ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

শারদীয় উৎসবে শিল্পীদের ভাবনা

প্রকাশিত: ০৩:৪৭, ৮ অক্টোবর ২০১৬

শারদীয় উৎসবে শিল্পীদের ভাবনা

বছর ঘুরে আবার এসেছে বাঙালী হিন্দু সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গোৎসব। শুক্রবার ষষ্ঠী পূজার মাধ্যমে সারাবিশ্বের মতো বাংলাদেশে ম-পে ম-পে শুরু হয়েছে আনন্দময়ী দেবী মা দুর্গার স্তুতি, পূজা অর্চনা। ধর্ম সম্প্রদায়ের গ-ি পেরিয়ে সাস্প্রতিক সময়ে এ উৎসব হয়ে উঠেছে বাঙালী সংস্কৃতির অন্যতম বৃহৎ সামাজিক উৎসব। পঞ্চপ্রদীপের শিখায় বোধন হয়েছে দুর্গোতিনাশিনী দেবী দুর্গার। বলা হয়ে থাকে পৃথিবীর সবচেয়ে সনাতন ধর্ম হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সর্ববৃহৎ ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজা। এ উৎসবকে ঘিরে ধর্মপ্রাণ হিন্দুদের প্রাণোচ্ছ্বল বর্ণিল আয়োজন এবং তাদের আনন্দ উন্মাদনার প্রকাশ সত্যি অবাক করার মতো। এই উৎসবকে ঘিরে এই সম্প্রদায়ের মানুষরা প্রাণভরে উপভোগ করে থাকেন নানা আয়োজন।পরিবর্তিত পরিস্থিতি এবং সভ্যতার ক্রমান্বয় উৎকর্ষতায় এই উৎসব এখন বাঙালীর প্রাণের উৎসবে পরিণত হয়েছে। ধর্ম যার যার উৎসব সবার এই সেøাগানে পালিত হচ্ছে শারদীয় দুর্গাপূজার উৎসব। পৃথিবীর অন্যতম সনাতন ধর্মের মানুষরা সাম্প্রতিক সময়ে এই বিষয়ে কী ভাবছেন। এ প্রসঙ্গে সাম্প্রতিক সময়ে জনপ্রিয় কয়েকজন শিল্পীর সঙ্গে কথা বলে এ প্রতিবেদন তৈরি করেছেন গৌতম পা-ে। সঙ্গীতশিল্পী চন্দনা মজুমদার : আমাদের ছোটবেলার পূজার অনুভূতিটা ছিল অন্যরকম। কুষ্টিয়ায় দাদুর বাড়ি, আমার বাবার বাড়িতে পূজা হতো। তখন নতুন জামা কেনার যে ধুম পড়ে যেত, তা পরবর্তীতে লুকিয়ে রাখারও চেষ্টা ছিল। পূজার সময়ে সেগুলো পরতে হবে এবং অন্যরকম দেখতে লাগবে সে ইচ্ছা কাজ করত। বিজয়া দশমীর পর বাড়ির ভেতরে মঞ্চ করে সেখানে গান-বাজনার অনুষ্ঠান করা ছিল খুবই আনন্দের বিষয়। এছাড়া বিভিন্ন রকম ফল কাটা, মালা গাঁথা হতো। আমরা এখন শহুরে হয়ে যাওয়ায় সে আনন্দ আর পাই না। এখন ছেলে-মেয়ে, শশুর-শাশুড়ি সবার চিন্তা করতে হয়। সত্যি কথা বলতে কি, পূজার সময় এখন আর সেইভাবে বাইরে যাওয়া হয় না। বিভিন্ন পূজা ম-পে অনুষ্ঠান থাকে, সেই সুবাদে ঠাকুর দেখাও হয়ে যায়। বাপ্পা মজুমদার : জীবন ধীরে ধীরে এগুচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে জটিল থেকে জটিলতর দিকে যাচ্ছি, পাশাপাশি ব্যস্ততাও বাড়ছে। ছোটবেলার পূজার আনন্দের সঙ্গে এখনকার আনন্দ মেলানো কঠিন। এ আনন্দের পার্থক্যটাও বিস্তর। বাবা-মা বেঁচে থাকতে যে অসম্ভব আনন্দ উপলব্ধি করতাম সে সময়, এখন তো আর তেমন হওয়ার নয়। বিশেষ করে আমার মা যখন ছিলেন, তখন অনাবিল এক আনন্দ হতো পূজার সময়। সবাই মিলে ঠাকুর দেখতে যাওয়া, নতুন জামা-কাপড় পরে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যাওয়া ছিল অন্যরকম এক আনন্দ। এখন প্রতি পূজার সময় ঠাকুর দেখতে যাওয়ার ইচ্ছা থাকে। এবার পূজার সময় কলকাতায় যাওয়ার ইচ্ছা রয়েছে। অণিমা রায় : বয়সের সঙ্গে সঙ্গে আনন্দের অনুভব ও প্রকাশ পাল্টাতে থাকে। এক সময় আমাদের বাড়িতে দুর্গাপূজা হতো। এখন আর হয় না। এখন কালীপূজা হয়। ছোট বেলার পূজার সে আনন্দ বলে বোঝানো যাবে না। নতুন জামা-কাপড়ের পাশাপাশি প্রণামি পাওয়ার এক নির্মল আনন্দ ছিল। সবাইকে নিয়ে প্রতিমা দেখতে যাওয়ার মজাটাই ছিল অন্যরকম। এখন যে পূজার সময় আনন্দ হয় না এমন নয়। এখন দায়িত্বের আনন্দটা বেশি। সবাইকে খুশি