ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

শাহরিয়ার কবির

কূটনৈতিক স্বীকৃতির ৪৫তম বার্ষিকী ॥ বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী এবং দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক নিরাপত্তা

প্রকাশিত: ০৩:৫৭, ৬ ডিসেম্বর ২০১৬

কূটনৈতিক স্বীকৃতির ৪৫তম বার্ষিকী ॥ বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী এবং দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক নিরাপত্তা

গত শতাব্দীতে প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বহু দেশ ও জাতি ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম করে স্বাধীনতা অর্জন করেছে। যে কোন দেশের স্বাধীনতার যুদ্ধে কখনও একা জয়ী হওয়া যায় না, মিত্র দেশের সাহায্য প্রয়োজন হয়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সূচনা থেকে বিজয় অর্জন পর্যন্ত ভারত যেভাবে আমাদের সাহায্য করেছে বিশ্বের অন্যান্য দেশ ও জাতির স্বাধীনতার সংগ্রামে তেমনটি ঘটেনি। যে কারণে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীন বাঙালী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণার পর মাত্র নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বের মানচিত্রে স্থান পেয়েছে। ভারত প্রথম বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। ১৯৭১-এর ৬ ডিসেম্বর ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ বাংলাদেশ সরকারকে কূটনৈতিক স্বীকৃতি প্রদান করে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে যেমন বৈধতা দিয়েছেন, একইভাবে এই স্বীকৃতি রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধাদের বিপুলভাবে উজ্জীবিত করে বিজয় ত্বরান্বিত করেছে। একই দিনে ভুটানও বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। ১৯৭১-এর ২৫ মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্তানের সামরিক জান্তা যখন ‘অপারেশন সার্চলাইট’-এর নামে বাংলাদেশের মাটিতে স্মরণকালের ইতিহাসের নৃশংসতম গণহত্যাযজ্ঞ আরম্ভ করেছিল, তখন আক্রান্ত মানুষ প্রাণ বাঁচাবার জন্য ভারতের মাটিকেই নিরাপদ আশ্রয় মনে করে। ২৭ মার্চ কারফিউ তুলে নেয়ার পর থেকেই শহরের মানুষ প্রথমে গ্রামে এবং পরে গ্রাম থেকে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, মেঘালয় ও অসমে গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করেছে। সেই দুঃসময়ে ভারত যদি বাংলাদেশের শরণার্থীদের জন্য সীমান্ত উন্মুক্ত না করত তাহলে মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে তিরিশ লাখের জায়গায় নিহতের সংখ্যা এক কোটি হতে পারত। ২৫ মার্চ সন্ধ্যায় ঢাকা থেকে ইসলামাবাদ যাওয়ার আগে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান তার বাহিনীকে বলেছিলেন এদেশের মাটি চান তিনি, কোন মানুষ চান না। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে ভারত বাংলাদেশের এক কোটি শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছে, মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র-সরঞ্জাম দিয়েছে, বাংলাদেশের গণহত্যার বিরুদ্ধে এবং স্বাধীনতার পক্ষে আন্তর্জাতিক জনমত সংগঠিত করেছে এবং পাকিস্তানের কারাগার থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির জন্য প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী, তার মন্ত্রিসভার সদস্যবৃন্দ এবং প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূতরা বিশ্বের অধিকাংশ দেশ সফর করেছেন। যে কারণে পাকিস্তানী সামরিক জান্তা ফাঁসির মঞ্চ বানালেও বঙ্গবন্ধুকে ফাঁসি দিতে পারেনি। ১৯৭১ সালে ভারত বাংলাদেশকে স্বাধীন হতে কেন সাহায্য করেছিল? এ প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে