ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

স্বপন বড়ুয়া

বৌদ্ধদের অনুভূতিতে প্রবারণা পূর্ণিমা

প্রকাশিত: ০৬:১৬, ১৫ অক্টোবর ২০১৬

বৌদ্ধদের অনুভূতিতে প্রবারণা পূর্ণিমা

‘স্বক্খাতো ভগবতা বুদ্ধা ধম্মো, সন্দিট্ঠিকো, অকালিকো, এহিপস্সিকো, ওপনয়িকো’Ñ ব্যাপক অর্থে বলতে গেলে বিশ্বাস করে নয়; নিজেই সম্যক উপলব্ধি করে যথার্থ হলে গ্রহণ কর। এখানেই গৌতম বুদ্ধের ধর্ম সুপ্রকাশিত। প্রায় ৫২০ খ্রিস্টপূর্বে অবশ্যম্ভাবী রাজাসনের মায়া ছিন্ন করে রাজপুত্র সিদ্ধার্থই প্রথম শ্রেণীচ্যুত মহামানব, যিনি বহুজন হিতায় (বহুজনের হিতার্থে) দীর্ঘদিন নিবিড় ধ্যান-সাধনার পর দৃঢ় সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন যে, প্রতিটি ঘটনায় বা সৃষ্টিতে যথার্থ কারণ নিহিত এবং এতে কোন অদৃশ্য শক্তির হাত নেই। বুদ্ধের দর্শনে এটা পতিত্য সমুৎপাতবাদ (কার্যকারণ নীতি) নামে আখ্যায়িত। তার এই বাস্তববাদী মতাদর্শে কোন সৃষ্টিশীল কর্ম সম্পাদনে কোন বর্ণ, পেশা বা শ্রেণী ভেদাভেদের অবকাশ নেই। সেকালের গোঁড়া ও অন্ধবিশ্বাসে আচ্ছাদিত ও দুর্লঙ্ঘ্য সামন্তবাদী সমাজের মত-পথ, ধ্যান-ধারণাকে লঙ্ঘন করে তিনি আরও উন্মোচন করলেন, ‘অত্তাহি অত্তনো নাথো কোহি নাথো পরসিয়, আত্মদীপ ভব’। অর্থাৎ “তুমিই তোমার ত্রাণকর্তা। অদৃষ্ট পরিবর্তনে কোন মাধ্যম বা ত্রাণকর্তা নেই। আত্মশরণ হয়ে নিজের উপায় নিজেই অন্বেষণ কর।’ বুদ্ধের মতাদর্শে নিজেকে কারও প্রতি অন্ধভাবে সমর্পণ, ধর্মের নামে চাপিয়ে দেয়া কঠোর বিধিবিধান, বর্ণভেদ, শ্রেণীভেদ বা পেশাভেদ না থাকার কারণে আফগানিস্তানসহ সারা ভারতবর্ষে এবং পরবর্তীতে সারা এশিয়ায় বিনা অস্ত্রে, বিনা কূটনৈতিক চাপে তার মতবাদ দ্রুত বিকাশ লাভ করল। তবে বর্তমান আধুনিক বিশ্বে কোরিয়া, জাপান, চীন, তাইওয়ান, মঙ্গোলিয়া, ভিয়েতনাম, রাশিয়া প্রভৃতি দেশের বৌদ্ধরা বুদ্ধের প্রধান নীতি, কর্মবাদকেই আঁকড়ে ধরে ধর্মের নামে অনুৎপাদনমূলক কর্মকা- ক্রমান্বয়ে পরিহার করে আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে পরিবর্তন এনে তাদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অবস্থান সুদৃঢ় করেছে। এমনকি দুর্বল দেশগুলোর প্রতি সহায়তার হস্ত প্রসারিত করেছে। কিন্তু অন্যান্য উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশের মতো বাংলাদেশের বৌদ্ধরা কর্মবাদে মুখ্য ভূমিকা পালন তো করছেই না। বরং সম্পূর্ণরূপে সনাতনী হিন্দুদের মতো অন্ধভক্তি ও বিশ্বাসের সংস্কারে প্রায় সমাচ্ছাদিত। এর সঙ্গত কারণও রয়েছে। পেশা-শ্রেণী-বর্ণ বৈষম্যহীন, অন্ধ-ভক্তি-বিশ্বাস বিবর্জিত এবং সাম্যবাদী ধ্যান-ধারণা এবং অন্ধ গোঁড়া তদানীন্তন সনাতনী (উড়মসধঃরংঃ) ব্রাহ্মণ সমাজে গৌতম বুদ্ধের মতাদর্শ গ্রহণযোগ্য হলো না। সুতরাং সামন্তবাদী চিন্তাধারার তথাকথিত উচ্চবর্ণ, অভিজাত শ্রেণী, সমাজের পুরোধা, পুরোহিত ও বিত্তশালীরা তাদের আভিজাত্য, পৌরহিত্য, অভিভাবকত্ব এবং সর্বোপরি তথাকথিত নিম্নবর্ণ ও নিম্নশ্রেণী থেকে প্রাপ্য আনুগত্য হারানোর হীনম্মন্যতায় কিংবা জাত্যাভিমানের দম্ভে স্ফীত হয়ে বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের প্রতি বিদ্বেষের লেলিহান শিখা চরমাকারে উদগিরণ করতে লাগল। তদানীন্তন শাসক তথা রাজন্যবর্গের সমর্থন না পাওয়ায় এই বিদ্বেষ তুষের আগুনের মতো তাদের অন্তরে ধিকি ধিকি জ্বলতে লাগল। তারপর মৌর্যবংশের পতনের পর বৌদ্ধরা রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতা হারালে ষষ্ঠ শতাব্দীতে বিদ্বেষী ও রুষ্ট সম্প্রদায় সামন্তবাদী শাসক রাজাদের সমর্থনে সমস্ত বৌদ্ধ সন্ন্যাসী তথা ভিক্ষুদের নৃশংসভাবে প্রাণপাত করে বৌদ্ধ সভ্যতার অধিকাংশ নিদর্শন ও কীর্তি ধ্বংস করে দেয়া হলো। প্রতি ভিক্ষুর ছিন্ন মস্তকের জন্য ১০০ মুদ্রা করে পুরস্কার নির্ধারণ করা হলো। কোন কোন ভিক্ষু সন্ন্যাসীকে জলাশয়ে ডুবিয়ে হত্যা করা হলো; যা কিছু নিদর্শন অবশিষ্ট ছিল ভারতবর্ষে তুর্কী-মঙ্গোলীয় আক্রমণের সময় সম্পূর্ণরূপে ভূলণ্ঠিত ও ধূলুণ্ঠিত করা হলো। আত্মরক্ষার্থে বৌদ্ধদের অনেকে হিন্দু সম্প্রদায়ের সঙ্গে একাত্ম হয়ে গেল। আবার অনেকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণে বাধ্য হলো। ভারতবর্ষের পূর্ব প্রান্ত (পার্বত্য চট্টগ্রাম, চট্টগ্রাম এবং নোয়াখালীর কিয়দংশ) আরাকান রাজার শাসনাধীন থাকায় এতদঞ্চলের বৌদ্ধগণ তখনকার মতো রক্ষা পায়। কিন্তু ১২০৪ থেকে ১৬৬৬ সাল পর্যন্ত মোগল-তুর্কী বাহিনী কর্তৃক আরাকান রাজ্য অনেকবার আক্রান্ত ও দখল হয়। এই বৌদ্ধরা তখনও পর্যুদস্ত হয়। চরম বিপর্যয়ের পর