ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মোস্তাফা জব্বার

একুশ শতক ॥ ৫ বিলিয়ন ডলার রফতানির লক্ষ্যে

প্রকাশিত: ০৩:৩৯, ৩০ অক্টোবর ২০১৬

একুশ শতক ॥ ৫ বিলিয়ন ডলার রফতানির লক্ষ্যে

॥ দুুই ॥ আমাদের লক্ষ্য ১৮ সালে ১ বিলিয়ন এবং ২১ সালে ৫ বিলিয়ন রফতানি বিধায়- এই লক্ষ্য অর্জনে খুব সংক্ষেপে সাধারণত কি কি পদক্ষেপ নেয়া দরকার তার দিকে তাকানো যেতে পারে। মানবসম্পদ, অবকাঠামো, বিনিয়োগ, অভ্যন্তরীণ বাজার ও প্রণোদনা : বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তিকে আন্তর্জাতিক বাজারে স্থান করে নিতে হলে আমাদের উচিত হবে জনবল তৈরি ছাড়াও দেশীয় আইটি প্রতিষ্ঠানগুলোকে সঠিক প্রণোদনা প্রদান এবং তাদের সংরক্ষণে পলিসিগত পরিবর্তন আনা। দেশের বৃহত্তম তথ্যপ্রযুক্তির বাণিজ্য সংগঠন হিসেবে বেসিসের সৌভাগ্য হয়েছে দেশের আইটি কোম্পানির ব্যবসার প্রবৃদ্ধি ও প্রসারণের স্বার্থে কাজ করার। তাই দেশীয় আইটি কোম্পানিগুলো এবং সমগ্র আইটি খাত কি কি সমস্যার মুখোমুখি হয় তা বেসিস ছাড়া আর কারও জানা নাও থাকতে পারে। দেশীয় আইটি কোম্পানিগুলো রফতানিতে বেশকিছু সমস্যার মুখোমুখি হয়, যেমন : বহির্বিশ্বে প্রচারণার জন্য বাংলাদেশের দূতাবাসে আইসিটি রফতানি ডেস্ক : আমাদের রফতানি বাজার আছে তেমন দেশগুলোতে আমাদের রফতানি যে তথ্যপ্রযুক্তি সেই বিষয়টি তুলে ধরার জন্য প্রয়োজন সেসব দেশে আলাদাভাবে গড়ে তোলা আইসিটি রফতানি ডেস্ক। এভাবে বেসিস সদস্যভুক্ত কোম্পানিগুলো যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা এবং অস্ট্রেলিয়ায় বাজার সম্প্রসারণ করতে পারে। এছাড়া অনেকেই মধ্যপ্রাচ্য, ডেনমার্ক, জার্মানিসহ বিভিন্ন ইউরোপিয়ান দেশে এবং জাপান, সিঙ্গাপুরসহ বিভিন্ন এশিয়ান দেশে সফটয়্যার এবং আইসিটি রফতানি করে থাকে। আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের সঙ্গে সম্পর্ক বৃদ্ধিতে এই দেশগুলোতে বাংলাদেশের দূতাবাসে আইটি ডেস্ক স্থাপন করা যেতে পারে। ঘটনাচক্রে বিদেশে আমাদের দূতাবাসগুলো এই সম্পর্কে সচেতন নয়। দেশের আইটি রফতানি বৃদ্ধিতে এসব দেশের দূতাবাসগুলোকে পুরোপুরি সক্রিয় করা প্রয়োজন। অবকাঠামো : দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়নের গতি বৃদ্ধি করা অতীব জরুরী হয়ে পড়েছে। আমরা হাইটেক পার্ক জাতীয় অবকাঠামো গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সরকারের ব্যাপক তৎপরতা দেখতে পাচ্ছি। আশা করি হাইটেক পার্ক গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সরকারের উদ্যোগের ওপর আমাদের ভরসা রাখা যাবে। কিন্তু যে সড়ক দিয়ে তথ্যপ্রযুক্তি প্রবাহিত হবে তার অবস্থা