ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০৮ মে ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪৩১

ড. আর এম দেবনাথ

সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে সরকার ক্ষতিগ্রস্ত নয়

প্রকাশিত: ০৪:৪৮, ২৫ নভেম্বর ২০১৬

সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে সরকার ক্ষতিগ্রস্ত নয়

আমরা জানি সরকার ঋণ করে এবং তা প্রতিবছরই করে। এ নিয়ে দেশে বড় বেশি বিতর্ক নেই। কিন্তু বিতর্ক হয় ঋণের উৎস নিয়ে। অর্থাৎ কোন্ সূত্র থেকে সরকারের ঋণ নেয়া উচিত, আর কোন্ উৎস থেকে নেয়া উচিত নয় তা নিয়ে বিতর্ক হয় প্রায়শই। যেমন এই মুহূর্তে আবার বিতর্ক উঠেছে সরকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে কেন ঋণ নেবে যখন ব্যাংক ঋণ অনেক সস্তা। তুলনামূলকভাবে সঞ্চয়পত্রের সুদ এই মুহূর্তে অনেক বেশি। এতে সরকারের সুদের বোঝা বাড়ছে ক্রমাগত। এই বিতর্ক বেশ কিছুদিন ধরেই চলছে। কিন্তু এক সময় ছিল ব্যাংক ঋণের সুদ অনেক বেশি। তখন কথা ওঠেনি। ব্যাংক ঋণে সুদের হার হ্রাস হতে শুরু করার পর থেকেই আবার বিতর্ক উঠেছে এবং বিতর্কের হাত ধরে ইতোমধ্যে অন্তত দুই দফায় সঞ্চয়পত্রের ওপর সুদের হার কমানো হয়েছে। বসানো হয়েছে উৎসে কর, যা সুদ প্রদানকালেই কেটে রাখা হয়। বর্তমানে সঞ্চয়পত্রের ওপর সুদের হার অনেক কম। তারপরও আবার বিতর্কের জন্ম দেয়া হচ্ছে। মাঝে মাঝে এতে সরকারী কর্মকর্তারা তাদের মতামত দিয়ে বিষয়টিকে আরও জটিল করে ফেলেন। আবার মন্ত্রী বাহাদুররাও এই বিতর্কে অংশ নেন এবং বলেন সঞ্চয়পত্রের ওপর সুদ বেশি, ব্যাংক ঋণে সুদ কম। অতএব সরকারের ঋণের এবং সুদের বোঝা কমানোর জন্য সঞ্চয়পত্র নিরুৎসাহিত করা উচিত। দেখা যায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উপদেষ্টা জাতীয় কিছু লোক সঞ্চয়পত্র সম্পর্কে নানা কথা বলেন এবং তারা দেন এমন সব তথ্য যা বলাই বাহুল্য অত্যন্ত একপেশে। অতএব দেখা দরকার সত্যি সত্যি ব্যাংক ঋণ সস্তা কিনা। এর জন্য জানা দরকার বর্তমানে ব্যাংক কত সুদে ঋণ দেয়। গত ২০ নবেম্বরের কাগজে যে তথ্য দেয়া হয়েছে তাতে দেখা যাচ্ছে ব্যাংকের ‘ওয়েটেড এভারেজ লেন্ডিং ইন্টারেস্ট’ রেট ছিল সেপ্টেম্বরে ১০ দশমিক ১৫ শতাংশ। অবশ্য এ বছরের জানুয়ারি মাসে এই ভাগিত গড় সুদের হার ছিল কিছুটা বেশি। ২০১৬ সালের জানুয়ারি মাসে সুদের হারের পরিমাণ ছিল ১১ দশমিক ০৫ শতাংশ। এর বিপরীতে বিভিন্ন প্রকার সঞ্চয়পত্রের ওপর প্রদত্ত সুদের