সহায়সম্বলহীন বৌদ্ধ সম্প্রদায় ভারতবর্ষে (বাংলাদেশ-পাকিস্তানসহ) আর্থ-সামাজিক অবস্থার আর উন্নতি সাধন করতে পারেনি। এই বৌদ্ধরা ছায়াস্বরূপ সাধারণ হিন্দু অধ্যুষিত অঞ্চলে দীর্ঘকাল জীবনযাপন করার ফলে প্রায় সনাতনী হিন্দু সংস্কার-সংস্কৃতির সঙ্গে সংমিশ্রণ ঘটে গেছে। এসব সংস্কার বৌদ্ধদের দ্বারা যেভাবে পালিত হোক না কেন তা বৌদ্ধ ধর্মে ও সামাজিক কর্মকা-ের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে বৌদ্ধদের কাছে আজও বিবেচিত। বৌদ্ধদের অনুষ্ঠানাদি সাড়ম্বর ও ব্যয়বহুল না হওয়ার একটি কারণ হলো দুর্বল আর্থ-সামাজিক অবস্থা। দ্বিতীয় কারণ, বুদ্ধের দর্শন ও আদর্শ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, মানুষের জীবনযাত্রায় নিজের ও অন্যের সুখের তরে নিষ্কলুষ কর্মই ধর্ম হিসেবে বিবেচিত। এসব কর্ম সম্পাদনে ব্যাপক উৎসবমুখর অনুষ্ঠানের অবকাশ নেই। এই কর্মই মানব জীবনের সর্বশক্তিমান স্রষ্টা। প্রত্যেক সম্প্রদায়ের ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান বা কার্যকলাপে ধর্মীয় অনুভূতির চেয়ে আনন্দ অনুভূতির মাত্রা অধিক হারে পরিলক্ষিত হয়ে থাকে। বৌদ্ধদের ধর্মীয় কর্মকা-ও অনুরূপভাবে প্রভাবান্বিত। উল্লেখ্য, বৌদ্ধদের বেশিরভাগ অনুষ্ঠানই পূর্ণিমা কেন্দ্রিক। এ সবকে উৎসব বললে অত্যুক্তি হবে। কারণ, এসব অনুষ্ঠান নিরাভরণ এবং অত্যন্ত সীমিত ব্যয়ে সম্পাদিত হয়ে থাকে। এদেশের বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের অন্যতম বিশেষ অনুষ্ঠানগুলোÑ আষাঢ়ী পূর্ণিমা, বুদ্ধ পূর্ণিমা, মধু পূর্ণিমা, প্রবারণা পূর্ণিমা, মাঘী পূর্ণিমা, ফাল্গুনী পূর্ণিমা, কঠিন চীবর দান। এছাড়া লগ্ন, ক্ষণ, তিথিভিত্তিক স্বল্প পরিসরে পারিবারিক কিছু অনুষ্ঠান সম্পাদিত হয়ে থাকে। যেমন : সংঘদান, নবগ্রহ ও মঙ্গলসূত্র শ্রবণ, অন্নপ্রাশন, বিবাহ-অবাহ, মৃতের উদ্দেশে সংস্কারাদি। এসব উৎসবে বাংলাদেশের অন্যান্য তিন সম্প্রদায়ের মতো নেই কোন বাহারি পোশাক ক্রয়, বিতরণ এবং পরিধানপূর্বক ভ্রমণ। নেই ঘর-বাড়ির বিশেষ সাজসজ্জার সমারোহ। নেই কোন উপাদেয় খাদ্যের আয়োজন ও বিতরণ। বৌদ্ধদের অনুষ্ঠানে পূর্ণিমা, অষ্টমী ও অমাবস্যা তিথিতে ক্রমান্বয়ে তিন চান্দ্রমাস (আষাঢ়ী পূর্ণিমা থেকে প্রবারণা পূর্ণিমা) পর্যন্ত পুষ্প ও