ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০৮ মে ২০২৪, ২৪ বৈশাখ ১৪৩১

ডাঃ মোঃ শারফুদ্দিন আহমেদ

শ্রদ্ধাঞ্জলি ॥ শহীদ ডাঃ মিলন এবং গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রা

প্রকাশিত: ০৩:৪৬, ২৭ নভেম্বর ২০১৬

শ্রদ্ধাঞ্জলি ॥ শহীদ ডাঃ মিলন এবং গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রা

১৯৯০ সালের স্বৈরাচারবিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলনে শহীদ ডাঃ শামসুল আলম খান মিলনের আত্মাহুতি নির্বাসিত গণতন্ত্রের পুনঃউত্থানে চিকিৎসক সমাজকে অত্যন্ত সম্মানের আসনে আসীন করেছে। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, ঢাকা মেডিক্যালের পাশে সুউচ্চ শহীদ মিনার প্রতিষ্ঠা, ’৬৯-এর গণআন্দোলন এবং ’৭১-এর মহান স্বাধীনতাযুদ্ধে এ সংগঠনের সংগ্রামী সদস্য সেনারা নির্ভীক আত্মত্যাগের মহিমায় মহিমান্বিত। ১৯৯৬ সালের ভোট ও ভাতের অধিকার এবং ১/১১ এর আন্দোলনে জননেত্রী শেখ হাসিনার মুক্তি আন্দোলনে চিকিৎসক সমাজ বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেছে। পেশাজীবীদের মধ্যে সর্বোচ্চ রক্তদানকারী শহীদ চিকিৎসকরা অন্য মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে নিয়ে স্বাধীনতার সূর্য ছিনিয়ে এনেছেন। সেই গৌরবময় ইতিহাস ও পূর্বসূরিদের অনুপ্রেরণায় আমি ও মিলনসহ বিএমএ’র সদস্যরা গর্বিত। ডাঃ মিলন হত্যার সঙ্গে সঙ্গে দেশের সকল চিকিৎসক সমাজ রাস্তায় বেরিয়ে আসে এবং এরশাদ সরকারের পদত্যাগের দাবিতে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। ডাঃ মিলনের রক্ত ছুঁয়ে শপথ করে এরশাদ পদত্যাগ না করা পর্যন্ত তারা কাজে যোগদান করবেন না। এরশাদ সরকারের অধীনে চাকরি না করার অঙ্গীকার করে পদত্যাগের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন। ১৯৯০ সালের ২৮ নবেম্বর এদেশের চিকিৎসক সমাজ সারাদেশে হরতালের ডাক দেয়। স্বৈরাচারবিরোধী বিভিন্ন জোট এই হরতালকে সমর্থন দেয় এবং তারাও নতুন করে স্বৈরাচারের জরুরী আইন ও কারফিউ আইন অমান্য করার কর্মসূচী ঘোষণা করেন। ডাঃ মিলনের আত্মাহুতির মধ্য দিয়ে দেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলন চূড়ান্ত রূপ লাভ করে। লক্ষ্মীপুরের মোঃ সাজুদ্দিন খানের ছেলে মিলন জন্ম নেন ২৯ জানুয়ারি ১৯৫৭ সালে। মিলন ১৯৭৭ সালে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে ১ম বর্ষে ভর্তি হয়ে ১৯৮৩ সালে ডাক্তার হন। এর পর ইন্টার্ন চিকিৎসকদের আহ্বায়ক, বিএমএর সক্রিয় সদস্য ও ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ শিক্ষক সমিতির কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। শহীদ ডাক্তার শামসুল আলম খান মিলনের সঙ্গে বিএমএর অফিস সেক্রেটারি হিসেবে আমার একত্রে কাজ করার সুযোগ হয় ১৯৮৮ সাল থেকে। বিএমএ দুটি প্যানেলে নির্বাচন করে ডাঃ মাজেদ-ডাঃ মাহবুব ও ডাঃ সারোয়ার-ডাঃ জালাল পরিষদে একটি প্যানেলের মাত্র দুজন জয়ী হন। ডাঃ এমএ মাজেদ সভাপতি ও ডাঃ শামসুল আলম খান মিলন যুগ্ম সম্পাদক। ডাঃ মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন মহাসচিব নির্বাচিত হলে আমি দফতর সম্পাদক নির্বাচিত হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করি। একই কার্যকরী