ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

খোকন তালুকদার

সৃজনশীল আড্ডাবাজি

প্রকাশিত: ০৬:২৮, ২৪ অক্টোবর ২০১৬

সৃজনশীল আড্ডাবাজি

আজকের এই কর্পোরেট ভুবনে আবেগের কোন মূল্য নেই। শুধু অর্থ, যশ আর প্রতিপত্তির পিছে লাগামহীনভাবে ছুটছে সবাই।অনেক ক্ষেত্রে আজ আবেগশূন্য এই পারস্পরিক সম্পর্ক। নতুন করে কি ঘরোয়া আড্ডা আমরা আবার কিছুটা ফিরে পেতে পারি না! কফি হাউসের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই, কোথায় হারিয়ে গেল সোনালি বিকেলগুলো সেই’। না, ইচ্ছা করলেই কিন্তু আমরা সেই পুরনো আড্ডা, সেই পুরনো সংস্কৃতি নতুন করে প্রবর্তিত করতে পারি। নতুনদের কাছে ওয়ান-ডিশ বা শেয়ার-লাঞ্চ করে একটু ভিন্ন আঙ্গিকে ভিন্ন পরিবেশে। কোথাও কোন খোলা-প্রান্তরে, সমুদ্র পাড়ে কিংবা নতুন কোন কফি হাউসে। সবকিছুই যে সংগঠনভিত্তিক, বাণিজ্যিক বা পেশাদারী হতে হবে এমন তো কোন কথা নেই। এসবের বাইরেও কিছু নিঃস্বার্থ বন্ধুত্ব, নিজস্ব এলোমেলো আলাপন, কিছু একান্ত ঘরোয়া আয়োজন থাক না আমাদের চিন্তা, মননে ও মানসিকতায়। পাশ্চাত্য সংস্কৃতির ওয়ান-ডিশ বা শেয়ার-লাঞ্চের ধারণাটা খারাপ নয়। জমিয়ে আড্ডা মারার জন্যই তাদের এ আয়োজন। আড্ডা দিতে হলে আড্ডার জন্যই বসতে হবে। ভূরিভোজের সঙ্গে মিলিয়ে বা গুলিয়ে ফেলা যাবে না। পাশ্চাত্য সংস্কৃতিতে ওয়ান-ডিশ একটা অত্যন্ত স্বাভাবিক ব্যাপার যা আন্তরিকতার প্রকাশ। বাংলা সংস্কৃতিতে আড্ডার ক্ষেত্রে তা উদার মনে গ্রহণ করা দরকার কেননা বিদেশী সব সংস্কৃতিই যে খারাপ তা কিন্তু নয়। আড্ডা বাঙালী মননের একটা অনিবার্য-চাহিদা, বলা যায় আকুতি ও তৃষ্ণা। নিরন্তর এই বাস্তব জীবনে আজ আমরা আড্ডা দেয়ার জন্য যেটুকু সময় খুঁজে বের করি তা শুধু জমা রাখি সপ্তান্তে জন্মদিন কিংবা বিয়ের দাওয়াত এর জন্য। এটা আসলে ভূরিভোজ। একে মোটেই সত্যিকারের আড্ডা বলা যায় না। বিয়ে বা জন্মদিনকে আড্ডা বলা যায় না এ জন্য যে আয়োজনটা ব্যক্তিকেন্দ্রিক বা উপলক্ষভিত্তিক। আড্ডা মানে শিল্প-সাহিত্য, সংস্কৃতি–চর্চার কিংবা যে কোন ঘটনার তুমুল আলোচনা-সমালোচনা। এক কথায় বলা যায় ঘরোয়া শিল্পচর্চা। সভ্যতা, কাল বা সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হয় মানুষকে। ফলে মানুষগুলো হয়ে পরে কর্মব্যস্ত। সময় অতিক্রম করে ক্ষিপ্রতার সঙ্গে, চোখের পলকে। ফলে মানুষের মাঝে দেখা দেয় এক ধরনের যান্ত্রিকতা। যন্ত্রমানবের মতো মানুষগুলো সময় অতিক্রম করে গুনে গুনে দিন থেকে রাত অব্দি। সভ্যতা তখনই আধুনিক হয় যখন মানষ তার আচরণে, কথাবার্তায়, চলাফেরায়, রুচিতে