ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

সাজু আহমেদ

ক্ষমতার পালাবদলের উপাখ্যান মর্ষকাম

প্রকাশিত: ০৬:২৮, ১০ নভেম্বর ২০১৬

ক্ষমতার পালাবদলের উপাখ্যান মর্ষকাম

বাংলাদেশের নাট্য আন্দোলনের ইতিহাসে এসএম সোলায়মান অবিস্মরণীয় একটি নাম। গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলন তথা সামগ্রিক সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অন্যতম এই পুরোধার প্রতিষ্ঠিত নাট্যদল থিয়েটার আর্ট ইউনিট। অকাল প্রয়াত এই নাট্যজনের ঐতিহ্য স্বগৌরবে ধরে রেখেছে দলের কর্মীরা। দলে এখনও মঞ্চস্থ হয় তার নির্দেশিত একাধিক নাটক। নাট্য আন্দোলনের অন্যতম এই পথিকৃতের পরবর্তী প্রযোজনাগুলোও সমৃদ্ধ হয়েছে তার যোগ্য উত্তরসূরিদের নিরন্তর প্রচেষ্টায়। বিশেষ করে তারই সহধর্মিণী রোকেয়া রফিক বেবির তার আগলে রাখা দলটি এখনও বাংলাদেশের নাট্য আন্দোলনে নানা মাত্রিকতায় নানা নিরীক্ষায় ভূমিকা রাখছে। দলের বিভিন্ন প্রযোজনায় নাট্য আঙ্গিক নিয়ে নিরীক্ষক এসএম সোলায়মানের কর্মকা-ের ছাপ পাওয়া যায়। যেমন দেখা গেল সম্প্রতি মঞ্চে আসা তাদের নতুন প্রযোজনা ‘মর্ষকাম’ নাটকে। বরাবরই বৈচিত্র্যময় এবং লোকজ গল্পের নান্দনিক উপস্থাপনা থিয়েটার আর্ট ইউনিটের প্রযোজনাগুলোর অন্যতম বৈশিষ্ট। তবে এবার এই দল তাদের নতুন প্রযোজনায় এনেছে বিশ্বমাত্রিকতা। নাটকের বিষয়বস্তু শুধু নয় বরং নাট্য উপস্থাপনার ক্ষেত্রে নিরীক্ষা দর্শকদের সহজেই আকৃষ্ট করেছে। ১ নবেম্বর জাতীয় নাট্যাশালার প্রধান মিলনায়তন তাই দর্শকে পরিপূর্ণ হয়েছিল। দলের কর্মীরাও ঢেলে দিয়েছেন তাদের নাট্যাভিনয়, নির্মাণের আঙ্গিক, উপস্থাপনার চমৎকারিত্বের নিরন্তর প্রচেষ্টায়। তবে প্রথম প্রদর্শনীর এত বড় আয়োজনে অসঙ্গতি থাকাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। বিশেষ করে আমাদের নিজস্ব নাট্য আঙ্গিক আবারও অনুপস্থিত এই নাটকে। অবশ্য সেটা মেনে নিয়েছেন দর্শক সারিতে বসা, নাসির উদ্দিন ইউসুফ, সৈয়দ জামিল আহমেদসহ বিশিষ্টজনেরা। নাটক শেষে অনুভূতি ব্যাক্তের সময় সেটাও বললেন তারা পাশাপাশি এসএম সোলায়মানের কন্যা ও এ নাটকের নাট্যকার আনিকা মাহিন একার জন্য আশীর্বাদও করলেন। থিয়েটার আর্ট ইউনিটের ১৯তম প্রযোজনা ‘মর্ষকাম’ নাটকের উপস্থাপনা, সেট, আলো, গণহত্যার চিত্রায়নে প্রজেকশনের ব্যবহার নিয়ে প্রশংসায় ভাসালেন। ভবিষ্যতে সমৃদ্ধ প্রযোজনার প্রত্যাশা করলেন সংশ্লিষ্টরা। নাটকের নির্দেশক ও নাট্যকার মা-মেয়ে, এসএম সোলায়মানের যোগ্য উত্তরসূরি। এ কারণে নতুন নাটকটি নিয়ে নাট্যকর্মী তো বটেই সাধারণ দর্শক যারা নাটক বিষয়ে খোঁজখবর রাখেন তাদের মধ্যেও বিশেষ আগ্রহ তৈরি হয়। সময়ের প্রয়োজনে আধুনিক নাট্যে মঞ্চ ও উপস্থাপনাশৈলিতে নতুনত্ব দাবি রাখে। নাটকে তিনটি পৃথক সমান্তরাল অঙ্কের কোলাজ ‘মর্ষকাম’। কালে কালে ক্ষমতার পালাবদল ঘটেছে বিশ্ব রাজনীতিতে। সেই পালাবদলে বার বার অশান্ত ও সহিংস হয়েছে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট। ক্ষমতার পালাবদলের সেই কাহিনীকে উপজীব্য করে নির্মিত হয়েছে নাটক ‘মর্ষকাম’। নাটকের কাহিনীতে অনিবার্যভাবে উঠে এসেছে, ইতিহাসের পরিক্রমায় বার বার ক্ষমতার হাতবদলের চিত্র। ঠিক যেমনভাবে হয়ে আসছে ক্ষমতা ও শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ও বিপ্লব। কিন্তু ‘মর্ষকাম’ ইতিহাসে বার বার সংঘটিত বিপ্লবের গাঁথা নয়, বরং ক্ষমতার সেই পালাবদলের উপাখ্যান যা বিশ্বময় ধ্বংস করে চলেছে বিপ্লবের নব অঙ্কুরিত বীজ। নাটকে দৃশ্যের অন্তরালে রয়ে যায় বিপ্লবের জয়গাথা, আর বার বার দৃশ্যমান হয় ক্ষমতার পালাবদলের পটভূমি। মর্ষকাম একটি তিন অঙ্কের নাটক। তিনটি পৃথক অঙ্কে চক্রাকারে পুনরাবৃত হয় একই নাটক, তিনটি ভিন্ন রূপে। চলতে থাকে রাজনীতি ও ক্ষমতার খেলা- যার একমাত্র নিয়ন্ত্রক কোন এক অদৃশ্য পরাশক্তির প্রতিনিধি ‘মিস্টার এক্স’। এ খেলা দমন ও নিয়ন্ত্রণের। এ খেলা মর্ষকামের। বার বার প্রতিরোধ গড়ে ওঠে, পরিবর্তিত হয় পুরনো রাজনৈতিক দৃশ্যপট আর সূচনা হয় নতুন রাজনৈতিক পটভূমির কোন এক ভিন্ন স্থানে, ভিন্ন আঙ্গিকে। কিন্তু অবসান হয় না সেই পুরনো রাজনৈতিক ক্রিয়ার, সেই আদি ও অকৃত্রিম খেলার। আধুনিক থিয়েটারের চরম উৎকর্ষতার যুগে থিয়েটার আর্ট ইউনিটের নতুন প্রযোজনা ‘মর্ষকাম’ অনেকটাই সার্বজনীনতার ইঙ্গিত দেয়। মানবতার মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠা ও জয়গান নাটকের প্রাণ।
×