পরিষদে আমরা সবাই অভিন্ন মনোভাব নিয়ে কাজ করতে থাকি। জেল-জুলুম হুলিয়া আমাদের কোন আন্দোলন থেকে পিছু হটাতে পারেনি। চিকিৎসক তথা জনতার দাবি আদায়ে মিলন ও আমরা ছিলাম নির্ভীক। নয় বছরের স্বৈরশাসনে সবার ন্যায় চিকিৎসকরাও দুঃশাসনে অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে। তার সঙ্গে গণবিরোধী স্বাস্থ্যনীতি চাপিয়ে দেয়া হলে সরাসরি সরকারবিরোধী আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়া ছাড়া আমাদের কোন গত্যন্তর ছিল না। ১৯৯০ সালের ২৭ জুলাই বিশেষ বার্ষিক সাধারণ সভায় সকল চিকিৎসক পদত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নেন। মঞ্চ থেকে বাইরে এসে দাঁড়িয়ে কথা বলছি আমি আর মিলন। ওই সময় বিএমএ নেতাদের বিবিসিতে সাক্ষাতকার গ্রহণ করে টেলিফোনে। আমার যে সাক্ষাতকারটি ১৯৯০ সালের ২৭ জুলাই রাতে বিবিসিতে প্রচার হয় তাতে ডাঃ মিলন পাশে থেকে বিভিন্ন বিষয়ে বলতে সাহায্য করেছিল। সেদিন আমাকে বলা তার একটি কথা আজও মনে ভাসে তা হলো- ‘বলুন আমরা দাবি আদায়ে মৃত্যুকেও ভয় পাই না।’ সত্যি এমন নির্ভীক দেশপ্রেমের অকুতোভয় বীর খুব কমই জন্ম নেয়। বিএমএ কার্যক্রমে মিলন সর্বদাই অবদান রাখার চেষ্টা করেছেন। বিএমএ-তে প্রতিনিয়ত হাজির থেকে দূর-দূরান্ত থেকে আগত চিকিৎসকদের সঙ্গে সর্বদা হাস্যোজ্জ্বল সদালাপি ছিলেন ডাঃ মিলন। ২৭ নবেম্বর ’৯০ তৎকালীন পিজি হাসপাতালে (বর্তমান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ^বিদ্যালয়) সরকারবিরোধী সমাবেশে যোগ দিতে গিয়ে টিএসসির গোল চত্বরে স্বৈরাচারের ভাড়াটে গু-াদের হাতে নির্মমভাবে শহীদ হন ডাঃ মিলন। চিকিৎসক মিলনের রক্তে ৬ ডিসেম্বর স্বৈরাচারী এরশাদ শাহীর পতন ত্বরান্বিত হয়। বিএমএ প্রেসিডেন্ট অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির উপদেষ্টা নিযুক্ত হন। বিএমএ হয়ে উঠবে চিকিৎসক সমাজের আশ্রয়স্থল-সামনের দিকে পথ চলার কাণ্ডারি। জনগণের দোরগোড়ায় স্বাস্থ্য ব্যবস্থা পৌঁছানোসহ বর্তমান সরকার প্রায় ১২ হাজার চিকিৎসকের নিয়োগদান ও পাঁচ হাজার চিকিৎসককে পদোন্নতি দিয়ে আমাদের অনেক দাবি পূরণ করেছে। স্বাস্থ্য ব্যবস্থাসহ দেশের মানুষের ভাগ্যের আমূল পরিবর্তন ও উন্নয়ন সাধনে বিএমএর ব্যাপক ভূমিকা রয়েছে। দেশে জঙ্গীবাদ ও সাম্প্রদায়িক শক্তির উত্থান এবং গণতন্ত্রের নামে মানুষ পুড়িয়ে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড যেভাবে পরিচালিত হয়েছে, তা গণতন্ত্র ধ্বংস করে তৃতীয় শক্তির উত্থানের অপচেষ্টা বলে মনে হয়েছে। সাংবিধানিকভাবে নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্র রক্ষার ক্ষেত্রে বাঙালী জাতিকে ৯০-এর মতো ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে যাবার শপথ নিতে হবে। স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকার আলবদর ও তাদের দোসর ও রাজনৈতিক দলগুলোকে বর্জন করে বাংলাদেশকে উন্নয়নের মহাসড়কে এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে চিকিৎসকগণ অতীতের মতো ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করে যাবে এটাই এবারের মিলন দিবসের শপথ হোক। লেখক : প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ^বিদ্যালয় ও সাবেক মহাসচিব, বিএমএ
×