এরং কর্মে আধুনিক হয়। তাই আমাদের এই যান্ত্রিকতার যাঁতাকল থেকে বেরিয়ে আসবে হবে আমাদের প্রয়োজনেই। কর্মব্যস্তার মাঝে থেকেই নিয়ে নিতে হবে মানসিক শান্তি ও তৃপ্তি। আর এই মানসিক শান্তি, তৃপ্তি, মনের পিপাসা এবং জ্ঞানের তৃষ্ণা মিঠাতে পারে আড্ডা। আড্ডার যেমন সার্বজনীনতা রয়েছে তেমনি রয়েছে এর আবশ্যকতা। মানসিক বিকাশের ক্ষেত্রে আড্ডার কোন বিকল্প নেই। জ্ঞানার্জনের ক্ষেত্রেও আড্ডার ভূমিকা বর্ণনাতীত। বলতে গেলে দশটা বই পড়ার চেয়ে দশ মিনিট আড্ডা দেয়া উত্তম। শ্রেষ্ঠ মনীষীদের ক্ষেত্রেও আড্ডার ব্যাপকতা লক্ষ্য করা যায়। প্রমথ চৌধুরী আর রবীন্দ্রনাথ, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আর শক্তি চট্টোপাধ্যায় যেমন আড্ডা পাগল ছিলেন তেমন আড্ডা পাগল হলেন কবির সুমন আর অঞ্জন দত্ত। আড্ডা কখনও একটি বিষয়কে কেন্দ্র করে হয় না। আড্ডায় রয়েছে বহুলতা। রয়েছে সৃষ্টির তৎপরতা। এই বহুলতা বিষয়ে আড্ডা দিতে গিয়ে বহু বিষয়ের অজানা তথ্য জানা হয়। আড্ডা মানববন্ধন অটুট রাখে। পাওয়া যায় মত প্রকাশের সুযোগ। মতের পক্ষান্তরে মতামতও পাওয়া যায়। যা আমাদের ভাবতে শিখায়, সৃজনশীল হতে সাহায্য করে। আড্ডা স্থান বা কালের উর্ধে। মানসিক প্রশান্তি ছাড়াও আড্ডা যান্ত্রিকতা দূর করে একঘেয়ামি ভাব কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করে। এই আড্ডা জমে উঠতে পারে সহকর্মীদের সঙ্গেও। তবে কাজের সময় নয়। সহকর্মীদের সঙ্গে আড্ডা দিলে কর্মদক্ষতা যেমন বাড়ে তেমনি গড়ে উঠে সু-সম্পর্ক। এতে কাজ করার এক উত্তম পরিবেশ তৈরি হয়। কাজের ক্ষেত্রে পাওয়া যায় নানা সহায়তা। তাই সহকর্মীদের সঙ্গে ভাল সম্পর্ক গড়ে তুলতে আড্ডার বিকল্প নেই। বন্ধুদের সঙ্গে বন্ধুত্ব বজায় রাখতে আড্ডা মুখ্য ভূমিকা পালন করে। এতে বন্ধুত্বের বন্ধন আরও গাঢ় হয়। আড্ডায় বন্ধুত্ব হতে পারে আপনার ছোট বড় যে কারও সঙ্গে। বড়দের সঙ্গে আড্ডা দিলে অনেক বিষয়ে জ্ঞান লাভ করা যায়। চিন্তা শক্তির বিকাশ ঘটে। তবে এই ক্ষেত্রে আড্ডা দেয়ার পাত্রটিও চাই যোগ্যতাসম্পন্ন। ব্যক্তিটিকে হতে হবে অনেক বিষয়ে জ্ঞাত। আড্ডা জমে উঠতে পারে আপনার পরিবারেও। পারিবারিক আড্ডায় উঠে আসে পরিবারের নানা সমস্যা। খুঁজে পাওয়া যায় সমাধানের পথ। পারিবারিক আড্ডায় পরিবারের সবার মতো প্রকাশের সুযোগ থাকার ফলে পারিবারিক সম্পর্ক অটুট হয়ে উঠে। পরিবারের সবাই সবাইকে ভালভাবে জানতে পারে, বুঝতে পারে। এছাড়াও আড্ডা মানসিক চাপ কমাতে সহায়তা করে, আত্মোন্নতির বিকাশ ঘটায়। এই আড্ডা মানুষকে বাস্তববাদী হতে সাহায্য করে।
×