ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

আবুল মাল আবদুল মুহিত

সুদীর্ঘ ষাট বছরের বিচিত্র কর্মজীবন

প্রকাশিত: ০৩:৪৫, ২৭ নভেম্বর ২০১৬

সুদীর্ঘ ষাট বছরের বিচিত্র কর্মজীবন

চতুর্থ অধ্যায় মহামান্য ব্রিটিশ রানী এলিজাবেথের বাংলাদেশ সফর এবং বাংলাদেশে রবীন্দ্র শতবার্ষিকী উৎসব উদ্্যাপন (গতকালের পর) ১৯৬১ সালে বাংলাদেশে রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ তার প্রথম সফরে আসেন। আবার এই বছরই সারাদেশে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মশতবার্ষিকী পালিত হয়। আমার জীবনে এই বছরটি ছিল গুরুত্বপূর্ণ। এই বছরে আমার বিয়ে হয় আমারই পছন্দের কনে সাবিয়া বেগমের সঙ্গে। এই বছরটি শুরু হওয়ার ৬ মাস আগে আমি পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানীতে সচিবালয়ে চাকরি করতে শুরু করি। আমার দায়িত্ব সম্বন্ধে আগেই বলেছি যে, সরকারের প্রটোকল বিভাগের দায়িত্বটি একান্তভাবেই আমার ওপর ছিল। ১৯৬১ সালের শুরুতে আমাদের দেশে বিলাতের রানী এবং কমনওয়েলথের প্রধান মহামান্য রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ দুই দিনের জন্য পূর্ব পাকিস্তান ভ্রমণে আসেন এবং প্রটোকল কর্মকর্তা হিসেবে আমি এই উপলক্ষে বিশেষ অভিজ্ঞতা আহরণ করি। রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ আরেকবার বাংলাদেশে ভ্রমণ করতে আসেন ১৯৮২ সালে এবং সেবার তার সঙ্গে আমার পুনঃপরিচয় হয় বাংলাদেশ সরকারের অর্থ ও পরিকল্পনামন্ত্রী হিসেবে। রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের সঙ্গে যারা ১৯৮২ সালে আসেন তাদের মধ্যে মাত্র একজন ছিলেন আমার পূর্ব পরিচিত। বিলেতের রানীর পাকিস্তান ভ্রমণের প্রায় ৬ মাস আগে ব্রিটিশ সরকারের একটি প্রতিনিধি দল এই ভ্রমণের প্রস্তুতিতে আমাদের সহায়তা করার জন্য আগমন করে। তাদের সঙ্গে আমরা রানীর থাকা, চলাফেরা, খাওয়া-দাওয়া এবং তার সম্মানে যেসব অনুষ্ঠান হবে সেসব নিয়ে আলোচনা করি। এই আলোচনায় কেন্দ্রীয় সরকার থেকে আসেন পাকিস্তানের চীফ প্রটোকল কর্মকর্তা এয়ার কমোডর আবদুর রব এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন বাঙালী উপসচিব মোহাম্মদ সেলিমুজ্জামান। এছাড়া হয়ত কয়েকজন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা ছিলেন। তাদের সঙ্গে আমাদের আলোচনা হয় পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যসচিব পর্যায়ে এবং তখন মুখ্যসচিব ছিলেন মোহাম্মদ আজফর (যিনি সরাসরি আমার বড়কর্তা ছিলেন)। এই ভ্রমণসূচী প্রণয়নে তদানীন্তন প্রাদেশিক লাট বাহাদুর লেফটেন্যান্ট জেনারেল মোহাম্মদ আজম খান বিশেষ গুরুত্ব দেন এবং নিজেই প্রতি বিষয়ে খোঁজখবর রাখেন। তিনি ১৯৬০ সালে কোন এক সময় খুলনা ভ্রমণে যান এবং তার বক্তৃতার বাংলা অনুবাদ আমিই করি এবং সেই কারণে তার সঙ্গে আমার সম্মুখ পরিচয় ছিল। রানী এলিজাবেথের