ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মুহম্মদ শফিকুর রহমান

ট্রাম্প ইজ নট মাই প্রেসিডেন্ট...

প্রকাশিত: ০৪:১৫, ১২ নভেম্বর ২০১৬

ট্রাম্প ইজ নট মাই প্রেসিডেন্ট...

বেচারা ট্রাম্প। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েও শান্তিতে আছেন বলে মনে হয় না। বিজয়ী ঘোষণার মুহূর্ত থেকেই রাজধানী ওয়াশিংটন, হলিউড-সিলিকনভ্যালি খ্যাত ক্যালিফোর্নিয়া কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়-নগরী পিটার্সবার্গসহ দেশটির পূর্ব থেকে পশ্চিম এবং দক্ষিণ থেকে উত্তর প্রান্ত সর্বত্র বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে। হাজার হাজার তরুণ-তরুণী, যুবা-বৃদ্ধ ‘ট্রাম্প ইজ নট মাই প্রেসিডেন্ট... ইজ নট আওয়ার প্রেসিডেন্ট’ লেখা প্ল্যাকার্ড হাতে সেøøাগান দিতে দিতে রাজপথ জনপথ উত্তপ্ত করে চলেছে অব্যাহতভাবে। নিউইয়র্কের ম্যানহাটনে ট্রাম্প-টাওয়ারের সামনে বৃহস্পতিবার রাত পর্যন্ত বিক্ষোভ চলছিল। বিক্ষোভকারীরা ডোনান্ড ট্রাম্পের অফিস লক্ষ্য করে ঢিল ছুড়ছিল। কোন কোন স্থানে গুলিও হয়েছে। গ্রেফতার হয়েছে অনেক। কিছুতেই ট্রাম্পকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে মেনে নিতে পারছে না আন্দোলনকারীরা। যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম বৃহৎ এবং গুরুত্বপূর্ণ স্টেট ক্যালিফোর্নিয়া যুক্তরাষ্ট্র থেকে বেরিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। বিশ্লেষণ করলে সহজেই প্রশ্ন করা যায়, এ ঘোষণা ‘স্বাধীনতার’ ঘোষণা নয়ত? ট্রাম্প সামলাতে পারবেন? কিংবা এর পরিণতি কি হবে? এসব প্রশ্নের উত্তরের ভাষা হবে কি, সেজন্য আরও ঊনসত্তর দিন অপেক্ষা করতে হবে। অর্থাৎ আগামী ২০ জানুয়ারি বারাক ওবামার ক্ষমতা হস্তান্তর পর্যন্ত। ভাষা বোঝার জন্য হয়ত আরও অনেকদিন, অনেক বছর লাগবে। হয়ত এ ভাষা হবে বাংলাদেশ, আফগান, ইরাক, সিরিয়ার প্রতিশোধের। ॥ দুই ॥ যেসব বিষয় যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের একটা অংশকে আহত করেছে তা হলোÑ প্রথমত ট্রাম্পের রুচিহীন, নারীলোভী, নারীবিদ্বেষী, জুয়া ব্যবসায়ী এবং নৈতিকতাবিবর্জিত চরিত্র। নির্বাচনী ক্যাম্পেনে ট্রাম্প যেসব উগ্রবাদী কথাবার্তা বলেছেন, অধিকাংশ বক্তব্যই ছিল বর্ণবাদীদের মতো, নারী সমাজের প্রতি তার সামান্যতম শ্রদ্ধাবোধও যে নেই এসব কেউ মেনে নিতে পারছে না। ধরে নেয়া হবে ওরা হিলারি সমর্থক এবং ধরে নেয়াটাও হবে বোকামি এবং তারপরও পরিস্থিতি সামলানো দুষ্কর হবে। ডোনাল্ড ট্রাম্প কি কি বলেছিলেনÑ ক. মুসলিম অভিবাসীদের যুক্তরাষ্ট্র থেকে বের করে দেবেন। খ. নারী সুন্দরী হলে তাকে নিয়ে যা ইচ্ছা খেলা করা যায়। গ. ওবামা কেয়ার বাতিলসহ স্বাস্থ্যনীতি পরিবর্তন। এই তিনটি বক্তব্যের দিকে তাকালে প্রথম বক্তব্যটি উগ্রজাতীয়তাবাদী এবং এটি আমেরিকায় বসবাসকারী