পাকিস্তানে এবং বাংলাদেশে পাকিস্তানপন্থী রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ঐতিহাসিকরা বলেন, বাঙালীদের সঙ্গে পাকিস্তানী শাসকদের বিরোধের সুযোগে ভারত জন্মশত্রু পাকিস্তানকে দুর্বল ও দ্বিখণ্ডিত করার জন্য ’৭১-এর যুদ্ধ আরম্ভ করেছিল। মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পর পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তিলাভ করে স্বাধীন বাঙালী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান লন্ডন ও দিল্লী হয়ে ১০ জানুয়ারি ১৯৭২-এ সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর অনুরোধে বঙ্গবন্ধু কয়েক ঘণ্টার জন্য দিল্লীতে যাত্রাবিরতি করেছিলেন। দিল্লীতে তাঁর সম্মানে বিশাল নাগরিক সংবর্ধনার আয়োজন করা হয়েছিল। দিল্লীর সংবর্ধনা সভায় বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সরকার এবং জনগণের অকুণ্ঠ সমর্থন ও সহযোগিতার জন্য গভীর কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করে বলেছিলেন, ‘আমাকে (লন্ডনে) প্রশ্ন করা হয়েছে, ভারত কেন আপনাদের এত সাহায্য করেছে? ভারতের সঙ্গে আপনাদের কীসের এত মিল? আমি বলেছি, ভারতের সঙ্গে আমাদের মিল হচ্ছে নীতির মিল। আমি বিশ্বাস করি গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতায়। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীও তাই বিশ্বাস করেন। আমাদের এই মিলÑ নীতির মিল, আদর্শের মিল, বিশ্ব শান্তির জন্য এই মিল।’ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি ভারতের সর্বস্তরের জনসাধারণের সমর্থন ছিল অভূতপূর্ব। এক কোটি শরণার্থীর ব্যয়ভার সরকারের সঙ্গে সাধারণ মানুষও বহন করেছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর প্রায় ১৭ হাজার সদস্য শহীদ হয়েছেন, যা ইতিহাসে বিরল। ভারত যে আদর্শের জন্য মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশকে সর্বাত্মক সমর্থন ও সহযোগিতা প্রদান করেছিল সেই আদর্শে বাংলাদেশ অবিচল থাকতে পারেনি। জোটনিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি থেকে বাংলাদেশের বিচ্যুতি ঘটেছে বঙ্গবন্ধুর আমলে ১৯৭৪-এ ইসলামী ঐক্য সংস্থায় যোগদানের মাধ্যমে। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পর জেনারেল জিয়া ক্ষমতায় এসে ৫ম সংশোধনীর দ্বারা সংবিধান পরিবর্তনের সময় পররাষ্ট্রনীতি সংক্রান্ত ২৫ অনুচ্ছেদে যুক্ত করেছেন, ‘রাষ্ট্র ইসলামী সংহতির ভিত্তিতে মুসলিম দেশসমূহের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব সম্পর্ক সংহত, সংরক্ষণ এবং জোরদার করিতে সচেষ্ট হইবেন।’ প্রকৃতপক্ষে সংবিধানের ৫ম সংশোধনীর মাধ্যমে যা কিছু সংযুক্ত ও বিয়োজিত হয়েছে সবই ছিল ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের সমাজ ও রাষ্ট্রের ‘পাকিস্তানিকরণ’ ও ‘ইসলামিকরণ’ প্রক্রিয়ার অন্তর্গত, যার অভিঘাত থেকে পররাষ্ট্রনীতিও মুক্ত ছিল না। একই মনোভাব আমরা লক্ষ্য করি প্রতিরক্ষা নীতির ক্ষেত্রেও। ভারত প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রে বেশি গুরুত্ব দেয় পাকিস্তান ও চীনকে। এই দুটি দেশের সঙ্গে ভারতকে কয়েক দফা সম্মুখযুদ্ধ এবং ধারাবাহিকভাবে ছায়াযুদ্ধে লিপ্ত থাকতে হয়েছে, এখনও হচ্ছে। ভারতের প্রতিরক্ষা নীতিতে বাংলাদেশ কোন হুমকি না হলেও পাকিস্তানপন্থীরা যখন ক্ষমতায় ছিল তখন তারা ভারতকে হুমকি মনে করেছে। জাতীয় আয়ের তুলনায় বাজেটে প্রতিরক্ষা খাতে বাংলাদেশের বরাদ্দ সবসময় উপরের দিকে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান লক্ষ্য থাকে বিভিন্ন দেশে জাতিসংঘের শান্তি বাহিনীতে অংশগ্রহণ। আওয়ামী লীগ বিরোধীরা ক্ষমতায় থাকলে সশস্ত্র বাহিনীকে সতর্ক রাখা হয় ভারতের পক্ষ থেকে কাল্পনিক আক্রমণের