ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মোঃ সাখাওয়াত হোসেন

রাজনীতি ও নারী ভবিষ্যত বাংলাদেশ

প্রকাশিত: ০৬:৪১, ১৮ নভেম্বর ২০১৬

রাজনীতি ও নারী ভবিষ্যত বাংলাদেশ

(পূর্ব প্রকাশের পর) তবে বর্তমানে রাজনীতিতে জড়িত এমন কয়েক জনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারা নারীদের সক্রিয় অংশগ্রহণের ব্যাপারে খুবই আশাবাদী। উদাহরণ টেনে তারা আরও উল্লেখ করেন, ক্রমান্বয়ে স্থানীয় এবং জাতীয় পর্যায়ের রাজনীতিতে নারীদের অংশগ্রহণ আশাব্যঞ্জক। প্রত্যেকটি থানা পর্যায়ে নারীদের সমন্বয়ে পূর্ণাঙ্গ কমিটি রয়েছে এবং তারা তাদের কাজের মাধ্যমে স্বতঃস্ফূর্তভাবে উপস্থিতি জানান দিচ্ছে। মহিলা নেত্রীরা জোরের সঙ্গে আরও উল্লেখ করেন, দলের দুঃসময়ে পুরুষের তুলনায় নারীরা রক্ষণশীল ভূমিকা পালন করেন। তাদের বিশ্বাস দল তাদের কাজের মূল্যায়ন করবে যথাসময়ে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিম-লে নারীদের অংশগ্রহণ পুরুষের তুলনায় তুলনামূলকভাবে অনেক কম, কেন কম এর উত্তর খুঁজতে গিয়ে কয়েকটি বিষয় সামনে চলে আসে। যেমন, পারিবারিকভাবে রাজনীতিতে মেয়েদের নিরুৎসাহিত করা হয়, তাছাড়া তৃণমূল পর্যায়ে রাজনীতি করার মতো সুষ্ঠু পরিবেশ এখনও সেভাবে তৈরি হয়নি। পারিবারিকভাবে সমাজে মেয়েদের মুক্ত চলাচলে বিধিনিষেধের মাধ্যমে পুরুষের কর্তৃত্ব বজায় রাখার চেষ্টায় একটি মহল সবসময় কাজ করে যাচ্ছে। সালিশ, বিচারে মেয়েদেরকে অংশগ্রহণ করতে দেওয়া হয় না, যেন নারীদের মধ্যে নেতৃত্বগুণ বিকশিত হতে না পারে। তাছাড়া, বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি নারীদেরকে রাজনীতির ক্ষেত্রে কোণঠাসা করে রাখে। কেননা, বাংলাদেশের রাজনীতিতে ক্রমান্বয়ে যে সহিংসতার ঘটনা ঘটে যাচ্ছে, সে ক্ষেত্রে রাজনীতির মাঠে নারীদের অংশগ্রহণ যথেষ্ট ঝুঁকিপূর্ণ এবং অভিভাবকদের জন্য পীড়াদায়কও বটে। গ্রামগঞ্জে এখনও বদ্ধমূল ধারণা প্রতিষ্ঠিত নারীরা ঘরসংসারের কাজের সঙ্গে জড়িত থাকবে, বাড়ির বাইরের কাজ কেবল পুরুষের। যদিও বর্তমানে অনেক নারীরা চাকরিতে যোগদান করে পরিবারের আয়ে ভূমিকা রাখছে বটে, কিন্তু রাজনীতিতে নারীদের মুখ্যভাবে অংশগ্রহণ এখনও আলোচনার বিষয়। স্থানীয় এবং তৃণমূল পর্যায়ে নারীদের নেতৃত্বকে আরও সুসংগঠিত করার জন্য সরকার ১৯৯৭ সালে দ্বিতীয় সংশোধনীর মাধ্যমে ইউনিয়ন পরিষদে আইন প্রণয়নের ফলে এক-তৃতীয়াংশ আসন নারীদের জন্য সংরক্ষিত করে যা প্রত্যক্ষ ভোটের ভিত্তিতে জনপ্রতিনিধি বাছাইয়ের বিষয়টি নির্ধারণ করে। স্থানীয় পর্যায়ে নারীদেরকে রাজনীতির মাঠে নিয়ে আসার জন্য সরকারের এ পদক্ষেপ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। ইউনিয়ন পর্যায়ে দেখা যায়, কেবলমাত্র সংরক্ষিত আসনেই নারী নির্বাচিত হয়, অন্যান্য আসনে পুরুষেরা অধিকাংশই নির্বাচিত হয়। আবার সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে নারী সদস্যদেরকেও সেভাবে মূল্যায়ন করা হয় না, অথবা মূল্যায়নের যৌক্তিকতা নারীরা সেভাবে উপস্থাপন করতে পারছেন না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে, সংরক্ষিত আসনের নির্বাচিত নারীরা উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত নয়, তা ছাড়া স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী পরিবার থেকেও নারীরা এ পর্যায়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছেন না। তাই সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে ইউনিয়ন পরিষদের অন্যান্য মেম্বার এবং চেয়ারম্যান থেকে অনেক সময় নিগ্রহের শিকার হয়ে থাকেন নারীরা। তাই স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ওয়ার্ড