখ্যাত অধ্যাপক ডিন জন মেসন এবং প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত ও অধ্যাপক জন কেনেথ গলব্রেইত; ৫. ২টি কোর্স আমি নিলাম প্রফেসর মায়ার্সের অধীনে যানবাহন অর্থনীতি (ঊপড়হড়সরপং ড়ভ ঞৎধহংঢ়ড়ৎঃধঃরড়হ); ৬. আমার অন্য দুটি কোর্স ছিল একটি মজার কোর্স। এইটি আমাদের সব পাবলিক সার্ভিস ফেলোদের জন্য তৈরি করা হয়। এই কোর্সের নাম হয় জবধফরহমং রহ উবাবষড়ঢ়সবহঃ ঊপড়হড়সরপং. প্রতি সপ্তাহে নামকরা সব অধ্যাপক নির্দিষ্ট বিষয়ে আমাদের বক্তৃতা শোনাতেন এবং আমাদের জন্য উত্তম রিডিং লিস্ট সরবরাহ করা হয়। বোস্টনে আমাদের বসবাস সহজ করে দিতে হার্ভার্ড ডেভেলপমেন্ট এ্যাডভাইজারি সার্ভিসে যেসব অধ্যাপক পাকিস্তানে কাজ করেছেন তারা আমাদের নানাভাবে সাহায্য করেন। প্রথমেই গুস্তাব পাপানেক, যিনি সেই বছর সাবাটিক্যাল ছুটিতে ছিলেন, একটি শনিবারে সারাদিনের জন্য আমাদের তার কান্ট্রি হাউসে নিয়ে গেলেন। বিল হোলিঞ্জার সে রকম একটি ব্যবস্থা করলেন আর এক সপ্তাহান্তে। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অথবা সংশ্লিষ্ট নন সে রকম কিছু ব্যক্তি মাঝে মধ্যে নৈশভোজ বা দুপুরের খানায় আমাদের আমন্ত্রণ জানাতেন। ১৯৬৩-৬৪ সালেও আমেরিকায় যথেষ্ট সাদা-কালো বৈষম্য ছিল। আমরা ডালাসে দেখে এসেছিলাম, সেখানে কোন কোন রেস্তরাঁয় এক ধরনের বৈষম্য রয়েছে। বোস্টনে এই বৈষম্যটি ছিল বেশ প্রচ্ছন্ন। তবে একেবারে যে ছিল না তা বলা যাবে না। আমরা আমেরিকা পৌঁছানোর কিছুদিন পরেই ডালাসে প্রেসিডেন্ট জন কেনেডি আঁততায়ীর গুলিতে নিহত হন। ম্যাসাচুয়েটস ছিল কেনেডির রাজ্য এবং হার্ভার্ডে তাদের পরিবারের প্রভাব ছিল ব্যাপক। বিধবা মিসেস কেনেডি হার্ভার্ডে আসলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট পিউসির আমন্ত্রণে। আমরা রাস্তায় দাঁড়িয়ে এবং প্রেসিডেন্ট পিউসির বাসভবনের কাছে দাঁড়িয়ে মিসেস কেনেডি এবং তার ছোট ছেলেকে দেখলাম। হার্ভার্ড গ্র্যাজুয়েট স্কুল অব পাবলিক এ্যাডমিনিস্ট্রেশন স্কুলকে কেনেডি স্কুল হিসেবে নামান্তরণ করল। যেদিন তার মৃত্যু সংবাদ প্রচারিত হলো সেদিন হার্ভার্ডের নানা জায়গায় ক্রন্দনরত মানুষের অন্ত ছিল না। প্রেসিডেন্ট কেনেডি তার ভাই রবার্ট কেনেডিকে তার এ্যাটর্নি জেনারেল নিযুক্ত করেছিলেন। প্রেসিডেন্ট কেনেডির উত্তরাধিকারী প্রেসিডেন্ট লিনডন জনসন তাকে সেই পদে বেশ কিছুদিন বহাল রাখেন। রবার্ট কেনেডি বোস্টনের ব্রুকলিনে জন্ম নেন ১৯২৫ সালের ২০ নবেম্বর। ঊনবিংশ শতাব্দীতে আমার মতে আমেরিকায় কয়েক