নাজুক। বর্তমানে দেশে ইন্টারনেটের অবস্থা মোটেই ভাল নয়। দেশে থ্রিজির ইন্টারনেটের গতি নেই বলা যায়। ইন্টারনেটের ক্রয়মূল্যও মোটেই যুক্তিসঙ্গত নয়। ফলে একদিকে আমার দেশীয় ব্যবহারকারীর সক্ষমতা বাড়ছে না- অন্যদিকে ক্যাবল ইন্টারনেটের বাইরে আমরা রফতানি বা আইসিটির কাজ সম্প্রসারিত করতে পারছি না। সরকার ক্যাবল সংযোগ সম্প্রসারণ করার চেষ্টা করলেও বেতার সংযোগ ও তার গতি ভয়ঙ্করতম খারাপ। দেশে ইন্টারনেট সংযোগ আরও সুলভ হওয়া উচিত। ঢাকার বাইরে দ্রুতগতির ইন্টারনেট প্রয়োজন। এছাড়া নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুত সরবরাহ এবং আইটি কোম্পানিগুলোর জন্য সুলভে জায়গা বরাদ্দ দেয়া দরকার। দেশীয় আইটি কোম্পানিগুলোতে বিনিয়োগের জন্য পর্যাপ্ত তহবিল গঠন করা আবশ্যক। বেসিস থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে ২০০ কোটি টাকার বিশেষ তহবিল বরাদ্দের আবেদন জানানো হয়েছিল যা এখনও স্থবির হয়ে আছে। ইইএফ তহবিলেরও একই অবস্থা। বছরের পর বছর ইইএফ আবেদন বন্ধ রয়েছে। মেধাসম্পত্তির মূল্যের সঠিক নির্ধারক না থাকায় বেসরকারী ব্যাংকগুলোর মধ্যে একমাত্র আইডিএলসি বাদে আর কেউই আইটি কোম্পানিকে ঋণ দেয় না। এর বরাদ্দকৃত মাত্র ৪৩ কোটি টাকা আইটি কোম্পানিগুলোর রফতানির সক্ষমতা তৈরিতে পর্যাপ্ত নয়। মেধাসম্পদের নির্ধারক এবং পরিচালনের সঠিক অবকাঠামো তৈরি এখন সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে। আইসিটি খাতের বিনিয়োগ গড়ে তোলার জন্য সাধারণ ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগ ছাড়াও ভেঞ্চার ক্যাপিটাল সংস্থাগুলোর বিস্তার ঘটাতে হবে। শিক্ষার রূপান্তর : প্রচলিত শিক্ষার রূপান্তর ঘটাতে হবে। শিক্ষার্থীদের বিশ্ববিদ্যালয়ে যা শেখানো হয়, এবং আইসিটি খাতে আসলে যে ধরনের দক্ষতার প্রয়োজন তাতে বিস্তর ব্যবধান রয়েছে। যে কারণে আইসিটির স্নাতকরা পরবর্তী প্রশিক্ষণ ছাড়া চাকরি পাচ্ছে না। সরকার এবং বেসিস প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। কিন্তু এসব প্রশিক্ষণ প্রবেশ স্তরের চাকরির জন্য উপযোগী। মধ্যস্তরের আইটি পেশাদারদের জন্য উপযোগী কোন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র এখনও গড়ে উঠেনি। ওপরের বিষয়গুলো ছাড়াও ৫ বিলিয়ন ডলার লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছাতে হলে আরও প্রয়োজন- নগদ প্রণোদনা : দেশের রফতানি বাণিজ্যকে উৎসাহিত করতে সরকার মোট ২০টি খাতে উল্লেখযোগ্য হারে রফতানি ভর্তুকি/নগদ সহায়তা প্রদান করে। এক বস্ত্রখাতেই ব্যবসায়ীরা অন্য আরও অনেক ধরনের প্রণোদনার পাশাপাশি বিভিন্ন রফতানি ভর্তুকি পাচ্ছে। জাহাজ রফতানির মতো