ভোজ্য দ্রব্যসহ ধূপ ও প্রদীপ প্রজ্বলনের মাধ্যমে বুদ্ধ মূর্তির উদ্দেশে মন্ত্র উচ্চারণপূর্বক পূজা উৎসর্গকরণ, ভিক্ষুদের কাছে শ্রুত পঞ্চশীল ও অষ্টশীল এবং অষ্টশীলের মন্ত্র পুনঃউচ্চারণ করার পর উপোস ব্রত পালন, ভিক্ষু সংঘকে দক্ষিণা, আহারসহ বিবিধ দ্রব্য দানপূর্বক দেশনা ও জাতক শ্রবণ পালিত হয়। তাছাড়া সমবেত বুদ্ধ কীর্তন পরিবেশনা ও ফানুস উত্তোলনের মতো উৎসবব্যঞ্জক সংস্কার সীমিত ব্যয়ে পালিত হয়ে থাকে। আবার কোন কোন বৌদ্ধ ভিক্ষুর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া, জন্মজয়ন্তী, একক দেশনা (ধর্মসভা) ইত্যাদি ব্যয়বহুল মহাসমারোহে আয়োজন করা হয়। এসব দেশনায় অনেক সময় উচ্চ মার্গের জটিল বিষয়ে কিছু বাংলা এবং অধিকাংশ পালি ভাষায় বয়ান ঘণ্টার পর ঘণ্টাও চলতে থাকে। এসব বোধগম্য হোক বা না হোক এসব আয়োজনে দর্শন, শ্রবণ, উপবেশন ও শ্রুত, মন্ত্র উচ্চারণে জন্ম-জন্মান্তরের কৃতপাপ মোচন এবং পুণ্য ও সুখ সঞ্চয় ঘটে বলে বিশ্বাস। প্রায় আড়াই হাজার বছর পূর্বে ভারতবর্ষের পায়ে চলার পথ আদৌ সুগম ছিল না। পদব্রজে ধর্মপ্রচার ছিল দুচ্ছেদ্য। যে কোন উদ্ভূত সমস্যা সমাধানের নিমিত্তে তথায় ভিক্ষুসংঘ এবং শিষ্যদের সঙ্গে গণতান্ত্রিকভাবে পর্যালোচনা করত। সমাধান, উদ্ভাবন, নতুন উপদেশাবলী সংযোজন, পরবর্তী কার্যক্রম নিরূপণ কিংবা ভিক্ষুসংঘ ও গৃহীদের বিনয়, বিধি-বিধান নির্ণয় করা হতো। উল্লেখ্য, সেকালে বুদ্ধের মুখনিঃসৃত বাণী বা বিষয়াদি লিপিবদ্ধ করা এবং তাতে ব্যবহার্য উপকরণের ব্যবহার প্রচলন ছিল না। ফলে প্রচারকার্যে ত্রুটি বা বিস্মৃতি ঘটতে পারে বলে ইত্যাদি বিষয়ের ওপর স্মৃতিচারণ ও মনে রাখার জন্য বিদর্শন, ভাবনা, ধ্যান-সাধনা ঐ অবস্থানে থেকে অনুশীলন করতে হতো। তাছাড়া নিয়মিত যোগব্যায়াম ও যোগসাধনা নির্ধারিত ছিল। বর্ষাকালে তিন মাস এই গঠনমূলক ধ্যান-সাধনাপূর্বক অবস্থানকে ‘বর্ষাবাস’ বলে। উন্নত বিশ্বের ভাবধারায় আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার উন্নতি সাধন করতে হলে ব্যয়বহুল কর্মকা- পরিহার করে এদেশীয় বৌদ্ধদের ধর্মীয়-সামাজিক কর্মকা-ে বুদ্ধের প্রধান ও বাস্তব মতাদর্শ কর্মবাদকে অনুসরণ করা বাঞ্ছনীয়। এতেই দুঃখ মোচন এবং সুখ আনয়নের প্রত্যাশা নিহিত। লেখক : প্রাবন্ধিক ও শিশু সাহিত্যিক
×