হার কত? আমার কাছে কাগজে প্রকাশিত যে তথ্য আছে তাতে দেখা যায় পরিবার সঞ্চয়পত্রে (৫ বছর মেয়াদী) সুদের হার ১১ দশমিক ৫২ শতাংশ। পাঁচ বছর মেয়াদী পেনশনার সঞ্চয়পত্রে সুদের হার ১১ দশমিক ৭৬ শতাংশ। পাঁচ বছর মেয়াদী সঞ্চয়পত্রে সুদের হার ১১ দশমিক ২৮ শতাংশ। আর তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্রে সুদের হার ১১ দশমিক ০৪ শতাংশ। দেখা যাচ্ছে সুদের হার ১১ দশমিক ০৪ শতাংশ থেকে সর্বোচ্চ ১১ দশমিক ৭৬ শতাংশ পর্যন্ত বিস্তৃত। আর একটি বাদে সবগুলোর মেয়াদ ৫ বছর। কেবল একটি সঞ্চয়পত্রের মেয়াদ তিন বছর, যার জন্য তার ওপর সুদের হারও কিছুটা কম (১১.০৪ শতাংশ)। এবার তুলনা করলে কী দাঁড়ায়? মনে কী হয় যে, ব্যাংকের ঋণে সুদের হার কম। মোটেই নয়। দৃশ্যত সঞ্চয়পত্রে সুদের হার কিছুটা বেশি হলেও প্রকৃতপক্ষে তা বেশি নয়। এর কারণ? সঞ্চয়পত্র দীর্ঘমেয়াদী। তিন বছর থেকে ৫ বছর এদের মেয়াদ। কেবল প্রকল্প ঋণ ছাড়া বাকি সব ঋণ স্বল্পমেয়াদী। তাছাড়া ব্যাংক যে কোন সময় যে কোন গ্রাহককে ঋণের টাকা ফেরত দিতে বলতে পারে। এটা ঋণের চুক্তিতেই থাকে। বাজারের নিয়ম হচ্ছে যে, ঋণের মেয়াদ বেশি হবে, তার ওপর সুদের হার বেশি হবে। কারণ, তার তারল্য বা লিক্যুইডিটি কম। ‘আমানত’ (ডিপোজিট) কিন্তু ‘টেকনিকেলি স্পিকিং’ ঋণ। এই ঋণ আমানতকারীরা ব্যাংকগুলোকে দেয়। সেখানেও দেখা যাবে আমানতের মেয়াদ যত বেশি সুদের হার তত বেশি। এর দ্বারা বোঝাতে চাইছি যে, সঞ্চয়পত্রে সুদের হার দৃশ্যত সামান্য বেশি হলেও বর্তমান বাজারদরে প্রকৃতপক্ষে তা বেশি নয়। কারণ, সঞ্চয়পত্রের মেয়াদ বেশি অর্থাৎ এর ‘লিক্যুইডিটি’ বা তারল্য কম। সঞ্চয়পত্রের ঋণ সরকার যখন তখন ফেরত দেয় না। কেউ যদি বিপদে পড়ে সঞ্চয়পত্র ভাঙ্গায় তাহলে তাকে ‘দ-ি’ দিতে হয়। জরিমানা হিসেবে সরকার বেশ পরিমাণ টাকা কেটে রাখে। অথচ ব্যাংক ঋণের টাকা কেউ অগ্রিম ফেরত দিতে চাইলে জরিমানা নয়, ব্যাংক বরং সেই গ্রাহককে সাধুবাদ জানাবে। এছাড়া ব্যাংক ঋণে ‘জামানত’ দিতে হয়। ‘জামানাত’ কম বলে সুদের হার বেশি হতে পারে। কিন্তু ‘সঞ্চয়পত্র’ কিনে সাধারণ মানুষ সরকারকে যে ঋণ দিচ্ছে তাতে কোন ‘জামানত’ সরকারকে দিতে হয় না। মানুষ সরকারকে অনেক বেশি বিশ্বাস করে, বেসরকারী খাতের তুলনায়। এমতাবস্থায় প্রশ্ন: ব্যাংকের ঋণ সস্তা কোথায়? সঞ্চয়পত্রের সুদ এবং ব্যাংক ঋণের সুদ যদি একই থাকে তাহলে কেন বলা হচ্ছে ব্যাংক ঋণ সস্তা, সঞ্চয়পত্রের দাম বেশি। যা হওয়া উচিত তার কথাই