তুলনামূলক নতুন শিল্পেও আকর্ষণীয় রফতানি ভর্তুকি প্রদান করা হয়েছে। দেশে উৎপাদিত আন্তর্জাতিক বাজারে চাহিদা রয়েছে এমন সব নিত্যনতুন পণ্য কয়েক বছর ধরে যোগ হচ্ছে রফতানি খাতে। সরকারের এরূপ বিভিন্ন সহায়তায় দেশের তৈরি পোশাক শিল্প, চামড়াজাত দ্রব্য, পাটজাত দ্রব্যসহ বিভিন্ন খাত রফতানিতে অনেক এগিয়েছে। অস্বীকার করার উপায় নেই যে, পোশাক শিল্পের আজকের এই অবস্থানের পেছনে সরকারের অবদান ছিল। প্রাথমিক অবস্থা থেকে এই শিল্পে সরকারী বিভিন্ন প্রণোদনা এবং ভর্তুকির ব্যবস্থা করা হয়েছে এবং তিন দশক পরেও সরকার বিভিন্ন প্রণোদনা ও ভর্তুকি দিয়ে যাচ্ছে। আইটি রফতানিকে উৎসাহিত করার জন্য পৃথিবীর বহু দেশে নির্দিষ্টহারে প্রণোদনা দিয়ে থাকে। ৫ বিলিয়ন ডলার রফতানি লক্ষ্যে পৌঁছাতে হলে দেশের এই উদীয়মান আইসিটি খাতেও রফতানি ভর্তুকি প্রদান করা উচিত। এই প্রণোদনা শতকরা ৫ ভাগ হবে নাকি ২০ ভাগ হবে সেটি আলোচনাসাপেক্ষ হলেও এর বিকল্প কিছু নেই। বিদ্যমান রফতানি ভর্তুকির তালিকা ভ্যাট রহিতকরণ : তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর সেবায় ট্যাক্স রহিতকরণ ২০২৪ সাল পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়েছে, তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর সেবার ওপর প্রযোজ্য ভ্যাট ৪৫ থেকে কমিয়ে শূন্য শতাংশ করা ও আইটিইএস কোম্পানির জন্য বাড়িভাড়ার ওপর থেকে ৯ ভ্যাট সম্পূর্ণরূপে প্রত্যাহার করা আবশ্যিক। রাষ্ট্রীয় ভাড়ায় অফিস স্পেস : নতুন আইটি কোম্পানিগুলোর বিনিয়োগ সমস্যা সমাধানে সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্কে এক বছরের জন্য বিনামূল্যে জায়গা বরাদ্দ দেয়া উচিত। ইতোমধ্যে দেশের প্রথম সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করেছে। আইসিটি বিভাগের উদ্যোগে যশোর টেকনোলজি পার্ক, গাজীপুরের কালিয়াকৈর হাইটেক পার্ক বাস্তবায়নের কার্যক্রম এগিয়ে চলেছে। এছাড়া মহাখালী আইটি ভিলেজ, বরেন্দ্র সিলিকন সিটি রাজশাহী, ইলেক্ট্রনিক সিটি সিলেট, চন্দ্রদীপ ক্লাউড চর, চুয়েট আইটি বিজনেস ইনকিউবেটর বাস্তবায়নের কাজ চলছে। এরূপ আরও বেশকিছু স্টার্টআপ ইউকিউবেটর তৈরি করে তাতে বিনামূল্যে অথবা কম মূল্যে জায়গা ভাড়া দিলে নতুন আইটি কোম্পানিগুলো রফতানিতে অবদান রাখতে পারবে। বিদেশী আইটি মেলায় অংশগ্রহণে আর্থিক প্রণোদনা : বিদেশী ক্রেতা আকর্ষণে ও দেশী সফটওয়্যার এবং আইটিইএসের সক্ষমতা সম্পর্কে জানাতে বিদেশী আইটি মেলায় অংশগ্রহণ জরুরী। কিন্তু এসব মেলায় অংশগ্রহণের খরচ এবং যাতায়াত ভাড়া মিলিয়ে বিশাল অঙ্কের টাকা দেয়ার সামর্থ্য অনেক কোম্পানির-ই নেই। সরকারের কাছ থেকে এক্ষেত্রে