সম্ভাবনা সম্পর্কে, তাদের নিয়োজিত রাখা হয় পার্বত্য চট্টগ্রামে সংক্ষুব্ধ পাহাড়ী জনগোষ্ঠী দমনে। বাংলাদেশের দুজন রাষ্ট্রপতি নিহত হয়েছেন সামরিক অভ্যুত্থানে। জেনারেল মইনের সেনাসমর্থিত সরকার ছাড়া প্রতিটি সামরিক সরকার ছিল ভারতবিদ্বেষী এবং পাকিস্তানপন্থী। বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্কের ভেতর কিছু টানাপোড়েন সত্ত্বেও দুই দেশ অভিন্ন সভ্যতা, ঐতিহ্য ও ইতিহাসের উত্তরাধিকারী। বর্তমানে বাংলাদেশের জনসংখ্যার প্রায় ৯০ ভাগ ধর্মীয় পরিচয়ে মুসলমান। ভারতে মুসলিম জনসংখ্যা বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের চেয়ে বেশি। ভারত ও বাংলাদেশের তুলনায় পাকিস্তানের ইসলাম অনেক বেশি উগ্র, সামরিক ও রাজনৈতিক চরিত্রসম্পন্ন। ভারত ও বাংলাদেশে ইসলাম প্রচার করেছেন প্রধানত সুফী সাধকরা, যারা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও মানবতার ওপর বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানের ওয়াহাবি ইসলাম পরাজিত হয়েছে বাংলাদেশের অসাম্প্রদায়িক মানবিক বোধের কাছে। এই মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের মানুষ ধর্ম ও জাতিসত্তা নির্বিশেষে যুদ্ধ করেছে রাজনৈতিক ইসলামের ধ্বজাধারী পাকিস্তানী সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে। বাংলাদেশে বাংলাভাষী মানুষের সংখ্যা ১৬ কোটির ওপরে। বাংলাদেশের সীমান্ত সংলগ্ন ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, অসম ও ত্রিপুরায় বাঙালী জনসংখ্যা প্রায় ১০ কোটি। ১৯৪৭ সালের দেশ ভাগের আগে বাংলাদেশ ও ভারত এক দেশ ছিল, পশ্চিমবঙ্গ, অসম ও ত্রিপুরার সঙ্গে পূর্ব বাংলার কোন সীমানা ছিল না। পশ্চিম বাংলা ও বাংলাদেশের মানুষের ভাষা ও সংস্কৃতি অভিন্ন, উত্তরাধিকার ও অর্জন অভিন্ন। চণ্ডীদাস, লালন, রবীন্দ্রনাথ, নজরুলের অসাম্প্রদায়িক মানবিক চেতনায় আলোকিত হয়েছে বাংলাদেশ ও পশ্চিম বাংলা শুধু নয়Ñ ভারতেরও বিশাল জনগোষ্ঠী। ভারত ও বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত রবীন্দ্রনাথের ভা-ার থেকে নেয়া হয়েছে। ২০১১ সালে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সার্ধশত জন্মবার্ষিকী দুই দেশ সরকারী ও যৌথভাবে উদযাপন করেছে। বাংলাদেশ ও পশ্চিম বাংলার মানুষ সরকারী উদ্যোগের অনেক আগেই হৃদয়ের সকল শ্রদ্ধা ও ভালবাসা উজাড় করে রবীন্দ্রনাথকে স্মরণ করেছে জন্ম সার্ধশতবর্ষে। আমরা বিশ্বাস করি আগামী দ্বিশতবার্ষিকী কিংবা সহস্রবার্ষিকীতে আরও ব্যাপক ও বিশাল আয়োজন হবে কবিগুরুকে কেন্দ্র করে। বাঙালীর অহঙ্কার, অর্জন ও বিশ্ব মানবতার প্রতি অঙ্গীকার পৃথিবীর সকল কোণে ধ্বনিত হবে। মাতৃভাষার মর্যাদার জন্য পূর্ব বাংলার মানুষ রক্ত দিয়েছে। ২১ ফেব্রুয়ারি আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে সমগ্র বিশ্বে। একুশের চেতনার উত্তাল তরঙ্গ বাংলাদেশের সীমানা অতিক্রম করে পশ্চিমবঙ্গ, অসম ও ত্রিপুরায় ছড়িয়ে পড়েছে, প্রতিবছর ক্রমশ বিস্তৃত হচ্ছে। ১ বৈশাখ বাংলা নববর্ষ উদযাপন এক সময় গ্রাম বাংলার লোকজ উৎসব ছিল। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর এটি পরিণত হয়েছে জাতীয় উৎসবে। গত ২৯ নবেম্বর (২০১৬) ইউনেস্কো বাংলাদেশের অনন্যসাধারণ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য পহেলা বৈশাখের মঙ্গল শোভাযাত্রাকে ‘অমূল্য সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য’ (ওহঃধহমরনষব ঈঁষঃঁৎধষ ঐবৎরঃধমব) হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। বাংলা নববর্ষ এখন পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতা থেকে আরম্ভ করে সর্বত্র সাড়ম্বরে উদযাপিত হচ্ছে। এখানে মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার ঠাঁই নেই। চলবে...
×