ওপরে বললাম। কিন্তু সরকার সব সময় উচিত কাজ করে না। যেমন সরকার সাধারণ মানুষের জমি অধিগ্রহণ করে; কিন্তু ন্যায্যমূল্য দেয় না। যে কাজে জমি নেয়া হয় সেই কাজে তা ব্যবহার করা হয় না। অধিগ্রহণকৃত জমি ধনীদের মধ্যে প্লট হিসেবে বিক্রি করে নগণ্য মূল্যে। এসব উচিত কাজ নয়। তবুও সরকার করে। সরকার সরকারী জমি, সম্পত্তি, শিল্প ও কলকারখানা এবং সম্পদ অল্প দামে তার পোষ্যদের মধ্যে বিতরণ করে। এটাও ন্যায্য কাজ নয়। তবুও সরকার করে। অথচ মানুষের কিছু করার থাকে না। কারণ, সরকারকে ধরা যায় না, ছোঁয়া যায় না, সরকার অদৃশ্য; অথচ সরকার যে আছে তা হাড়ে হাড়ে টের পাওয়া যায়। তার হাত লম্বা, ভীষণ লম্বা। এ কারণেই সরকার তার মালিকানাধীন ব্যাংকগুলো থেকে ঋণ নেয় সস্তায়। অর্থাৎ ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিরা যে সুদে ব্যাংক ঋণ নেয় সরকার নেয় তার অনেক কমে। বলার কেউ নেই, কারণ ব্যাংকের মালিকও সরকার। এর ওপর ভিত্তি করেই কিছু লোক, মিডিয়ার একাংশ বলছে যে, ব্যাংক ঋণ সস্তা। সরকারী ব্যাংকের সুদ বেশি। এটা আংশিক সত্য। যেমন বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন। সরকারী ব্যাংক থেকে ঋণ নিল বাণিজ্যিক সুদ হারে। তারা সেই টাকা দিতে পারছে না। সরকার সেই ঋণ শোধ করল বন্ড মারফত ঋণ নিয়ে। এই বন্ডের সুদ খুবই কম। বাণিজ্যিক সুদের হারের চেয়ে অনেক অনেক কম। ‘পাটকল সংস্থার’ ঋণের ক্ষেত্রেও তাই। সরকার সরকারী ব্যাংকগুলো থেকে নানাভাবে ঋণ নেয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রকাশনা থেকে দেখা যাচ্ছে ব্যাংক থেকে সরকার ঋণ নেয় কমপক্ষে আঠারো ধরনের। বিল, বন্ড ইত্যাদি নাম। উদ্দেশ্য নানা প্রকার। নানা নাম হলে কী হবে, সুদের হার গড়ে ৬-৭ শতাংশের বেশি নয়। আবার কিছু ঋণ আছে যেগুলো সরকারী ব্যাংকগুলোকে সরকারকে দিতেই হয়’। তাদের সুদের হার দু-তিন শতাংশের বেশি নয়। এসব কারণে কেউ যদি বলে সরকারের জন্য ব্যাংক ঋণ সস্তা, সঞ্চয়পত্রের ঋণ ব্যয়বহুল তাহলে তাকে বেশি দোষ দেয়া যাবে না। তবে কথা আছে। সবকিছুই বিচার করতে হয় সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা নিয়ে। প্রথম কথা সরকারী ব্যাংকগুলোর যদি বিকল্প থাকত, ব্যাংকগুলোর যদি ক্ষমতা থাকত তাহলে তারা কম সুদে সরকারকে ঋণ দিত না। কারণ, এতে তারা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বস্তুত তারা ক্ষতিগ্রস্ত হয় না। ক্ষতিগ্রস্ত হয় শেষ অবধি আমানতকারীরা। তারা আমানতের