পর্যায়ের মেম্বার পদে নারীদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের জন্য নারীদেরকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। তবে রাজনীতির পেছনে নারীদের সহায়তা প্রদান অনেক সময়ই আলোচনার সূত্রপাত ঘটিয়েছে। বরেণ্য রাজনীতিকরা তাদের সফলতার পিছনে স্ত্রীদের ভূমিকার কথা বহু জায়গায় উল্লেখ করেছেন। দক্ষিণ আফ্রিকার কিংবদন্তি নেলসন ম্যান্ডেলার স্ত্রী উইনি ম্যান্ডেলা স্বামীর সঙ্গে বহু বছর জেলজুলুম খেটেছেন। ভারতে কস্তরবা গান্ধী তার স্বামী মাহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে আমৃত্যু ছায়ার মতো লেগে ছিলেন। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জনক শেখ মুজিবুর রহমান তার ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ তে তার স্ত্রী শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিবের অবদানের কথা বহুবার উল্লেখ করেছেন। পূর্বে রাজনীতি ছিল দেশের আপামর জনসাধারণের জন্য, জনকল্যাণের জন্য, উন্নয়নের জন্য, কিন্তু বর্তমানে রাজনীতির ধরন ও প্রকৃতি পরিবর্তিত হয়েছে। তৎকালীন নেতাদের হরহামেশাই জেলজুলুম খাটতে হয়েছে, নানা রকমের নিপীড়ন, নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে। সে সময়ে তাদের স্ত্রীরা তাদেরকে মানসিক সমর্থন দিয়ে পরবর্তী আন্দোলনের জন্য উদ্বেলিত করেছেন। সুতরাং রাজনীতির মাঠে নারীদের পরোক্ষ অবদানের সফলতা দৃষ্টান্তস্বরূপ। আমাদের দেশে প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে নারীরা অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করেছেন। যদিও সংখ্যানুপাতে পুরুষের তুলনায় নগণ্য। বাংলাদেশের রাজনীতিতে ১৯৯১ সালের পর থেকে অদ্যাবধি প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন নারী এবং এ সময়ে বাংলাদেশ বহু সাফল্য লাভ করেছে। ঐ সরকারের আমল থেকে প্রত্যেক শাসনামলেই নারী মন্ত্রীও ছিল, যদিও প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে নারী সদস্য ছিল কম। কেবলমাত্র তৃণমূল পর্যায়ে নারীদের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ হলেই বাংলাদেশের রাজনীতির দীর্ঘমেয়াদী সুফলতা আনয়ন সম্ভবপর হবে। পরিশেষে বলা যায়, সরকারের একার পক্ষে সকল সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়, পাশাপাশি সব শ্রেণীর মানুষকে এ ব্যাপারে জনউদ্যোগ গড়ে তুলতে হবে। বিশেষ করে নারীদেরকে এ বিষয়ে আরও জোরালো উদ্যোগ নিতে হবে ব্যক্তিগত স্বার্থে। যে সকল নারীরা জাতীয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণের সুযোগ পায় তাদেরকে জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্তায়ন থেকে জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে নিজেদের গ্রহণযোগ্যতা উপস্থাপন করতে হবে, যে বিষয়টি পরবর্তীতে রাজনীতিতে অন্য নারীদের অংশগ্রহণের সুযোগকে আরও বিকশিত করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। সামাজিকভাবে নারীদের রাজনীতিতে অংশগ্রহণের বিষয়টিকে ইতিবাচকভাবে উপস্থাপন করতে হবে। রাজনীতিতে নারীদের অংশগ্রহণের প্রয়োজনীয়তা শীর্ষক সভা, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, আলোকচিত্র প্রদর্শনী এবং আলোচনা সভার মাধ্যমে এ বিষয়ে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। রাজনীতিকে নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করা থেকে বিরত থাকতে হবে, সুষ্ঠু রাজনীতির চর্চার বিকাশ ঘটাতে হবে। মেধাবীদের রাজনীতিতে আসতে উৎসাহিত করতে হবে, কমিটি প্রণয়নের ক্ষেত্রে যোগ্যতা ও মেধার ভিত্তিতে নারী ও পুরুষের অংশগ্রহণের সমতা নিশ্চিত করতে হবে। লেখক : গবেষক ও সাংবাদিক
×