আর্থিক সহায়তা প্রয়োজন। বিটুবি : বিদেশী ক্রেতাদের সঙ্গে দেশী আইটি কোম্পানির বিটুবি ম্যাচমেকিং মিটিং আইটি কোম্পানিগুলোর ব্যবসায় উন্নতি ও উন্নয়ন আনতে সহায়তা করবে। দেশে ও বিদেশে এ ধরনের মিটিং আয়োজন কোম্পানিগুলোকে সরাসরি বিদেশী ক্রেতা পেতে সাহায্য করবে এবং রফতানি বৃদ্ধিতে সরাসরি অবদান রাখবে। রফতানি শ্রেণীবিন্যস্তকরণ : দেশের আইটি কোম্পানিগুলো যারা রফতানি করে থাকে তাদের চিহ্নিতকরণ এবং রফতানি অনুযায়ী শ্রেণিবিভক্ত করা প্রয়োজন। কারা কি ধরনের পণ্য রফতানি করে তা জানা থাকলে রফতানি বৃদ্ধিতে তাদের সহায়তা করা যাবে। রফতানি নির্দেশিকা : দেশের রফতানিকারক আইটি প্রতিষ্ঠানের একটি এক্সপোর্ট ডিরেক্টরি তৈরি করা যেখানে তাদের নাম, যোগাযোগের ঠিকানা এবং কি কি পণ্য ও সেবা প্রদানে তারা সক্ষম লেখা থাকবে। এই এক্সপোর্ট ডিরেক্টরি বিদেশী ক্রেতাদের মধ্যে প্রচার করা হবে। দেশের আইটি পণ্য ও প্রতিষ্ঠান নিয়ে ব্র্যান্ডিংয়ের অভাব রয়েছে। এ বিষয়ে আরও কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে হবে। ফ্রি-ল্যান্সার নির্দেশিকা : ফ্রি-ল্যান্সারদের জন্য একটি নির্দেশিকা প্রয়োজন যাতে নতুন ফ্রিল্যান্সাররা সহজেই এই পেশায় নিজেকে নিয়োজিত করতে পারে। সেমিনার-কর্মশালা : রফতানি সমস্যা নিয়ে বিভিন্ন কর্মশালা ও সেমিনার আয়োজন করা দরকার। এছাড়াও রফতানিভিত্তিক প্রশিক্ষণ দিয়ে দেশের আইটি কোম্পানিগুলোকে রফতানির জন্য প্রস্তুত করা আবশ্যক। অভ্যন্তরীণ বাজার : অনেকের কাছে এটি মনে হতে পারে যে রফতানি করার স্বপ্ন দেখতে গিয়ে আমরা দেশের ভেতরের বাজারের কথা বলছি কেন? বাস্তবতা হলো রফতানি বাজারে প্রবেশের জন্য আমার নিজের দেশের বাজারে কাজ করার অভিজ্ঞতা বা সফলতার ভিতটা তৈরি করতে হবে। ফলে আমি সরকারের সকল কাজ দেশীয় সফটওয়্যার ও সেবা খাতের প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে করানোর অনুরোধ করি। এটির একটি বাড়তি সুবিধা হচ্ছে যে এর ফলে আমাদের বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রাও সাশ্রয় হবে। সার্বিকভাবে আমি মনে করি বাংলাদেশ সফটওয়্যার বা তথ্যপ্রযুক্তি সেবা খাতে রফতানির কাজ করার জন্য পুরোপুরিই প্রস্তুত। বলা যেতে পারে আমরা এখন টেকঅফ স্তরে রয়েছি। আমাদের উচিত হবে এখন সকল শক্তি একত্রিত করে টেকঅফ করা। তাতে ১ বিলিয়ন বা ৫ বিলিয়ন নয় দেশের বৃহত্তম রফতানি খাত হিসেবে গড়ে ওঠা সবচেয়ে বড় সম্ভাবনা। ঢাকা, ২৮ অক্টোবর, ২০১৬ লেখক : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাস-এর চেয়ারম্যান, বিজয় কীবোর্ড ও সফটওয়্যারের জনক ॥ [email protected] w.bijoyekushe.net, ww w.bijoydigital.com
×