ভ্রমণ উপলক্ষে সেই পরিচয় গভীর হয় এবং আমার মনে হয় সেই পরিচয়ের ফলেই তিনি পরবর্তীকালে আমাকে তার উপসচিব নিয়োগ করেন, যে দায়িত্ব আমি তার পদত্যাগ পর্যন্ত পালন করি। আগন্তুকরা প্রথমেই জানতে এবং দেখতে চাইলেন যে, রানীকে কোথায় রাখা হবে। তার পরে তারা দেখতে চাইলেন, কি রাস্তা দিয়ে রানীকে ঢাকা এবং চট্টগ্রাম বিমানবন্দর থেকে তার থাকবার অথবা অন্যান্য অনুষ্ঠান পালনের জায়গাগুলোতে নেয়া হবে। তারা বিশেষ করে রানীর আগমন-নির্গমন এবং অবস্থানের বিষয়ে নিশ্চিত হতে চাইলেন। তারা ইতোমধ্যেই রানীর খাওয়া-দাওয়া সম্বন্ধে আমাদের তথ্য সরবরাহ করেছিলেন। সেই তথ্যের মধ্যে রানীর প্রিয় পানীয়ের কথাও উল্লেখ ছিল এবং তার পছন্দের পানীয়টি ছিল শেরী। রানীর জন্য দুটি বাড়ি নির্ধারণ করা ছিল। একটি ছিল বেইলি রোডের মোড়ে এবং অন্যটি ছিল হেয়ার রোডে। বেইলি রোডের বাড়ি তখন প্রায় পরিত্যক্ত ছিল এবং এটাকে পুনর্নির্মাণের চিন্তা-ভাবনা চলছিল। আগন্তুকরা এই বাড়িটিই পছন্দ করলেন এবং বাড়িতে রানীর জন্য কি কি করতে হবে তারও একটি ধারণা দিলেন। এই বাড়িটি বর্তমানে সুগন্ধা নামে পরিচিত এবং এইটি হচ্ছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মচারীদের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। এটা কিছুদিনের জন্য ছিল বাংলাদেশের জনক ও প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের দফতর। সেই হিসেবে বাড়িটিকে একটি জাদুঘরে পরিবর্তন করে এখান থেকে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থানান্তর করা উচিত বলে আমি মনে করি। আগন্তুকরা জানালেন যে, দোতলায় পাশাপাশি দুটি সংযুক্ত বেডরুমের ব্যবস্থা করতে হবে। রানীর বাড়িতে আরও ২-১ জনের থাকার ব্যবস্থাও করতে হবে। যেসব অতিথি রানীর বাড়িতে মোলাকাতে বা অন্য কার্যোপলক্ষে আসবেন তাদের জন্য নিচ তলায় ব্যবস্থা রাখতে হবে। বাড়িটির বাগান তাদের পছন্দ হয় এবং সেটিকে ভাল অবস্থায় রাখার জন্য তারা অনুরোধ করেন। তাদের পরামর্শমতো বাড়িটি পুনর্নির্মিত হয় এবং তার সাজসজ্জাও এমনভাবে করা হয় যাতে রানী সন্তুষ্ট হতে পারেন। এই সাজসজ্জার ব্যবস্থা করতে আমাদের পূর্ত বিভাগের প্রধান প্রকৌশলী মোঃ হাবিবুর রহমান দায়িত্ব নিতে দ্বিধান্বিত ছিলেন। সেই দায়িত্বটা সাগ্রহে নিলেন বাংলাদেশ পানি ও বিদ্যুত উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান খান আজমের ইংরাজ পতœী। আমার মতে বাড়িটি খুবই ভালভাবে আমাদের প্রকৌশলী এবং মিস্ত্রিরা নির্মাণ করেন এবং বাগানটিও সুসজ্জিত হয়। বাড়ির অভ্যন্তরীণ সাজসজ্জা বেগম আজমের তত্ত্বাবধানে সম্পন্ন হয় এবং সেখানে অত্যধিক খরচ হয়। এই ভ্রমণ উপলক্ষে যে বিশেষ বাজেটটি প্রণয়ন এবং বাস্তবায়ন করা হয় সেইটি আমারই দায়িত্বে ছিল। দুটি মহানগরে ভ্রমণের জন্য মোট খরচের হিসাব ছিল ৮ লাখ টাকা; এই বাজেটের অতিরিক্ত আরও ৩ লাখ টাকা লাগে। চলবে...
×