ওপর কম সুদ পায়। কারণ, ব্যাংকগুলো সরকারকে ঋণ দেয়ার ফলে তাদের যথেষ্ট আয় থাকে না, যা তারা আমানতকারীদের দিতে পারে। এই অর্থ সরকার ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়ার ফলে আমানতকারীরা ন্যায্য আয় হতে বঞ্চিত হয়। এদিকে আমানতকারীদের অনেকেই কিন্তু সঞ্চয়পত্র কেনে। সেখানে দৃশ্যত কিছুটা সুদ যে বেশি পায় তা আরেক অর্থে ক্ষতিপূরণ। যে ক্ষতি তার ব্যাংকে হলো সেই ক্ষতি সঞ্চয়পত্রে পুষিয়ে দিল সরকার। এতে বোঝা যায় সরকারের লাভ-লোকসান নেই। সরকার যে লাভ করল ব্যাংক ঋণে কম সুদ দিয়ে সেই লাভ দিয়ে সঞ্চয়পত্রে বেশি সুদ দিল। এভাবে দেখাটা কিন্তু খুবই যৌক্তিক। মুশকিল হচ্ছে অনেকেই বিষয়টিকে সামগ্রিক দৃষ্টিতে দেখতে চায় না। তাদের দৃষ্টি অনেকটা হিসাবরক্ষকের মতো, চার্টার্ড এ্যাকাউন্টেন্টের (মিত্র) মতো। হিসাবরক্ষকদের কাছে ফিন্যান্সিয়াল প্রফিটই বড় কথা। তাদের মাথায় স্যোশাল প্রফিট বলতে কিছু নেই। আর্থিক ক্ষতি হতে পারে; কিন্তু সামগ্রিক লাভ হলে যে রাষ্ট্রের ও সমাজের অগ্রগতি হয় তা এ্যাকাউন্টেন্টরা বুঝতে চায় না। দুঃখের বিষয়, দেশের ভেতরে যেমন কিছু লোক আছে যারা সামাজিক লাভপ্রদতার বিষয়টি বুঝতে চায় না। তেমনি বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ-এও এসব লোকে ভর্তি। তারাও মনে হয় একেকজন এ্যাকাউন্টেন্ট। এ কারণেই দুদিন পর পর সঞ্চয়পত্র নিয়ে বিতর্ক তোলা হয়। ইতোমধ্যেই এই সুন্দর সঞ্চয় মাধ্যমের যথেষ্ট ক্ষতি করা হয়েছে। বিদেশীদের পরামর্শেই এবং দেশীয় এক শ্রেণীর ব্যবসায়ী ও ব্যাংকারের পরামর্শে দুদিন পরপর সরকার উত্তেজিত হয়ে ওঠে। বলে সঞ্চয়পত্রের সুদের হার পুনর্বিবেচনাধীন। শুনেছি, প্রধানমন্ত্রী দেশে সঞ্চয়াভ্যাস গড়ে উঠুক তা চান। নারীর ক্ষমতায়নের জন্য তিনি পরিবার সঞ্চয়পত্র করেছেন। একে সম্প্রসারিত করে এই সঞ্চয়পত্র বুড়ারা যাতে কিনতে পারে তার ব্যবস্থা করেছেন। কিন্তু এটা অনেকের সহ্য হয় না। তারা যুক্তিহীনভাবে সুদের হারের কথা তুলে বয়স্ক মানুষ, নারী, অবসরপ্রাপ্ত লোকজন, মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের মধ্যে অশান্তি সৃষ্টি করতে চায়। পুঁটি মাছের কেজি যে চার-পাঁচ শ’ টাকা তা তারা আমলে নিতে চায় না। তারা চায় না উপরোক্ত শ্রেণীর লোক বাজারে যাক। এতে ভোগের স্তর নিচে নামুক, জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার কমুক তাতে তাদের কিছুই যায় আসে না। লেখক : সাবেক শিক্ষক, ঢাবি
×