করাতে পারলাম কি না, কিংবা আমার আনন্দের সঙ্গে অন্যের আনন্দকে কতটুকু ভাগাভাগি করতে পারলাম এটাই বিবেচ্য বিষয়। পূজার সময় বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গান করে আমার শ্রোতাদের কতটুকু আনন্দ দিতে পারলাম এটাও একটা বিষয়। প্রিয়াঙ্কা গোপ : আমি নিজে পূজায় খুব এনজয় করি। আমি বড় হয়েছি টাঙ্গাইলে। সেখানে ছোটবেলায় পূজার সময় অনেক আনন্দ হতো। বলা যায় সেটা ছিল নির্মল আনন্দ। এখন ঢাকাতেই আনন্দ করি। বিজয় দশমীতে মামার বাড়ি যাই। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গান করি। সংস্কৃতি অঙ্গনের সবার সঙ্গে মেলবন্ধন হয়। কলিগদের খাওয়ানো হয়। পূজার বিষয়ে দায়িত্ব ছোটবেলার চেয়ে এখন অনেক বেশি। আমার মনে হয় ছোটবেলার চেয়ে এখন বেশি এনজয় করি। ধ্রুব গুহ : ছোটবেলার পূজার সময় খুব ইনজয় করতাম। কখনও বন্ধুদের সঙ্গে দল বেঁধে আবার কখনও একা বিভিন্ন ম-প ঘুরে ঘুরে প্রতিমা দর্শন করতাম। প্রসাদ খাওয়াও একটা উদ্দেশ্য ছিল। তবে বিভিন্ন ম-পে ঘুরে ঘুরে প্রতিমা দেখতেই বেশি ভাল লাগত। যে কোন উৎসবে বড়দের কাছে থেকে উপহার পাওয়াও ছিল অন্যতম আনন্দের। সব মিলে ছোটবেলায় পূজার সময় বেশ উপভোগ করা হতো। তবে এখন এই বয়সে তেমনভাবে ঘোরাঘুরির সুযোগ খুব একটা হয় না। সংসার জীবন, চাকরি কিংবা গানের চর্চার কারণে এখন অনেক বন্ধু বান্ধব হয়েছে। তাদের সঙ্গে জীবনের সুখ দুঃখগুলো শেয়ার করা হয়। বন্ধুরা ছাড়া স্ত্রী সন্তানের সঙ্গেও সব কিছু ভাগাভাগি করি। ডিজিটাল যুগে সব কিছু এখন হাতের মুঠোয়। তাই প্রতি মুহূর্তের সুখ দুঃখ ভাগাভাগি করে নেয়ার আনন্দই আলাদা। তবে বাঙালীদের অন্যতম ঐতিহ্য শারদীয় দুর্গাপূজা উপলক্ষে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে যে উৎসবের উন্মাদনা দেখা যায় তা কিন্তু সত্যিই আমাদের পুলকিত ও মুগ্ধ করে। এ উৎসব উপলক্ষে আমার বন্ধু বান্ধব আত্মীয়স্বজন সবাইকে জানাই শারদীয় শুভেচ্ছা। সবাই ভাল থাকুন, আনন্দে থাকুন সৃষ্টিকর্তার কাছে এই প্রার্থনা। নৃত্যশিল্পী তুষার চক্রবর্তী : ছোট বেলা পূজার বিষয়গুলো ছিল অনেক আনন্দের, মুসলিম, খ্রীস্টান, হিন্দু বলে কিছু না, সব বন্ধুরা একসঙ্গে যেতাম বিভিন্ন পূজাম-প ঘুরতাম, কখনও বাবা-মা, ভাই-বোন একসঙ্গে যেতাম ঘুরতে, নাগরদোলায় চড়তাম, মেলা হতে বিভিন্ন মাটির ও কাঠের তৈরি পুতুল, হাঁড়ি পাতিল এসব কিনতাম। পূজার সময় বিভিন্ন অনুষ্ঠান হতো সেগুলোতে অংশ নিতাম। বন্ধু-বান্ধবীদের বাড়ি যেতাম, নাড়ু, লুচি ও ঘণ্ট খেতে। এখনও স্বাদ মুখে লেগে থাকে। প্রতিদিন ম-প ঘুরতাম, ঢাকের সঙ্গে আরতি নৃত্যেও অংশ নিতাম। সে সময় মোটামুটি ভালই পারতাম আরতি নৃত্য। তবে এখনকার সময়ের পূজা, ঈদ বা বড়দিন যেভাবে পালন করা হয় তা দেখলে সত্যি বুকের মধ্যে একটা ব্যথা অনুভব করি, মানুষ যুগের সঙ্গে চালতে চলতে আজ কিছুটা যান্ত্রিক হয়ে গিয়েছে সেই দিনগুলো আর নেই, তখনও অনুষ্ঠান হতো ২-৩ জন পুলিশ ভাইরা পাহারা দিত আর এখন পরিবেশটা কি তা সবার জানা। ভীষণ খারাপ লাগে যখন দেখি সেই দিনগুলোর আংশিকও এখন নেই, সবাই যেন কেমন হয়ে গিয়েছে পরিবেশটাও ঠিক তাই। তবে প্রার্থনা সকল অকল্যাণ দূরীভূত হোক। সবার মঙ্গল হোক। নাট্য নির্মাতা দীপু হাজরা : ঢাক বাজবে, বাজবে কাসর, বাজবে পূজার ঘণ্টা, মা দেবীর আগমনে তাইতো পাগল মনটা। এই পূজাতে সুদৃঢ় হোক বন্ধুত্বের বন্ধন, রইল সঙ্গে অনেক অনেক শুভেচ্ছা ও অনেক অভিনন্দন। শারদীয় দুর্গাপূজা উপলক্ষে সংস্কৃতি কর্মীদের জয় হোক, পৃথিবীর সকল মানুষের কল্যাণ হোক।
×