কোন নন-আমেরিকানের (নন হোয়াইট) জন্য হুমকিস্বরূপ, যা কেবল অভিবাসী নয়, বাংলাদেশী-আমেরিকান, ইন্ডিয়ান-আমেরিকান, এশিয়ান-আমেরিকান বা আফ্রিকান-আমেরিকান প্রত্যেককে আতঙ্কিত করে তুলেছে। ওবামা কেয়ার নামের স্বাস্থ্যনীতিতে আমেরিকার সাধারণ নাগরিক-অভিবাসী প্রত্যেকে উপকৃত হতেন। এটি বাতিল করা হলে তারা ওই সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবেন। দ্বিতীয় বক্তব্যটি সভ্যসমাজে কোন ভদ্র সন্তান উচ্চারণ করতে পারে না। ট্রাম্প তো আমেরিকার মতো সো-কলড সভ্য দেশের প্রেসিডেন্ট। যে কথার প্রেক্ষিতে সিনিয়র বুশের পতœী লরা বুশ পর্যন্ত বলেছেন, ‘কোন নারী ট্রাম্পকে ভোট দিতে পারে না’। কিন্তু তারপরও বলতে হবে আমেরিকার নাগরিকরাই তাকে ভোট দিয়ে প্রেসিডেন্ট বানিয়েছে। ক্যু করে প্রেসিডেন্ট হননি। আরও ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হলোÑ এ জাতীয় অশোভন-অশ্লীল বক্তব্য দেয়ায় তার দল রিপাবলিকান পার্টির বড় বড় নেতা তার পক্ষে ভোট করেননি। সেদিক থেকে বলা যায় ডোনাল্ড ট্রাম্প দলবিহীন একক নেতা হিসেবে নির্বাচনে লড়েছেন এবং জয়লাভ করেছেন। বলা যায় ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের ২৪০ বছরের ইতিহাসে প্রথম অরাজনৈতিক প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট। এটি একটি বিস্ময়, যে বিস্ময় আমেরিকাকে অনেক নিচে নামিয়ে দিয়েছে। আমেরিকার সভ্যতা, মানবিক মূল্যবোধকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। অথচ এর আগে সামান্য নৈতিকতার প্রশ্নে কেনেডি পরিবারের সন্তান এডওয়ার্ড কেনেডি দলীয় ডেমোক্র্যাট মনোনয়ন পাননি। ট্রাম্প কেবল মনোনয়ন লাভ করেই থেমে থাকেননি, ভোটও পেয়েছেন বাক্স ভরে। যেমন শ্বেতাঙ্গ নারীদের ভোট ঢালাওভাবে পড়েছে ট্রাম্পের পক্ষে। প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, রক্ষণশীল মার্কিন নারীদের ৭৮ শতাংশই ট্রাম্পকে ভোট দিয়েছেন। ৪৫ থেকে ৬৪ বছর বয়সী নারীদের ৫৮ শতাংশ ভোট দিয়েছেন ট্রাম্পকে। শুধু কি তাই, ট্রাম্পের সঙ্গে সঙ্গে সিনেট এবং হাউস অব রিপ্রেজেনটেটিভেও রিপাবলিকানরা নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে। বলা চলে ট্রাম্প হোয়াইট আমেরিকান, বিশেষ করে হোয়াইট আমেরিকান নারীদের সামনে এক ভীতিকর পরিস্থিতি তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছিলেন। তার বক্তব্য যতই অশ্লীল হোক, নারীবিদ্বেষী হোক, অভিবাসীবিদ্বেষী হোক, ট্রাম্প তো প্রথম থেকেই শেষ পর্যন্ত সাহসী হিরোর মতো বলে গেছেন। মার্কিনীরা মনে করেছে ‘এই ভদ্রলোক যা বলছে বিশ্বাস থেকেই বলছে এবং এই ভদ্রলোক তা বাস্তবায়ন করতে সক্ষম।’ একটি ঘটনা মনে পড়ে গেল। একবার আওয়ামী লীগ সমর্থক ছাত্রলীগের প্রার্থী হিসেবে ডাকসুতে ভিপি হলেন সুলতান মুহম্মদ মনসুর। তার সমর্থক রোকেয়া হলের ছাত্রীরা একটি বিজয় মিছিল বের করল আর্টস ফ্যাকাল্টিতে। ছাত্রীদের মিছিলটি রোকেয়া হলের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় ছাত্রদলের কর্মীরা তাদের ওপর হামলা চালায় এবং প্রকাশ্যে দিবালোকে ছাত্রীদের মাটিতে শুইয়ে অপমান করল, নির্যাতন চালাল। পরে যখন হল সংসদ নির্বাচন হলো দেখা গেল ছাত্রদলই জয়লাভ করেছে। সেদিন ওই ছাত্রীদের বক্তব্য ছিলÑ অন্যরা তো তাদের প্রোটেকশন দিতে পারেনি, পারছে না। তাই ছাত্রদলকেই তারা ভোট দিয়েছে। নয়ত আজ রাজপথে অপমান করেছে, কাল হলে ঢুকে করবে। ॥ তিন ॥ তবে আমেরিকার নির্বাচনোত্তর সহিংসতায় বাংলাদেশে বিএনপি-জামায়াত জোট উল্লসিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে। জোটটি ফলাফলে হতাশ হলেও হিলারিপন্থী তরুণদের সহিংস বিক্ষোভ তাদের সামান্য হলেও স্বস্তি দেবে। বাংলাদেশে আমার মতো বেশিরভাগ নাগরিকই হিলারিকে পছন্দ করে। কারণ হিলারি ভদ্র, শিক্ষিতা, অভিজ্ঞ এবং অভিজাত। সম্ভবত এসব গুণই তার কাল হয়েছে। খালেদা জিয়ার মনমানসিকতা, উগ্রতা বিচারে ডোনাল্ড ট্রাম্পকেই সমর্থন করার কথা ছিল। তা না করে সমর্থন করলেন হিলারি রডহাম ক্লিনটনকে। কেন করলেন? এর প্রধান ও মূল কারণ হলো বিএনপি-জামায়াত ঘরানার রাজনৈতিক কর্র্মীরা মনে করে বাঙালী নোবেল লরেট প্রফেসর ড. ইউনূস হিলারির ব্যক্তিগত বন্ধু। যে কারণে শোনা যায় প্রফেসর ইউনূস হিলারির ইলেকশন ফান্ডে অনেক টাকা দিয়েছেন। প্রফেসর ইউনূস বিএনপিপন্থী হিসেবে তারা মনে করে। অর্থাৎ হিলারি নির্বাচিত হলে প্রফেসর ইউনূসকে বাংলাদেশে ক্ষমতার আসনে বসিয়ে দেবেন। সেই সুবাদে খালেদা জিয়া তার সঙ্গে ক্ষমতা শেয়ার করবেন। প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতি হবেন। মা-বেটা দুর্নীতিমুক্ত হবেন, তারেক বীরবেশে দেশে ফিরবেন, শেখ হাসিনাকে জেলে পুরে প্রতিশোধ নেবেন, আওয়ামী লীগসহ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিগুলোকে রাষ্ট্রক্ষমতা থেকে ঝেটিয়ে বিদায় করবেন। আগাম প্রতিনিধি পাঠালেন আমেরিকায়। তারা হিলারির সঙ্গে দেখা করলেন। হিলারিকে শাড়ি পরিয়ে খালেদা জিয়ার পাশে দাঁড় করিয়ে সেলফোনে স্ট্যাটাস দিলেন। কিন্তু স্বপ্ন স্বপ্নই রয়ে গেল। হিলারি পরাজিত হলেন, প্রফেসর ইউনূসও আর ক্ষমতার নাগাল পেলেন না, খালেদা জিয়াও তথৈবচ। মনে পড়ে কয়েক বছর আগের কথা। ভারতের জাতীয় নির্বাচন। রব উঠল শ্রী নরেন্দ্রনাথ মোদির নেতৃত্বাধীন বিজেপি জিতে যাচ্ছে। ক্ষমতার একেবারেই কাছাকাছি। বাংলাদেশেও খালেদা-নিজামী ঘরানায় উল্লাস, মিষ্টি খাওয়ার ছড়াছড়ি। নির্বাচনে কংগ্রেস কুপোকাত। আওয়ামী লীগকে আর কে বাঁচাবে? ভাবখানা তখন কংগ্রেস আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় বসিয়েছে, এবার বিজেপি তাদের হটিয়ে বিএনপি-জামায়াত জোটকে ক্ষমতা বসাবে। কিন্তু সব ভেস্তে গেল নরেন্দ্র মোদির বিজয় সমাবেশের বক্তৃতায়। বক্তৃতায় তিনি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি শ্রদ্ধা জানালেন। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় (১৯৭১) তিনি ছাত্র দিলেন এবং গুজরাটে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে মিছিলে নেতৃত্ব দিয়েছেন। বললেন, এখন বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনা অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে বাংলাদেশকে উন্নয়নের মহাসড়কে এগিয়ে নিয়ে চলেছেন। আমরা একসঙ্গে কাজ করব। ব্যস, ধুতি খুলে ফেলে ফিরে এলেন। এবারের বিষয়টি একই। ॥ চার ॥ আমেরিকার নির্বাচন, সরকার গঠন এসব প্রশ্নে বাংলাদেশ অবশ্যই কনসার্ন। আজ তারা আমাদের উন্নয়ন সহযোগী বন্ধু দেশ। কিন্তু ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে আমেরিকার পাকিস্তান পক্ষ অবলম্বন এবং ‘বাংলার মাটি তামা করার জন্য সপ্তম নৌবহর প্রেরণে’র কথা আমরা ভুলিনি। ভারত, রাশিয়া প্রভৃতি বন্ধু দেশ আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছিল। আমরা জয়লাভ করার পরও দীর্ঘদিন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়নি আমেরিকা। বরং সেদিনের সেক্রেটারি অব স্টেট হেনরি কিসিঞ্জার ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন- ঞযব ঊসবৎমবহপব ড়ভ ইধহমষধফবংয রং সু ঢ়বৎংড়হধষ ফবভবধঃ. অবশ্য সেদিনও আমেরিকার সচেতন নাগরিকরা আমাদের সমর্থন করেছে। সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি, বব ডিলন, জোয়ান ব্যোজ, জর্জ হ্যারিসনের মতো সেলিব্রেটিরা আমাদের পক্ষে কাজ করেছেন, বিশ্ব জনমত গঠনে সহায়তা করেছেন। জোয়ান ব্যোজের ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’ সুদীর্ঘ কবিতাটি, যা ছিল শরণার্থীদের সুখ-দুঃখের মহাকাব্য। পরবর্তীতে যা বাংলায় অনূদিত হয়ে গান হয়েছে, যে গান শুনলে আজও আপনা আপনি চোখের জল পড়বে। আজকের আমেরিকাও পদ্মা সেতু নিয়ে বিশ্বব্যাঙ্ককে দিয়ে অনেক খেলা খেলেছে। আবার এখন উন্নয়নের সহযোগী হিসেবে সম্পর্ক রিফেয়ার করেছে। তাছাড়া আমেরিকা বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ও শক্তিশালী দেশ। দেশটি সবার জন্যই কনসার্ন। আমাদের জন্যও। তবে সুখের কথা হলো, ডোনাল্ড ট্রাম্প নির্বাচনের আগে উগ্রজাতীয়তাবাদ উস্কালেও তার ভিকট্রি-র‌্যালিতে বলেছেন, ‘সকলকে নিয়ে গ্রেট আমেরিকা গড়বেন’। নির্বাচনের আগে তার ঘোষণা অনুযায়ী হিলারিকে জেলে পাঠানোর কথাও বলেননি। তার মনে কি আছে জানার কথা নয়। তবে ভদ্রলোক যে চরিত্রের তাতে আমেরিকার শিক্ষিত-অভিজাত জনগোষ্ঠীর জন্য এবং মুসলিম আমেরিকান ও কালো আমেরিকানদের দুশ্চিন্তা সহজে যাবে না। ঢাকা : ১১ নবেম্বর ২০১৬ লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও সভাপতি, জাতীয় প্রেসক্লাব নধষরংংযধভরয়@মসধরষ.পড়স
×