অসাধারণ রাষ্ট্রপতি দেশ তথা পৃথিবীতে নেতৃত্ব প্রদান করেন, তাদের মধ্যে ছিলেন ফ্রেডরিক রুজভেল্ট, জন কেনেডি এবং বিল ক্লিনটন। প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট ১২ বছর রাষ্ট্রপতি ছিলেন। তার সময়েই সাংবিধানিক সংশোধনী এনে স্থির হলো যে কোন রাষ্ট্রপতি পর পর দু’বারের বেশি নির্বাচিত হতে পারবেন না। প্রেসিডেন্ট কেনেডি সবচেয়ে কম দিনের জন্য প্রেসিডেন্ট ছিলেন। মাত্র দু’বছর দশ মাস। রবার্ট কেনেডি জনসন মন্ত্রিসভা থেকে ১৯৬৪ সালে বিদায় নিয়ে নিউইয়র্ক থেকে শীর্ষস্থানীয় রিপাবলিকান সিনেটর কেনেথ কিটিংকে পরাজিত করে হলেন মার্কিন সিনেটর। ১৯৬৮ সালে প্রেসিডেন্ট জনসনের বিরুদ্ধে জনমত আঁচ করে তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অবতীর্ণ হলেন। দলীয় শক্তিশালী প্রার্থী ম্যাকার্টিকে পরাজিত করে তিনি এগিয়ে চললেন। ঠিক তখনই এক আঁততায়ী সিরহানের গুলিতে তিনি ১৯৬৮ সালের জুনে মাত্র ৪৩ বছর বয়সে লস এ্যাঞ্জেলেসের এ্যাম্বেসেডর হোটেলে নিহত হন। আমরা হার্ভার্ডে ছিলাম সেপ্টেম্বর ১৯৬৩ থেকে জুন ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত একটি শিক্ষা বছর। এই সময়ে ডিসেম্বর জানুয়ারিতে নিউইয়র্ক এবং ওয়াশিংটনে বেড়াতে গেলাম এবং একেবারেই পর্যটকের মতো ঘুরে বেড়ালাম। এই ভ্রমণে আমাদের সফরসঙ্গী ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন রাজনীতি বিভাগের প্রভাষক মাহফুজুর রহমান ও তার পরিবার। মাহফুজ তখন কলাম্বিয়াতে তার চঐউ পড়াশোনায় ব্যস্ত ছিলেন। নিউইয়র্ক থেকে ওয়াশিংটন গেলাম এবং সেখানে ঘোরাফেরা করলাম মাহফুজের বন্ধু একজন দাক্ষিণাত্যের ভারতীয় ছাত্রের গাড়িতে করে। তার নাম এখন আমি মনে করতে পারছি না। ওয়াশিংটনে আমরা প্রেসিডেন্ট কেনেডির কবরে শ্রদ্ধা নিবেদন করতে গেলে আমাদের লাইনে দাঁড়াতে হয় প্রায় ঘণ্টা দুয়েক। কত গুণমুগ্ধ নাগরিক সেখানে নিঃশব্দে এবং সশব্দে কাঁদছিলেন তার ইয়ত্তা নেই। বোস্টন থেকে এক ফাঁকে অনতিদূরে উইলিয়ামস কলেজে বেড়াতে গেলাম দুদিনের জন্য। সেখানে আমার বন্ধু আবু শরফ সাদেক তখন মাস্টার্স ডিগ্রীর জন্য পড়াশোনা করছিলেন। আমাদের সঙ্গে বোস্টনে তখন পড়াশোনা করছিলেন আমার বন্ধু বছরখানেকের কনিষ্ঠ পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র মাহবুবুল আলম। সেই বছরে বাস্তুকলায় পড়তে যায় বর্তমানে পোল্ট্রি শিল্পের দিকপাল কাজী জাহেদ, যাকে আমি চিনতাম প্রসিদ্ধ কোর্ট ইন্সপেক্টর জহুরুল হক সাহেবের ছেলে হিসেবে। চলবে...
×